শিল্প সাহিত্য

উপমহাদেশের খ্যাতিমান ইতিহাস গবেষক ড. আবদুল করিম স্মরণে

-আলমগীর মোহাম্মদ

প্রফেসর ড. আবদুল করিম (ফাইল ছবি)

“একজন জ্যোতির্বিদ ( শিক্ষক) তোমার সাথে মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর অর্জিত বিদ্যা নিয়ে কথা বলতে পারবেন, কিন্তু তোমাকে সেই বিদ্যা দান করতে পারবেন না।” উপরের কোটেশন দিয়ে শুরু করা যাক প্রফেসর ড. আবদুল করিমকে নিয়ে আমাদের আলাপ। শিক্ষক হিসেবে আবদুল করিম ছিলেন আসলেই একজন জ্যৈতির্বিদ। তাঁর জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে উপমহাদেশে জুড়ে। প্রফেসর আবদুল করিম একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, গুণী শিক্ষক ও পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৯২৮ সালের ১ জুন চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার চাঁপাছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ইতিহাস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে যোগ দেন৷ পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ড. আবদুল করিম সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর কথা হলো, স্যার জানতেন প্রশাসন ও পড়াশোনা দুটো কিভাবে একসাথে চালিয়ে নেওয়া যায়। গবেষক হিসেবে তিনি উচ্চমার্গের, শিক্ষক হিসেবে অনুসরণযোগ্য। শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন,” চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, প্রথম হল আলাওল হলের প্রভোস্ট, দু’দফায় আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন এবং সুদীর্ঘ ছয় বছর উপাচার্যের দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন ঈর্ষনীয় দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সাথে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ”

গবেষণা, শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে স্যার দৃঢ়তা ও সফলতার ছাপ রাখতে পেরেছিলেন কারণ তাঁকে পদপবীর জন্য কোন নেতার বারান্দায় বসে থাকতে হয়নি। স্যারের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব-ই তাঁকে মর্যাদার আসনে নিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর কৃতী ছাত্রদেরকে সহকর্মী হিসেবে নিয়ে আসতেন তিনি। অবশ্যই সেকালে একটা রেওয়াজ ছিল এমন যে বিভাগের কৃতী ছাত্রদেরকে শিক্ষকরা ডেকে চাকরি দিতেন। বর্তমানে যা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ও পরে সহকর্মী মোকাদ্দেসুর রহমান ” করিম স্যার ঃ কাছ থেকে দেখা ” শিরোনামে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ

“প্রাক্তন ছাত্র, এখন নবীন সহকর্মী – সে এক অন্যরকম অনুভূতি। তবে ছাত্র জীবনের ভয়ভীতি বা সংকোচ কেটে যেতে সময় লাগেনি অবশ্যই এ ব্যাপারে স্যারই এগিয়ে এসেছিলেন। বিভাগীয় প্রধানের রুমে বসতে হতো আমাদেরকে কক্ষ স্বল্পতার কারণে। স্যার একদিন আমাকে সিগারেট অফার করলেন– আমি তো ভয়ে লজ্জায় আধমরা। স্যারই সাহস দিলেন, ” এখন তো আর ছাত্র নও, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার সহকর্মী। নাও সিগারেট নাও, মাঝেমধ্যে আমাকেও দিও।”

করিম স্যার লেখালেখি ও গবেষণা করতেন বাংলা ইংরেজি দুই ভাষায়। আরবী ফার্সীও ভালো জানতেন তিনি। প্রথম বার পিএইচডি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গবেষণার বিষয় ছিল বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস। দ্বিতীয়বার পিএইচডি করেন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুর্শিদ খুলী খানের উপর। গবেষণা সম্পর্কে ড. করিম এর অনুরাগের একটা উদাহরণ দেয়া যাক তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী ও শ্যালক ড. সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরীর লেখা থেকে।

“শিক্ষক সমিতির সভাপতি হয়ে যখন আমি স্যারের বাসায় গেলাম তখন তিনি মুচকি হেসে অভিবাদন করলেন। তারপর বললেন, ‘ সভাপতি হওয়ার চেয়ে তুমি একটা পাবলিকেশনের খবর নিয়ে আসলে আমি আরো খুশি হতাম।”

ড. করিমের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কুড়িটির অধিক। তাঁর আত্মজীবনী পড়ে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে স্যারের প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় দুইশো। শিক্ষায় ও গবেষণায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি দেশে বিদেশের নানা পদক ও পুরস্কার লাভ করেছেন। একুশে পদক, ইন্ডিয়ান ন্যুমিজম্যাটিক সোসাইটির আকবর রৌপ্যপদক, ড. এনামুল হক পদক, আবদুল হাই স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি স্বর্নপদক এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক ইত্যাদি।

আমাদের ছোটবেলায় দুইজন অধ্যাপকের নাম শুনেছিলাম। একজন ড. করিম, অন্যজন অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ। দুজনেরই বাড়ি বাঁশখালী। শিক্ষাক্ষেত্রে দুজন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন৷ প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রেখে গেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী ও কীর্তিমান শিক্ষক। হাটহাজারী কলেজ ও বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় ড. করিমের অবদান অনবদ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেড়ে ওঠাতে ড. করিমের অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদ তাঁর নামে নামকরণের কারণ হয়তো এটাই।

৯৫তম জন্মবার্ষিকে এই মহাপ্রাণ শিক্ষকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। খোদা তাঁকে বেহেশতবাসী করুন।

# লেখকঃ শিক্ষক, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি