বিজ্ঞান প্রযুক্তি

মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডার সংঘর্ষ নাকি মহামিলন!!

– অপর্ণা চক্রবর্তী

১৯২৯ সালে এডুইন হাবলের অব্জারভেশনের মাধ্যমে প্রথম জানতে পারি আমাদের এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। আর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একা নয়, এর বাইরে রয়েছে এমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি। আমাদের প্রথমেই যে বিষয়ে জানা দরকার যে এই মহাবিশ্ব র সূচনা হয়েছে বিগব্যাং এর মাধ্যমে। বিগব্যাং এর আগে স্পেস বা টাইম কিচ্ছু ছিল না। সেই সময় থেকে আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে এবং সেই প্রসারণ এখন অকল্পনীয় আকার ধারণ করেছে। স্পেস এমন এক বিষয়, যা প্রসারিত হতে পারে,সংকুচিত হতে পারে এবং নানা কারণে বেঁকে যেতে পারে। এখন চলছে স্পেসের প্রসারণ। আমরা যদি বড় স্কেলে আমাদের মহাবিশ্ব কে দেখি, তবে আমরা তাকে ফ্লুইড বা তরলের মত দেখব। আলাদা আলাদা করে গ্যালাক্সিদের আর দেখা যাবে না। যেমন যখন আমরা নদী বা সমুদ্রের জল দেখি তখন আলাদা করে জলের অনু কে দেখতে পাই না। ঠিক তেমনি। এখন এই ক্রমাগত প্রসারিত মহাবিশ্বের ডেনসিটি বা ঘনত্ব কমে যাচ্ছে প্রসারণের ফলে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের চারপাশ দেখি তখন কিন্তু এটা বোঝা সম্ভব হয় না যে, কোন বস্তু স্পেসের প্রসারণের ফলে দূরে চলে যাচ্ছে, বা সংকুচিত হচ্ছে, তাহলে বিজ্ঞানীরা কেন বলছেন স্পেস প্রসারিত হচ্ছে?আর তাই যদি হবে তবে মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা কেন পরস্পর কাছাকাছি আসছে? আসলে অনেক অনেক দূরে থাকা নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিটি কত বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। যে বস্তু আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে যতদূরে তার দূরে সরে যাবার অনুপাত কাছের বস্তু থেকে ততবেশি। একে বলে রেড শিফট।

দূরের বস্তুর দূরত্ব বেশি, মানে স্পেস বেশি মানে তার সরে যাওয়ার গতিও তত বেশি। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে ১০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি ২২০০ কিমি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি ২৩০০০ কিমি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। আরো দূরের গ্যালাক্সি আরো বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে, এবং একটা সময় আলোর বেগের চেয়েও বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। তখন আর ওই গ্যালাক্সি গুলোকে আমরা দেখতে পাইনা অব্জারভেবল ইউনিভার্সে। তখন শুধু দেখি কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি। এখন প্রশ্ন হলো, সব দূরে দূরে সরে যাচ্ছে তাহলে মিল্কিওয়ে আর অ্যাএন্ড্রোমিডা কাছাকাছি আসছে কেন? এর উত্তর জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে, দুটো বস্তু স্পেসের প্রসারণে দূরত্ব অনুযায়ী দূরে সরে যায় কিন্তু তাদের খুব অল্প দূরত্বে যখন ভর থাকে তখন সেখানে গ্র‍্যাভিটি বা মহাকর্ষ হয় খুব শক্তিশালী। মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব মাত্র ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ। স্পেসের প্রসারণে তারা দুজন থেকে দুজন দূরে সরে যাচ্ছে সেকেন্ডে ৬০ কিলোমিটার, আর মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছাকাছি আসছে ১৭০ কিলোমিটার/সেকেন্ড। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে তারা ১১০ কিলোমিটার বেগে কাছাকাছি আসছে।

পড়ুন:  ভয়েজার,এক বিস্ময়কর স্পেসক্রাফটের আশ্চর্য যাত্রা! -অপর্ণা চক্রবর্তী

মাধাকর্ষনের টান স্পেসের প্রসারণের চেয়েও বেশি কাছের বস্তুদের মাঝে। আর এই কারণেই ইউনিভার্সের কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি আকারে বড় হয়ে যায় না। স্পেসের প্রসারণ আর মহাকর্ষের টান তাদের স্টেবল রাখে। প্রশ্ন করতে পারো, স্পেস প্রসারিত হচ্ছে কীভাবে? কই পাচ্ছে এই অভাবনীয় শক্তি? এর উত্তর ডার্ক এনার্জি। যার ব্যাখ্যা আপাতত নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। এই যে মিল্কিওয়ে আর অ্যাএন্ড্রোমিডা কাছাকাছি আসছে, বিশাল সংঘর্ষ হবে। এমন ভাবছি, আসলে এই ইউনিভার্সে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের এই গ্যালাক্সি গুলো কয়েকটি মিলে একটা গ্রুপ, এদের বলে লোকাল গ্রুপ। এটা সারা ইউনিভার্সেই তাই। এই গ্রুপ ছড়িয়ে আছে ৫ কোটি আলোকবর্ষ ব্যাপি। এই গ্রুপের সবচে বড় গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডা, তারপর মিল্কিওয়ে তারপর ট্রায়াংগুলাম গ্যালাক্সি। ২০২০ র অব্জারভেশন অনুযায়ী, মিল্কিওয়ে কে আবর্তন করছে ৫৯ টি ডট বা বামুন গ্যালাক্সি, অ্যান্ড্রোমিডাকে ২৪ টি আর ট্রায়াংগুলাম কে ১ টি বামুন গ্যালাক্সি। এছাড়া আমাদের লোকাল গ্রুপে আরো গ্যালাক্সি আছে যারা এদের আবর্তন করছে না।আবার এই পুরো গ্রুপ ছুটছে ভার্গো ক্লাস্টারের দিকে। আবার ভার্গোক্লাস্টার ছুটছে লানিকেয়া র দিকে। একে বলে গ্রেট এট্রাক্টর। আগামীতে এরা সবাই মিলে যাবে, এটাই এর সারমর্ম। এখন বলি, মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা র সংঘর্ষ হলে কি হবে? আসলে দুটো গ্যালাক্সি মিলে একটি বিশাল উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি হবে। সংঘর্ষ না বলে বলি মহামিলন।ধরো তোমার কাছে ৫০ টি বল রয়েছে, তারা একটি থেকে আরেকটি ১০ কিলোমিটার দূরে দূরে। উল্টোদিক থেকে যদি ৫০ টি বল ছুঁড়ে মারো, তাতে কি সংঘর্ষের সম্ভাবনা আছে? একেবেরেই শূন্য সেই সম্ভাবনা। তবে একটি নক্ষত্রের উপর অন্য নক্ষত্রের গ্যাসীয় প্রভাব পড়তেই পারে। আর ততদিনে আমাদের সূর্য তার সকল হাইড্রোজেন পুড়িয়ে ফেলবে। লাল দানবে পরিণত হবে। পৃথিবীতে জল থাকবে না, মানে জীবন ও থাকবে না সম্ভবত। বলতে চেয়েছি দুই গ্যালাক্সির মিলনের কথা। কতটুকু বোঝাতে পেরেছি জানিনা। তোমরা বুঝতে পারলে আমার লেখা সার্থক

হবে।

লেখক পরিচিতি  – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।