মতামত

বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম: সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ

-ফজলুল কবির মিন্টু

সামাজিক নিরাপত্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদের অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়টি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিশেষ করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশও বিশ্বের উন্নত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সমূহের পথ অনুসরন করে সর্বজনীন পেনশনের যুগে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৃদ্ধ এবং দরিদ্র, সেখানে একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নের ধারণাটি সমাজে বিদ্ধমান দরিদ্র ও বয়স্ক নাগরিকদের আর্থিক সংকট ও অপারাপর সমস্যাগুলো মোকাবেলায় একটি সম্ভাব্য কার্যকর সমাধান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আজকের প্রবন্ধে আমি বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রবর্তনের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সম্ভাবনা:
১. সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি: বাংলাদেশে সরকারী চাকরিজীবীরা অবসর পরবর্তী সময় পেনশন পেয়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারী চাকরিজীবীরা অবসর পরবর্তী সময় পেনশন পায় না। একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রচলন হলে বেসরকারী অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীসহ অন্যান্য বয়স্ক জনগোষ্ঠী পেনশনের আওতায় আসবে। এতে তাদের জন্য একটি সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি হবে, তাদের অবসর গ্রহণের পরবর্তী সময়গুলিতে জীবনযাত্রার একটি ন্যুনতম মৌলিক মান নিশ্চিত করবে। এটি প্রবীণ ও দরিদ্র বয়স্ক নাগরিকদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভ’মিকা রাখতে সক্ষম হবে। ফলশ্রম্নতিতে দেশের দরিদ্র ও বয়স্ক নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি পাবে।
২. পরনির্ভরশীলতা হ্রাস: সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়িত হলে বয়স্ক নাগরিকদের আয়ের একটি স্থায়ী উৎস থাকবে। তাদের নিজেদের সহায়—সম্পদ ও আয়ের কোন উৎস না থাকলেও বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে সন্তান বা অন্য কারও মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবেনা। শুধু তাই নয় এ ধরনের স্কিম তরুণ প্রজন্মের উপর আর্থিক বোঝা প্রশমিত করবে, যাতে তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যত বিনির্মান ও আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধিতে মেনোযোগ দিতে সক্ষম হবে।
৩. অর্থনৈতিক উদ্দীপনা: সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে বেসরকারী অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী এবং বয়স্ক দরিদ্র নাগরিকদের হাতে আয়ের একটি স্থায়ী উৎস তৈরি হবে। ফলশ্রম্নতিতে পণ্য এবং পরিষেবাগুলির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিশীলতা বাড়বে। যা প্রকারন্তরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে।
৪. লিঙ্গ সমতা: এই ধরনের স্কিম বিশেষত বয়স্ক মহিলাদের উপকারে আসবে। একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যকরভাবে পরিচালিত হলে দেশের প্রান্তিক দরিদ্র মহিলারাও তাদের বৃদ্ধ বয়সে স্থায়ী আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ পাবে। যা দেশে লিঙ্গ সমতা তৈরিতে ব্যাপক ভ’মিকা রাখবে।
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ:
১. আর্থিক স্থায়িত্ব: প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল প্রকল্পের আর্থিক স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য যথেষ্ট তহবিলের প্রয়োজন হবে এবং সরকারকে অন্যান্য সামাজিক ও উন্নয়নমূলক অগ্রাধিকারের সাথে এই খরচগুলির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। স্কিমে জমাকৃত টাকা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে একটি মজবুত ও শক্তিশালী তহবিল গড়ে তোলা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিতে পারে।
২. প্রশাসনিক দক্ষতা: এই ধরনের একটি স্কিম বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন হবে যাতে তহবিল বিতরণ পরিচালনা করা যায়, জালিয়াতি প্রতিরোধ করা যায় এবং চাঁদা প্রদানকারীরা যাতে মেয়াদ পূর্তি শেষে তাদের পেনশন সঠিক সময়ে নিয়মিতভাবে পান।
৩. মুদ্রাস্ফীতির চাপ: পেনশন স্কিম দ্বারা চালিত ব্যয় বৃদ্ধি, যদি পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহ বর্ধিত চাহিদার সাথে না মেলে তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক বিরুপ প্রভাব: সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রবর্তন হলে দেশের নাগরিকরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অন্যান্য প্রচলিত সঞ্চয় প্রকল্পের প্রতি নিরুৎসাহিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
৫. সরকার পরিবর্তনের প্রভাব: ক্ষমতার পালা বদল হলে বর্তমান সরকারী দল আওয়ামীলীগের পরিবর্তে নতুন কোন দল ক্ষমতায় আসলে তারা আওয়ামী সরকারের প্রবর্তীত পেনশন স্কিম পরিচালনা করতে আগ্রহী হবে কীনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
৬. নিয়মিত চাঁদা প্রদান: দেশে মোট শ্রম শক্তি ৭ কোটি ৩৭ লাখ। তন্মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক। বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ । অর্থাৎ দেশের মোট শ্রম শক্তির বড় অংশের স্থায়ী আয় নেই। এই অবস্থায় তাদের পক্ষে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমান চাঁদা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কীনা তাও ভাবতে হবে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে দেশের মোট শ্রম শক্তির বড় অংশ স্কিমের বাইরে থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সকল সম্ভাবনাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। আবার সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষগুলোকে এর আওতায় আনা। সুতরাং চাঁদা নির্ধারন এমনভাবে হওয়া উচিৎ যাতে সবাই এতে অংশগ্রহণ করতে পারে অন্যথায় এর সুফল কতিপয় উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে প্রকারন্তরে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নামকরনের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
উপসংহার: বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রবর্তনের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। যদিও এটি বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নেটকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সমাজে একটি ভাসাম্যপূর্ণ লিঙ্গ সমতা তৈরি করতে পারে, তবে এই প্রকল্পের আর্থিক টেকসইতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং দেশের প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের সুযোগের বিষয় সতর্কভাবে বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সম্ভাব্য সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে একটি সুষম ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি প্রবর্তন করার গুরুত্ব অপরিসীম।
(লেখক: কোডিনেটর, পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কেন্দ্র, বিলস—ডিটিডিএ প্রকল্প, কদম রসুল, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম)