মতামত

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন?

-অধ্যাপক এম এম আকাশ

-শেষ পর্ব-

বর্তমানে তাই বাংলাদেশে কর্মসন্ধানী বেকার-অর্থ বেকারের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। এটা কর্মরত শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। কৃষি মজুরি যে কিছুটা বেড়েছিল তা কমে যেতে শুরু করবে বলেই মনে হয়। শুধু নারী শ্রমিকদের শ্রমবাহিনীতে যোগদান নয়, কৃষিতে যান্ত্রীকীকরণের কারণে শ্রমিকের চাহিদা কমার জন্যেও মজুরির উপর নিস্নচাপ বাড়বে বলে মনে হয়।

বিশ্ব মন্দার কারণে, জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে, আন্তর্জাতিক মুদ্রাস্কীতির কারণে, ডলারের অভাবের কারণে বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই বিনিয়োগ কমেছে। সরকারের বিনিয়োগও কমেছে ব্যাক্তিগত বিনিয়োগও কমেছে। এতে অনেক জায়গাতেই শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এটাও শ্রমিকদের জন্য কর্মসংকট ও মজুরি সংকট উভয়ই সৃষ্টি করছে।

বিদেশে যে শ্রমিকরা গিয়েছিলেন আগে অন্তত তারা তাদের ডলারটা দেশেই পাঠাতেন। এখন তা সরকারি চ্যানেলে বিনিময় হার বাইরের তুলনায় কম বলে আর সেটা তারা দেশে পাঠাচ্ছেন না। আর যেসব ধনীদের হাতে উদ্বৃত্ত  টাকা জমা হয়েছে তারা সবসময়ই সেটা বিদেশে ব্যয় করা বা বিনিয়োগ করাতেই (ছেলে মেয়েদের বিদেশে শিক্ষা বা দ্বৈত নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য বিদেশে বিনিয়োগ বা করা ফাঁকি দিয়ে অবৈধ টাকা বৈধ করার জন্য বিদেশে পাচার, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে টাকা পাচার ইত্যাদি)। বেশি আগ্রহী ছিলেন, এখন এসব প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বড়ো হাউসগুলিও এখন নিজেদের উদ্বৃত্ত কোটি কোটি টাকা ডলারে রুপান্তরিত করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। এসবের নীট ফল হচ্ছে টাকার মূল্যবান ডলারের তুলনায় কমছে, প্রয়োজনীয় আমদানি আমরা করতে পারছি না এবং তার ফলে Food and Fuel সংকট সৃষ্টির আশস্কা দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগ কম হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান কন হচ্ছে। শ্রমিকশ্রেণি আরো বিপদে পড়ছে।

বর্তমানে করণীয়

শ্রমিকশ্রেণির জন্য সর্বপ্রথম দরকার তাদের বেঁচে থাকা। তাই সারাদেশে শ্রমিক শ্রেণির জন্য নূন্যতম খাদ্য ও থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যদি নূন্যতম নগদ মজুরির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে সরকারকেই “গৃহায়ন” কর্মসূচি এবং “রেশন” বা “খাদ্য অধিকার” আইন প্রণয়ন করে তার বস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এক জরিপে দেখা যায় পোশাক শিল্পে ৭০ শতাংশ কারখানার পক্ষে উল্লিখিত ২০ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি প্রদান সম্ভব। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে সকল দলের সকল শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে গণিত SKOP-এর পক্ষ থেকেও এটাকেই National Minimum Wage ঘোষণার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটা মানলে শ্রমিকদের মধ্যে এই নির্বাচনি বছরে সরকারের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পাবে।

আইএমএফ বা বিদেশিদের কাছ থেকে  ঋণ নেয়ার সময় শর্তগুলি ভালো করে বিবেচনা করে দেখা দরকার। নির্বিচার বিরাষ্ট্রীকরণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি না করে অপ্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি করা, ছোটো ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, টাকার বিনিময়ে হারকে অত্যাধিক অবমূল্যায়ন করে Food and fuel-এর মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বি করা, ইত্যাদি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যত চাপই থাকুক সরকারের তাতে আত্মসমপণ করা যাবে না। অবশ্য এই চাপ কতটুকু তা বোঝা যাবে আগামী জানুয়ারিতে।

প্রয়োজন হলে বাংলাদেশকে সংকটকালে BRICS এবং/অথবা A II B এর কাছ থকে ঋণের জন্য আবেদন করতে হবে। নিদেনপক্ষে তুলনামূলক বিচার ও দরকষাকষির জন্য যেকোনো দেশপ্রেমিক সরকারের তাই করা উচিৎ। তাছাড়া শ্রীলংকার মতো আমাদের এখনো দেউলিয়াত্ব দেখা দেয়নি। তবে প্রয়োজনীয় গণমুখী সংস্কারগুলো দ্রুত না করতে পারলে আমরা অচিরেই বিপদগ্রস্ত হবো।

তবে শেষ কথা হচ্ছে সম্পত্তিবানদের যে ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামো রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নিয়েছে এবং আমাদেরকে আজ এই তীব্র সংকটে ফেলেছে সেখানে নতুন বিকল্প শক্তিকে ধীরে ধীরে নিয়ে আসতে হবে এবং তারাও যাতে লোভে পরে নষ্ট হয়ে না যায় সে জন্য সর্বত্র বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও সুশাসন নিশ্চিতকারী ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত ও শক্তভাবে নির্মাণ করতে হবে। সে জন্য শ্রেণি সচেতন শ্রমিকশ্রেণিকেই সুসংগঠিতভাবে বৈষম্য মুক্তি ও সুশাসনের জন্য অন্যান্য ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।

– সমাপ্ত –

(প্রবন্ধটি বিগত ১৮ নভেমবর ‘২২ তারিখে টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয়েছে)

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ