বিজ্ঞান প্রযুক্তি

মহাবিশ্বের দূরতম অব্জেক্ট কোয়েজার

-অপর্ণা চক্রবর্তী

আজ আমি লিখতে চলেছি আমাদের মহাকাশের সবচে দূরের, সবচে উজ্জ্বল,সবচে রূপময় এক অবজেক্টের কথা। আমার কসমোলজী প্রিয় বন্ধুরা সবাই হয়ত এই নাম জানো, কিন্তু দুর্দান্ত রহস্যের বহুকিছুই অজানা। তবুও যতটুকু জেনেছি ততটুকু অত্যন্ত সহজ ভাবে লেখার চেস্টা করছি। ১৯৫০ দশকের থেকে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ সম্বন্ধে বহুকিছু জানার জন্য সর্বপ্রথম রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে শুরু করেন। তখন তাঁরা মহাকাশে কিছু অদ্ভুত অবজেক্ট দেখতে পান। সেই অবজেক্ট গুলো থেকে উচ্চমাত্রার রেডিও ওয়েভ আসছিল। তখন সেই অবজেক্ট গুলো সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণাই ছিল না। যেহেতু রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের দেখতে পাওয়া গ্যাছিলো তাই তাদের নাম দেয়া হয় Quaisi–stellar– radio–sources ! এই সোর্সের পরবর্তী তথ্য পেতে আরো একযুগ সময় লেগে যায়। যাদের আমরা এখন “কোয়েজার ” বলে জানি। প্রথম আবিষ্কৃত কোয়েজারের নাম 3C 273। আমরা জানি কোয়েজার হলো সক্রিয় গ্যালাক্সীর কেন্দ্র। যাকে বলে এক্টিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াস। আমরা জানি প্রত্যেকটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল, যাদের ভর আমাদের সূর্যের ভরের লক্ষ থেকে কোটি গুন। এই ব্ল্যাকহোলের চারপাশের ম্যাটার ব্ল্যাকহোলে পতিত হবার আগে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে উচ্চগতিতে ঘুরতে থাকে। এইভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা ম্যাটারগুলোকে বলে অ্যাক্রিয়েশান ডিস্ক। এই অ্যাক্রিয়েশান ডিস্কের আকার মোটামুটি আমাদের সৌরজগতের আকারের সমান। অ্যাক্রিয়েশান ডিস্কের পার্টিক্যাল উচ্চগতিতে ঘোরার ফলে তাদের সংঘর্ষ হয়, আর পার্টিক্যাল উত্তপ্ত হতে থাকে ফলে প্রচুর পরিমানে এনার্জি নির্গত হয় আর তাই পার্টিক্যালগুলো খুব উজ্জ্বল দেখায়। এই ধরণের অত্যন্ত উজ্জ্বল বিষয়টিকেই বলা হয় কোয়েজার। তার মানে কোয়েজার হলো গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল আর তার চারপাশের অ্যাক্রিয়েশান ডিস্ক।

কোয়েজারের আরেকটি আশ্চর্য দিক হলো এর দুইপাশে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন জেটস। এই জেটস অ্যাক্রিয়েশান ডিস্কের লম্ব বরাবর অবস্থান করে। অ্যাক্রিয়েশান ডিস্কের পার্টিক্যাল যখন উচ্চগতিতে ঘুরতে থাকে তখন সংঘর্ষের কারণে তারা চার্জ প্রাপ্ত হয়। তার ফলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড এমনভাবে টুইস্ট হয় যে তার ফলে এই জেটস তৈরি হয়। এই জেটসের মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে পার্টিক্যাল প্রায় আলোর গতিতে বহুদূরে ছিটকে যায়। এই যে পার্টিক্যালগুলো ছিটকে যাচ্ছে তারা কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে আসে না, তারা আসে অ্যাক্রিয়েশান ডিস্ক থেকে। কোয়েজারগুলো কিন্তু কাছাকাছি দেখা যায় না। এরা বহু বহু দূরে অবস্থান করে। সকল কোয়েজার গুলোই বিশাল বিশাল দূরত্বে অবস্থান করে, তার কারণ হলো এগুলো বিগব্যাং এর পরবর্তী সময়ের অবজেক্ট। কোয়েজার যেহেতু বহুদূরে অবস্থান করে তাই তাদেরকে দেখা মানে আমরা সদ্য মহাবিশ্বের কাছাকাছি সময়কে দেখছি। কিছু আরলি ইউনিভার্সের কোয়েজারের চারপাশে হাজার হাজার আলোকবর্ষব্যাপী ধোঁয়া ধুলোর আবরণ থাকে যা কোয়েজারের কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলকে সুরক্ষিত রাখে। কোয়েজার নানারকমের হয়। সেটা নির্ভর করে তার আলো কীভাবে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। কোয়েজার হতে পারে রেডিও কোয়েজার, ইনফ্রারেড কোয়েজার, এক্সরে কোয়েজার। তারমানে রেডিও কোয়েজার দেখতে লাগবে রেডিও টেলিস্কোপ, ইনফ্রারেড কোয়েজার দেখতে লাগবে ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ এরকম। আমরা খালি চোখে কোয়েজার কখনোই দেখতে পাবো না, তাদের এত উজ্জ্বলতা সত্বেও। কারণ বিশাল দূরে রয়েছে তারা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানীরা কোয়েজার আইডেন্টিফাই করেন কীভাবে।

পড়ুন:  মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডার সংঘর্ষ নাকি মহামিলন!! - অপর্ণা চক্রবর্তী

এটা করা হয় পারমাণবিক বর্ণালী বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে। আকাশে নক্ষত্র খুব উজ্জ্বল, উজ্জ্বল কোয়েজারও। কিন্তু বর্ণালী বিশ্লেষণে নক্ষত্রের বেলায় শোষিত আলোর পরিমাণ দেখে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রকে চিনতে পারেন। যেহেতু কোয়েজার অত্যন্ত উত্তপ্ত তাই তার আলোর বিশ্লেষনে ইনিশিয়াল লাইট দেখা যায়। দ্বিতীয় হলো, কোয়েজার যেহেতু বহু বহু দূরে অবস্থান করে তাই তারা দ্রুতই দূরে সরে যাচ্ছে আর তাদের রেড শিফটের মানও খুব বেশি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের যে কোয়েজার দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা তা আমাদের থেকে ১২.৮ বিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে অবস্থান করছে। তার মানে বিগব্যাং এর মাত্র এক বিলিয়ন বছর পরের অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যতদূর আমরা দেখি ততই অতীত দেখি। হয়ত যেসব কোয়েজার আমরা দেখছি তারা অনেকেই এর মাঝেই বিলীন হয়ে গ্যাছে, কিন্তু তাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোয়েজারই কাছাকাছি দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ আগেই বলেছি কোয়েজার বিগব্যাং এর কাছাকাছি সময়ের অবজেক্ট। সবচে উজ্জ্বল কোয়েজার আমাদের সূর্য থেকে ৬০০ ট্রিলিয়ন গুন উজ্জ্বল। এক ট্রিলিয়ন = এক লক্ষ কোটি। হিসেব করো এখন। আকাশের সবচে উজ্জ্বল, সবচে দূরতম, সবচে সুন্দর অবজেক্টের নাম “কোয়েজার” অনেক অল্প করে লিখলাম এক বিশালতার কথা। ছবি নেট থেকে নেয়া।

লেখক পরিচিতি  – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।