মতামত শিল্প সাহিত্য

সাহিত্য পড়া

-প্রভাত ঘোষ

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পাঠচক্রের এক নিয়মিত পাঠিকা “ট্রেজার আইল্যান্ড” বইটি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। অভিযোগ –“বাচ্চাদের বই”। বললাম, “আপা বইটি বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং গত শতাব্দীর সেরা শত বইয়ের তালিকাভুক্ত। সাথে সাথে এক ঝটকায় বইটি ফিরিয়ে ইস্যু করিয়ে নিলেন।  মনে হল ইন্টার ক্লাসের বেরসিক ‘Reading for pleasure’ প্রবন্ধটি পাঠচক্রে আবার পরানো উচিত। কারন আমরা বেশির ভাগই বুঝতে পারছিনা কি বই পড়বো, কিভাবে পড়বো, কেনই বা পড়বো?

চারপাশে অনেকেই বই পড়ছেন। পাঠচক্রের সমন্বয়কারী হিসাবে “কেন পড়ছি আমরা এসব বই, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের রূপকথার মত বাচ্চাদের বই” –এরকম হাজারো প্রশ্ন; সময় স্বল্পতায় যখন সবগুলো উত্তর দেয়া যায় না, তখন অনেকেই বিক্ষুদ্ধ চিত্তে বাড়ি ফেরেন। বইয়ের টানে আবার ফিরে আসেন। আবারও ব্যাথিত, বিক্ষুদ্ধ হন।

সকলের আক্ষেপ মেটানো আমার কম্ম নয়। আমি বলতে পারি নিজের কথা। উচ্চকিত স্বরে Nonsense rhyme আওড়াতে আমার ভাল লাগে। এগুলোর ঐতিহাসিক অর্থময়তায় আলোড়িত হই। বোঝা না বোঝার অনন্ত কৌতুহল, নেশা। ধরা যাক –Humpty Dumpty ছড়াটা। ছড়াটার শেষ দিকটাতে আছে –‘All the king’s houses and all the king’s men, couldn’t put humpty to-gether again’. ছড়াটির গঠনশৈলী বলে এটা centerbury rhymes’র পরের দিককার। যখন রাজতন্ত্রের সাথে ধর্মতন্ত্রের ধুন্দুমার লেগে গেছে ইংরেজ ভূমিতে। Church তার সম্পদ আর ক্ষমতা হারাচ্ছে। ঠিক তেমনই সময় পার্থিব রাজাদের সীমায়ত ক্ষমতা ক্ষমতার দিকে কোন বিশ্বাসী ছড়াকারের ইঙ্গিত নয়তো ছড়াটা? ভাবুন তো? যে Humpty’ জন্য আমার আপনার বুক কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়, সেই Humptyকে বাঁচাতে গেল রাজার ধ্বজাধারীর। কোন ঈশ্বর প্রতিনিধি বা সাধারণ মানুষ দৃশ্যপটে নেই। আর আছে রাজার সীমাবদ্ধতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। যখন রাজা স্বয়ং Head of the church বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এই Nonsense rhyme আমার কাছে এখন অপরিসীম ভাবনার খোরাক হয়ে ধরা দেয়। আমি এই সময়ের জন্য ছড়াগুলো খুঁজি। সময়টাকে ধরতে চাই। তাই সাহিত্য পড়ার অন্যতম লক্ষ্য সময়টাকে ধরা, অন্যভাবে, অন্য নান্দনিকতায়।

বিদেশ থেকে এবার দেশে আসি। আমাদের অতি পরিচিত হারাধনের দশ ছেলের ছড়াটার কথা ধরা যাক। অতি পুরাতন এই ছড়াটাতে আছে এক সময়কার বাংলার হতচ্ছড়া সমাজচিত্র। সমাজের প্রতিটি পরতে যখন দারিদ্র, জীবন-চেতনার মৃত্যু ঘটছে অর্থহীনভাবে। ফিরে যান দু-তিনশ বছর আগের কোম্পানীর শাসনামলে। আমাদের দারিদ্রক্লিষ্ট, কুসংস্কারচ্ছন্ন, শিক্ষাহীন বাংলায় হারাধনের দশ ছেলে হারানোর গল্প কি অর্থহীন মনে হবে? ঐ সময় পরিবারে জন্ম নিচ্ছে বহু সন্তান, ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত মানুষ -এই সময়ই বাংলার জনপদে ঘুরছে ঠগী; বহুরূপে। লক্ষ্য করুন পয়ার ছন্দে লেখা ছড়াটি কি বিষন্ন আবহ তৈরি করে না একটু ধীর পঠনে। অতীতের এই ছড়াটি কি বিশুদ্ধ ইতিহাস বার্তা নিয়ে হাজির হয় না একটু সচেতন হলেই? তাই আমার সাহিত্য পাঠে ছেলে ভুলানো ছড়া Non sense rhymeও অমূল্য সম্পদ।

অতীতের সাহিত্য কর্ম থেকে সময়টাকে ধরতে চাইলেই কি ধরা দেয়, তার জন্য ভাবাতে হয়। নিজেকে ইতিহাসের অলিতে গলিতে ঘুরতে হয় ক্লান্তিহীন নাবিকের মত। সাহিত্যেতো গল্প থাকে। তাই বলে একি শুধুই গল্প। এরিস্টোটালের ভাষায় ‘মহত্তর কল্যাণকর মিথ্যে’, বিবেক জাগানিয়া টনিক। গল্পটা হয়তো সত্যের অবয়ব, তার সঙ্গে জড়ানো লেখকের কল্পনা। কিন্তু তা যদি হয় মহৎ সাহিত্য, তখন সে অলীকের মাঝে থাকে মহত্তর ভাবনা, দর্শন, ইতিহাস, চিরন্তন সত্য-ভাবনা।

গ্রীক সাহিত্যগুলোর দিকে তাকালে দেখবো উচ্চতর জীবনদর্শনের চিত্র এঁকেছিলেন তিন শ্রেষ্ঠ গ্রীক ট্রেজেডিকার। শুধু নিয়তির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরা নয়, তাঁরা চেয়েছেন মানুষের ন্যায়-অন্যায়বোধের ন্যায় দন্ড শক্ত করতে। কিভাবে মহত্তর জীবন অধ্যায় মুহুর্তের অসর্তকতায় হয়ে পরে কলংকিত – তা অনুভবে শিহরিত হয় পাঠক/দর্শক। তাই প্রতিটি দর্শক/পাঠককে যেন হতে হবে আরো বেশি ন্যায়-নিষ্ঠ, বৃহত্তর আদর্শের ধারক। এভাবেই হয়তো বৃহত্তর আদর্শ, দর্শন, বিবেকবোধ ঢুকে পড়ে সচেতন পাঠকের মধ্যে।

সময় এল, দর্শন এল, বিবেক-ভাবনা এল, সাহিত্য পাঠে কি লাভ করা যায় তা কি তালিকা করে বোঝানো সম্ভব? জীবনান্দের কবিতায় কি আছে? কেন পড়বো? দর্শনের জন্য, সময় ধরবার জন্য, না বিবেক ভাবনার খোরাকে? আমার তো মনে হয় অনুভবের জন্য পড়বো। সে অনুভব অনেক উচ্চ স্তরের। পাঠকের প্রতিটি ইন্দ্রিয় থাকা চাই সজাগ, তবে বোঝা যাবে সে কবিতার আনন্দ-বেদনা, ভাব। প্রকৃতি, সভ্যতা সবকিছুতেই আছে অনুভবের অনেক কিছু। আমরা মানুষ অনুভূতিপ্রবণ প্রাণী বলে বহুমাত্রায় অনুভব করতে পারি। কিন্তু চর্চার অভাবে আজ শহুরে মানুষের অনুভূতি মৃত। জীবনান্দের একটি কবিতার গভীর চর্চা আমাকে বাঁচিয়ে দেয় সেই মৃত্যুদশা থেকে।

সাহিত্য পাঠ অনেকটা জমিও কর্ষনের মত। বারংবার কর্ষনে যেমন ফলন ভালো হয়, তেমনি বারংবার পাঠে বহুমাত্রিকতা ধরা পড়ে। কবিতার ক্ষেত্রে এটা ধ্রুব সত্য। আমাদের কবিতার ক্লাসের শিক্ষক মাসুদ মাহমুদ স্যার বলতেন –‘Poetry is like numerous untied knots …….” যতই পড়বো ততই খুলবে জট। তাই সচেতন পাঠককে আগ্রহ নিয়েই বসতে হবে সাহিত্য পাঠে। সাহিত্যপাঠ তাই আরামের হলেও খুব আয়াসের নয়, বরং প্রয়াসের।

আমার এই নিরানন্দ পান্ডিত্য চর্চার শুরুতে ‘Reading for pleasure’ প্রবন্ধের কথা বলেছিলাম। সাহিত্য পাঠের কারন আনন্দ লাভ। মানুষ গত শতাব্দীর বাংলা ইতিহাসের বই না ঘাটলেও সুনীলের ‘সেইসময়’ অবলীলায় হজম করে। কারন সে ইতিহাস এসেছে সাহিত্যের হাত ধরে। তাই সাহিত্যে অনেক বাহ্যদৃষ্টিতে আনন্দহীন বিষয় আনন্দের সাথে জানা হয়ে যায় –কিন্তু সবকিছুর আগে চাই সচেতন পাঠক। যে পাঠকের খোলা চোখ আর অক্ষর জ্ঞান থাকলেই চলবে না, থাকতে অনুভূতিশীল, সংবেদনশীল মন। এই মন নিয়ে পড়া শুরু করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর সকল পাঠক পেয়ে যাবেন –কী পড়বো, কিভাবে পড়বো আর কেনই বা পড়বো। তখন এত উত্তর জমা হয়ে যাবে, উত্তরের তলায় চাপা পড়ে যাবে অনাদি উন্মেষমান  বহু প্রশ্ন।

লেখকঃ প্রভাত ঘোষ, সরকারী কর্মচারী, কমনওয়েলথ অব অস্ট্রেলিয়া; এডভোকেট, ঢাকা বার; প্রাক্তন হিউমেন রিসোর্স ম্যানাজার, এসিআই গ্রুপ।