বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১০৬):বইয়ের পাতা থেকে

-বিজন সাহা

পাপ, তোমাকে গত সপ্তাহে যে বইটা দিয়েছিলাম তুমি পড়েছ?

না রে, এখনও হয়ে ওঠেনি। দেখি, সময় করে পড়ব।

আচ্ছা।

আসলে ইদানিং আমার গল্পের বই খুব একটা পড়া হয়ে ওঠে না। নিজের বিষয়ের উপর পড়াশুনা করে যেটুকু সময় থাকে সেটা কাটে রাজনীতি আর বর্তমান ঘটনাবলীর খবরাখবর পড়ে। লেখার এই একটা ঝামেলা। এটা অনেকটা চৌবাচ্চার মত – সেখান থেকে জল বের করতে হলে আগে জল ঢালতে হয়। যেহেতু আজকাল রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে নিয়মিত লিখি তাই এসব নিয়ে পড়তে হয় বা অন্যান্য ভাবে খবর সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া কিছুদিন হল ২০২১ সালে আমাদের ভোলগা ভ্রমণ নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাদের ভ্রমণের গল্পই লিখব। পরে ভেবে দেখলাম প্রতিটি শহর মানে সেখানকার মানুষের ইতিহাস, সেই শহর কেমনে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছুল তার কাহিনী। তাই সেসব নিয়ে পড়াশুনা না করে লিখলে সেটা হবে সময়ের অপচয়। ফলে গল্পের বই পড়ার সময় দিন দিন কমে আসছে।

সেভা গত সপ্তাহে মগজ নামে একটা বই দিয়েছিল। ক্রিস্টিনার কাছ থেকে নিয়ে ও পড়েছে। ভালো লেগেছে ওর। তাই আমাকে পড়ে দেখতে বলেছে। আসলে আমিও আমার ভালোলাগার বইগুলো ওদের পড়তে বলি। এটা মনে হয় সেই সূত্র ধরেই। তাছাড়া আমি ওকে অনেকদিন ধরেই নিউরন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে চাইছিলাম। মগজ নিয়ে কথা বলতে গেলে এসব আসে।

তুই এখন কি পড়ছিস?
একবিংশ শতাব্দীর সাইকোলজি।
কেমন লাগছে?
বেশ ভালোই লিখেছে।
আচ্ছা।
আমি শেষ করে তোমাকে দেব। পড়ে দেখতে পার।
ঠিক আছে।
এটা এখনকার বেস্ট সেলার।
তাই?
হ্যাঁ।
আসলে জানিস, লোকজন যখন বেস্ট সেলার লিখতে চায় তারা তখন জনমত দ্বারা প্রভাবিত হয়। বেস্ট সেলার হয় কিন্তু বেস্ট বই নাও হতে পারে।
যেমন?
তখন তারা মানুষ কি কিনতে বা পড়তে চায় সেটা নিয়ে বেশি ভাবে। ফলে প্রায়ই বিষয়বস্তুর গভীর পর্যালোচনা না করে ফ্যাশনের সাথে কম্প্রোমাইজ করে। যেমন ধর ছবির কথা। অধিকাংশ মানুষ যখন ছবি তুলতে আসে তারা চায় গ্ল্যামার – ছবির আসল দিক, যেমন কম্পোজিশন, সঠিক লাইটিং এসব দেখে না। কিন্তু ক্লায়েন্ট যেহেতু পয়সা দেয়, তাই শিল্পীকে ক্লায়েন্টের কথাই মেনে নিতে হয়। নিজের পছন্দ না হলেও তার ইচ্ছামত ছবি তুলতে বা আঁকতে হয়। লেখকদের অনেকের ক্ষেত্রে সেটাই বেশি আকর্ষণ করে। বলে না ক্রেনা সবসময়ই সঠিক। তাই শিল্পীর স্বাধীনতা দিনের শেষে যে পয়সা দেয় তার হাতে। কোন সমাজে সেটা সরকারের হাতে, কোন সমাজে বড় বড় কোম্পানির হাতে। নিজের পকেট থেকে পয়সা খরচ করে বেশি দিন ভেসে থাকা যায় না। তাছাড়া সামাজিক সাইকোলজি বোঝার জন্য যে সাইকোলজির উপর বই পড়তে হবে তার কোন মানে নেই। ভালো ভালো গল্প উপন্যাস পড়েও সেটা জানা যায়। বরং সেসব বই পড়লে সামাজিক অবস্থা আরও ভালো ভাবে জানা যায়।
তুমি তাই বুঝি দস্তইয়েফস্কি, তালস্তোই এদের বই পড়!
অনেকটা সেরকমই। লেনিন বলেছেন, তালস্তোই রুশ বিপ্লবের আয়না। কথাটা কিন্তু মিথ্যা নয়। কালজয়ী লেখকেরা সমাজের নাড়ীনক্ষত্র খুব ভালভাবে বোঝেন আর তাই তাঁদের যে বর্ণনা সেটা শুধু গল্পই নয়, সেটা সমাজের ডায়াগনোসিস। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল সেটা শুধু তাঁদের সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের মৃত্যুর বহু যুগ পরেও তাঁদের লেখা প্রাসঙ্গিক থাকে। আর এ কারণেই তাঁদের লেখা কালজয়ী।
এরপর আমি আমার পড়ায় মন দিলাম, সেভা ওর বই পড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে বলল
বইটা যতটা ভেবেছিলাম ততটা ভালো নয়। অনেক আবোল তাবোল লিখেছে।
কেন এমন বলছিস?
এই দেখ না লিখেছে যদি কেউ রেগে গিয়ে হাতে কোন শস্য নেয়, তার রাগ ঐ শস্যে চলে যায়। এসব কথার কোন ভিত্তি নেই।
প্রথমত শেষ পর্যন্ত বইটা পড়, তারপর মন্তব্য কর। হয়তো এর পেছনে কোন যুক্তি প্রমাণ আছে।
উনি বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা লিখেছেন।
দেখ, যখন বাবুশকারা মানে দিদিমারা শসা টম্যাটো এসব বুনে তারা সেই বীজগুলো অনেকক্ষণ হাতে রাখে, ভালবেসে নাড়াচাড়া করে। আসলে মহাবিশ্বে সব কিছুই শক্তির বিভিন্ন রুপান্তর। বস্তু যেমন শক্তিতে পরিণত হয়, শক্তিও বস্তুতে পরিণত হয়। কারও সাথে কথা বলে আমাদের ভালো লাগে, কারও সাথে কথা বলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। শব্দ এটাও তরঙ্গ, শক্তি। সেটা যদি হয় রাগই বা কেন স্থানান্তরিত করা যাবে না? তাছাড়া যেকোনো বইয়ে অনেক কিছুই লেখা থাকে। তার যে প্রতিটি বাক্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য হবে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন লেখক নিজের মত করে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে। এটাই একজন লেখককে সফল করে, আরেকজনকে করে ব্যর্থ। তবে প্রায় সব কিছু থেকেই কিছু না কিছু শেখা যায়। পড়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল যা পড়লি সেটা সঠিক ভাবে ইন্টারপ্রেট করা। আর সঠিক ভাবে ইন্টারপ্রেশন করার জন্য দরকার বিভিন্ন বিষয়ে জানা আর খোলা মন।
জানা না হয় বুঝলাম কিন্তু খোলা মন কেন?
দেখ, সবাই যে আমাদের পছন্দ মত লিখবে তাঁর কোন মানে নেই। যদি মন খোলা না থাকে আমরা সেসব আমাদের সাথে যায় সেটাকে ভালো বলব আর যেটা যায় না সেটা খারাপ বলব। যেটা আমার জন্য ভালো সেটাই যে একমাত্র ভালো তা কিন্তু নয়। ধর একজন আপেল পছন্দ করে কিন্তু কলা দুই চোক্ষে দেখাতে পারে না। তার মানে তো এই নয় যে কলা খারাপ। অপন্দ অপছন্দ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এমনকি ভালোমন্দও। তাই এসব ব্যাপারে ক্যাটাগরিক্যাল হতে নেই। তাহলে অযথা তর্ক করে সময় নষ্ট হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।  অনেক লোকজনকে দেখবি ধর্ম নিয়ে তর্ক করতে। ধার্মিক না আস্তিক, ঈশ্বর আছে কি নেই – এটাই যেন সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঐ যে কোন এক সময় কার্ল মার্ক্স ধর্মকে অপিউম বলে গেছেন এখন সেই বাক্যই অনেককে অপিউমের নেশায় বুঁদ করে রেখেছে। অথচ এটা না করে তারা যদি মানুষে মানুষে সমতার জন্য কাজ করত তাহলে পৃথিবী অনেক এগিয়ে যেত। যে লোকের পেটে ভাত নেই ঈশ্বর থাকা না থাকায় তার কিছুই যায় আসে না। অথচ এসব বিতর্ক অনায়াসে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়।
তার মানে কি, কেউ যদি উল্টাপাল্টা কথা বলে সেটা মেনে নেব?
না। অবশ্যই প্রয়োজনে নিজের মতামত বলতে হবে, যেসব বিষয় প্রমাণ করা যায় সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সোচ্চার হতে হবে। কিন্তু যেখানে যুক্তি নেই, আছে শুধুই বিশ্বাস – সেসব বিষয়ে তর্ক করে সময় নষ্ট করা একেবারেই অর্থহীন। যাকগে, আমাকে উঠতে হবে। ক্লাসে যেতে হবে। পরে সময় করে এ নিয়ে কথা বলব।
ঠিক আছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা(১০৭): সমাজতন্ত্রের গল্প -বিজন সাহা

এরপর আর এ বিষয়ে সেভার সাথে কথা হয়নি। হয়েছে সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত আমল নিয়ে। পরে কোন এক সময় এ নিয়ে বলব। কিন্তু ঐ বইয়ের কথায় মনে পড়ে গেল অন্য এক গল্প। আসলে গল্প নয় – বাস্তব কাহিনী যা কোন এক বইয়ের গল্পের সাথে হুবহু মিলে যায়।

আজ যখন বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকাই আমার ছোটবেলায় পড়া বিভিন্ন গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। এক সময় যেসব দেশ বা নেতাদের মত হত গণতন্ত্র, মানবতা ইত্যাদির ধারক ও বাহক আজ তারাই মনে হয় সেসব ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটা মনে হয় যেকোনো সাম্রাজ্যের নিয়ম। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটা লেখা পড়লাম। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে ইন্টারেস্টিং। আরব আমিরাতের বাদশহকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন তাঁর দেশের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি বললেন, তাঁর পিতামহ উটে যাতায়াত করতেন, তাঁর পিতা এক মারসিডিজে, তিনি রোলস রয়েসে, তাঁর ছেলে হয়তো বিমানে যাতায়াত করবে তবে তাঁর নাতি আবার উটে চড়বে। কেননা যারা সৃষ্টি করে তারা কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়, আর যারা না চাইতেই সবকিছু পায় তারা ধ্বংস করা ছাড়া  আর কিছু পারে না। আসলে কথাটার মধ্যে সত্য আছে। যেকোনো ডাইনাস্টির দিকে তাকালে আমরা সেটাই দেখব। প্রথম দিকের শাসকেরা তিলে তিলে রাজ্য গড়ে তোলেন আর একটা সময় থেকে শুরু হয় পতন। মানবজীবনেও  তাই। যে শিশু এক সময় ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে একটা সময় পরে সেই সবল মানুষটাই বার্ধক্যের ভারে নুইয়ে পড়ে।

কয়েক দশক আগেও মনে হত গনতন্ত্রই মুক্তির একমাত্র পথ। হয়তো বা তাই। কিন্তু এর ধারক বাহকেরা যখন মিসাইলের ডগায় গণতন্ত্রকে বসিয়ে দেশে দেশে রফতানি শুরু করেছে তখনই গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে। আজ আমরা যা দেখি সেটা আসলে আমাদের মনের ভ্রম অথবা সত্যকে স্বীকার করার অপারগতা। বুশ, ক্লিনটন, ওবামা, বাইডেন যখন গণতন্ত্রের পুরোহিত আর জনসন, শোলজ, জেলেনস্কি যখন তাঁদের চ্যালা – তখন গণতন্ত্র, মানবতা এসব পালিয়ে যায়।

আমাদের ছোটবেলায় সাধারণত মা আমাদের বই পড়ে অথবা শাস্ত্র পাঠ করে শোনাতেন। কখনও এমনিতেই গল্প করতেন। এসব মুখস্ত গল্পকে আমরা বলতাম শাস্তর। আমাদের বাচ্চাদের ছোটবেলায় আমি আর গুলিয়া দুজনেই ওদের বই পড়ে শোনাতাম। গুলিয়া সাধারণত ইতিহাসের উপর বিভিন্ন বই পড়ত, আমি বাচ্চাদের বই। সেসব গল্পের একটা ছিল রাজার নতুন পোশাক। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখা। রাজা নতুন পোশাক তৈরি করতে চান, এমন পোশাক যা কেউ কোনদিন দেখেনি। কিন্তু কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না। এমন সময় দুই টাউট জড়ো হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে এসেছে পোশাকের ট্রায়াল দিতে। রাজা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শরীর থেকে সব পোশাক খুলে নেয়া হয়েছে আর এই দুই টাউট রাজাকে পোশাক পরাচ্ছে, এমন পোশাক যে কেউ সেটা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ভয়ে সবাই সেই পোশাকের প্রশংসা করছে। এমন সময় এক বাচ্চা, যার কোন ভয় নেই, নেই পদের লোভ, বলে উঠলো রাজা দেখছি ন্যাংটো। এই গল্প আমার মনে পড়ল বর্তমান বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের পরিস্থিত দেখে।

আমরা এক অদ্ভুত সময়ে বাস করছি, বাস করছি অদ্ভুত এক জগতে যেখানে বাস্তবতার চেয়ে স্বপ্নই যেন অনেক বেশি বাস্তব। এই জগৎ শাসন করছে উলঙ্গ এক রাজা কিন্তু সবাই তাঁর মহামূল্যবান পোশাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কোন শিশু নেই সেই রাজ্যে যে তাঁর স্বভাবসুলভ সরলতায় বলবে দেখ দেখ এ তো ন্যাংটো রাজা। শিশু থাকবে কি করে? এখানে আর কেউ কোন মানুষের জন্ম দান করে না, করতে দেয়া হয় না। নতুন যুগের নতুন ফ্যাশনে সবাই এখানে ব্যস্ত নিজেদের উপর বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করতে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো