বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১০৯): সোভিয়েত ইউনিয়ন

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আমরা হাঁটছিলাম মস্কো নদীর ধার দিয়ে। অনেক নতুন স্থাপনা এখানে সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও সোভিয়েত আমলের স্থাপনাও কম নয়। এই দুইয়ের মিশ্রণে মস্কো এখন অনেক সুন্দর। দুইয়ের বললে ভুল হবে। আমরা যেখানে হাঁটছিলাম সেখানে জারের আমলের মানে বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ার ঐতিহাসিক অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছিল। আসলে কোন দেশ, কোন সমাজ যদি এই পরমম্পরা বজায় রাখতে না পারে বা না চায় তাহলে সেই সমাজের কপালে কষ্ট আছে। কেননা সমাজ শুধু রাজার ইতিহাস নয়, প্রজার ইতিহাস। সময়ের সাথে সমাজ বদলায়। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি। রাশিয়ায় প্রায় প্রতিটি শহরেই আছে আঞ্চলিক ইতিহাসের মিউজিয়াম, সেখানে বিভিন্ন সময়ে সেই এলাকার জীবনযাত্রার বিভিন্ন খুঁটিনাটি জিনিসপত্র সযত্নে সংগৃহীত আছে।

তুমি একদিকে বলছ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ কোন দেশ নয়, আবার অন্যদিকে বলছ কোন একদিন নতুন নামে নতুন স্থানে সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্ম নিতেই পারে। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়?

না। সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক দুর্বলতা ছিল আর সেসব ছিল বলেই দেশটা হারিয়ে গেছে, তবে এর সবলতাও কম ছিল না। আর এ কারণেই এখনও সেই দেশ আমাদের কাছে ফিরে আসে। সমস্ত পৃথিবীই তো প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। কমবেশি আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস আমাদের বেশ ভালোভাবেই জানা আছে। রাজা বদলিয়েছে, রাজ্য বদলিয়েছে। রাশিয়ায় রিউরিকভিচের পরে রোমানভ বংশ শাসন করেছে, ভারতবর্ষ বিভিন্ন হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজবংশের পরে পাঠান, মুঘল, ইংরেজ শাসন দেখেছে, একই ভাবে চীন, মধ্যপাচ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা – সারা বিশ্বই গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সব জায়গায় ছিল শুধু রাজাদের ইতিহাস – তাদের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই ধারা ভেঙ্গেছে, অল্প কিছু মানুষের নয় দেশের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য বদলিয়েছে মাত্র কয়েক দশকে। তাই এই মডেলকে আমরা স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে নিতেই পারি।
তার মানে আবার বিপ্লব?
বিপ্লব যে একমাত্র পথ তেমন কোন কথা নেই। বিপ্লব কী? আমুল পরিবর্তন। সোভিয়েত ব্যবস্থার আগে আমাদের কোনই ধারণা ছিল না কেমন হবে সেই নতুন সমাজ। আর এ কারণেই তখন পুরানো সব ধ্বংস করে নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল বা করতে হবে বলে তখনকার নেতারা ভেবেছিলেন। যেহেতু বর্তমানে আমরা জানি কেমন হতে পারে সেই সমাজ আর এ জন্যে সেই সোভিয়েত সমাজের কোন কোন দিকগুলো শোধরানো দরকার আর বর্তমান সমাজের কোন কোন জিনিসগুলো রাখা দরকার তাই এখন বিপ্লব ছাড়াও সেটা সম্ভব। একটা হল আমরা কি পেতে চাচ্ছি সে সম্পর্কে স্বপ্ন বা তাত্ত্বিক ধারণা, অন্যটা হল তার বাস্তব প্রোটোটাইপ। এটা বলতে পারিস প্রথম মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন তৈরি করা আর পরবর্তীতে তার নতুন নতুন মডেল বের করার মত। নতুন মডেল তৈরি হয় পুরানো মডেলের উপর ভিত্তি করে, আগের মডেলের ত্রুটিগুলো দূর করে আর নতুন কিছু ফাংশন যোগ করে। এখানেও তাই।

তাহলে নতুন করে করলেই তো হয়।

অবশ্যই নতুন হবে, তবে পুরানো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, পুরানো যা ভালো সেটা রেখে। আমরা যখন ঘর মেরামত করি তখন তো সব ফেলে দিই না, যেটুকু কাজে লাগানো যায় সেটা রেখে দেই। জীবনের সব ক্ষেত্রেই তেমন। এমন কি যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাই, নতুন করে জীবন শুরু করি তখনও আগের অভিজ্ঞতা, আগের শিক্ষা সবই তো সাথে করে নিয়ে যাই। জীবন তো শুধু বর্তমান নয়, এটা অনেক অনেক অতীতের সমষ্টি।

সোভিয়েত সমাজের কী কী তুমি রাখতে?

মনে আছে কিছুদিন আগে আমরা ফ্রুঞ্জেনস্কায়ায় একটা ক্যাফেতে গেছিলাম মনিকা আর ক্রিস্টিনার সাথে? পথে আমরা তোদের ছোটবেলার বিভিন্ন গল্প করছিলাম। তোরা বলছিলি তখন আমরা মাইক্রোস্কোপিক মাংস খেতাম, মানে মাংসের পরিমাণ ছিল খুব কম আর লোক বেশি তাই আমি খুব ছোট ছোট টুকরা করতাম যাতে সবাই একটু করে হলেও পায়। সেদিন মনিকা বলছিল এখন যে আমরা ক্রেডিটে চলি সেটা সেই সময়ের চেয়ে ভালো। আমারও মনে হয় তাই। তখন আমাদের সবার ছিল এক অবস্থা। বেতন এক সাথে পাই, তাই কারো কাছ থেকে ধার করার উপায় ছিল না। মনে হয় সেই সময় ক্রেডিটের ব্যবস্থা থাকলে তোদের ঠিকঠাক খাওয়ানোর চেষ্টা করতাম।

তুমি চেষ্টা করেছ। আমরা এ জন্যে তোমাকে দোষ দেই না।

ব্যাপারটা দোষ দেয়া বা না দেয়ায় নয়। এটা ছিল বাস্তবতা। হয়তো দেশে থাকলে এমনটা হত না। আত্মীয় স্বজন ছিল। এখানে সেটা না থাকায় আমার বা আমাদের সমস্যা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিন্তু এমনটা ছিল না। প্রতিটি শিশু সরকার থেকে বিভিন্ন ধরণের সাহায্য পেয়েছে। রাশিয়ায় এখনও পায়, তবে সেটা অপ্রতুল। সব বাবা মা জানত বাচ্চারা বিনা পয়সায় পড়াশুনা করতে পারবে, ফ্রি চিকিৎসা পাবে, যে বেতন পায় তাতে আর কিছু না হোক খাবারের সমস্যা হবে না, সবার ভালো মন্দ একটা থাকার ঘর ছিল, পরার পোশাক ছিল। আমি এখন আগের থেকে অনেক বেশি বেতন পাই, কিন্তু ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতে টাকা পয়সার প্রয়োজন অনেক বেশি। তবে নিয়ম এটাই যে অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়সী মানুষ বেতন কম পায়, সময়ের সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ে, বেতন বাড়ে। সোভিয়েত আমলেও সেটাই ছিল। কিন্তু সরকার বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে সাধারণ মানুষের কাঁধের সেই বোঝাটা কমিয়ে দিতে পেরেছিল। তোদের ছোটবেলায় ক্রেডিটের ব্যবস্থা ছিল না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রেডিট হয়তো আমাদের তখনকার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করত, কিন্তু দীর্ঘ দিনের জন্য কাঁধের উপর জোয়াল তুলে দিত যেমন এখন প্রতি মাসে মাসে ক্রেডিট শোধ করতে হচ্ছে। কাজ থাকলে সেটা করা যায়, কিন্তু চাকরি না থাকলে? তাই সোভিয়েত আমলের সমাধানটা অনেক বেশি কার্যকর ছিল। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের সময় এ দেশে শিক্ষিতের হার খুবই কম ছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নে সার্বজনীন শিক্ষা চালু হয়। সেটা শুধু শেখার জন্য শেখা ছিল না, নিরক্ষরতা দূরীকরণ শুধু নাম সই করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ দেশের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে বেরিয়ে আসে লাখ লাখ বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অভিনেতা, নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীত বিশারদ। আর এসব শুধু পশ্চিমা বিশ্বের নকল করে কিছু তৈরি করা ছিল না, ছিল একেবারে নতুন ধরণের কাজ, নতুন আবিস্কার। বিপ্লবের পর প্রচুর রুশ বিশেষজ্ঞ বিদেশে চলে যায়, সেসব দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বড় ধরণের অবদান রাখে। তার মানে জারের রাশিয়ায় এখানে অনেক ভালো বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু সেই শিক্ষার সুফল পেত খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। আর বিপ্লবের পরে সেটা সমস্ত জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে কোন সিস্টেম সেটা দিতে পারেনি, দেয়নি। এমনকি এখনও তারা সেটা দিচ্ছে না। কারণ মানুষকে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত করে রাখা তাদের শোষণের পথ সহজ করে। আজ এ দেশের অধিকাংশ প্রতিভাবান ও প্রতিষ্ঠিত মানুষের ইতিহাস খুঁজলে দেখবি তিন চার জেনারেশন আগে এদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন অতি সাধারণ  মানুষ। বিপ্লব না হলে এদের বেশির ভাগই সেই পর্যায়েই থেকে যেত যা আমরা দেখি অন্যান্য দেশে। আমি বলছি না যে এদের কেউই বর্তমান অবস্থায় আসতে পারত না। পারত। তবে তাদের সংখ্যা হত নগণ্য। কেন না পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সত্যিকার উচ্চ শিক্ষা খুব অল্প লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি ডিগ্রির কথা বলছি না, বলছি সত্যিকারের শিক্ষার কথা।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১০৮): ক্ষমতা ও দায়িত্ব-বিজন সাহা

কিন্তু তাতে লাভ কি? এখনও তো সবাই লেখাপড়া করে ওখানেই যেতে চায়।

সমস্যা এখানেই। আমাদের দেশে বাবা মা কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখায়। একেক জন বিশেষজ্ঞ গড়ে তুলতে দেশেরও প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু কী ছাত্রছাত্রী, কী তাদের বাবা মা, মনে হয় দেশও স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তানরা যেন বড় হয়ে ইউরোপ বা আমেরিকার নামকরা কোন কোম্পানিতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে। আমাদের দেশে কেউ ঘর জামাই পছন্দ করে না, কিন্তু বিদেশে বিভূঁইয়ে থেকে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা করুক সেটা সবাই চায়। এটা আজ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি বাবা মার স্বপ্ন। এমনকি আজকের রাশিয়ায় অনেক বাবা মা সেই স্বপ্ন দেখে। আর এখানেই পার্থক্য। সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষ এমন স্বপ্ন দেখত না, অন্তত বেশির ভাগ মানুষ। তারা তাদের নিজেদের, তাদের ছেলেমেয়েদের ভাগ্য সেই দেশের সাথেই জড়িয়ে রাখত। কারণ সবার কমবেশি একটা নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন ছিল। আমেরিকায় বা অধিকাংশ ধনী পুঁজিবাদী দেশে সেই ধরণের নিশ্চয়তা না থাকলেও প্রায় সমস্ত দক্ষ মানুষের জন্যেই এক ধরণের নিশ্চয়তা আছে। মানুষ সব কিছুর পরে সেই নিশ্চয়তাই চায়। এই যে আমরা পড়াশুনা করি, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা শেখাই, ঘরবাড়ি তৈরি করি এসব তো ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য, নিরাপত্তার জন্য। আজ পর্যন্ত মানুষ যা করেছে সেটা শুধু ভবিষ্যতের জন্য। যে করেই হোক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশের অধিকাংশ মানুষের মনে এই বিশ্বাস জাগাতে পেরেছিল যে তাদের ভবিষ্যৎ এখানেই সবচেয়ে নিরাপদ। পুঁজিবাদে সেটা নেই। সেখানে সব সময়ই এক ধরণের অনিশ্চয়তা কাজ করে। এটা একদিকে যেমন মানুষকে আরও দক্ষ, আরও কর্মঠ হতে অনুপ্রাণিত করে, অন্যদিকে তেমনি সমাজে অস্থিরতার জন্ম দেয়। বিপরীত ভাবনার ঐক্য ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে যায়। কিন্তু মানুষকে যদি সারা জীবন ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করেই কাটাতে হয় তাহলে সে সুখ পাবে কবে? সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি যখন পড়তে আসি তখন সবচেয়ে যেটা আমাকে অবাক করত তা হল মানুষের নিরুদ্বিগ্ন মুখ। মেট্রো বা বাসে বা ট্রামে বসে বই পড়তে পড়তে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। কারো মনে কোন চিন্তার লেশ মাত্র নেই। এটা আর যাই হোক জোর করে করা যায় না। আর এ জন্যেই হয়তো আমার মত অনেকেই যারা এদেশে সেই সময় ছিল আবার সেই সময়ে, সেই সমাজে ফিরে যেতে চায়, সেই ধরণের সমাজ ফিরে পেতে চায়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো