বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন

বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারের বিরাগের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।সোমবার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘’প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু। আমি এটা অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলি যে, এরা এই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।‘’

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরাগ বা বিরোধিতার বিষয়টি অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এই মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু কেন বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকাকে ‘শত্রু’ বিবেচনা করছে দেশের সরকার?

ক্ষোভের সূচনা দেড় দশক আগে

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বড় একটি অভিযোগ, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তাতে প্রথম আলোসহ কয়েকটি দৈনিকের ভূমিকা রয়েছে।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সেই কথাও বলেছেন, ‘’২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা আদাজল খেয়ে নেমে গেল।‘’

২০০৭ সালের ১১ই জুন প্রথম আলো পত্রিকায় ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান।

সেই ক্ষোভ এখনো রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’পত্রিকার কি দায়িত্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা ঠিক করে দেয়া? দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে যেতে হবে, এটা কি কোন পত্রিকা বা সম্পাদক লিখতে পারে। এটা যখন লেখা হয়, তখন থেকেই তো তার দুরভিসন্ধি তার মনোভাব বোঝা যায়। এরপর সম্পর্ক ভালো কীভাবে আশা করা যায়?’’

প্রথম আলোর সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা বা হয়রানির অভিযোগ অবশ্য এবারই নতুন নয়।

মার্চ মাসেই স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি খবরের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি প্রকাশে অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি, বিক্ষোভ সমাবেশও করা হয়েছে। যাদের অনেকগুলোই আওয়ামী লীগ ঘরানার বলে পরিচিত।

সেসব সমাবেশ থেকে এমনকি প্রথম আলোর নিবন্ধন বাতিলেরও দাবি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোথাও কোথাও পত্রিকা এবং সম্পাদকের কুশূপুত্তলিকা পুড়িয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করছেন, শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা বা ভুল-ত্রুটি নিয়ে অনেক পত্রিকাতে বা গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হলেও সেটা নিয়ে সরকার কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

তাদের অভিযোগ, প্রথম আলো পত্রিকাটি সাংবাদিকতার বাইরে রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, তিনি প্রথম আলো পড়েন না এবং গণভবনে রাখেন না।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে কোন একটি নির্দিষ্ট সংবাদপত্র ঘিরে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারের এতোটা আপত্তি বা বিরোধিতা দেখা যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এর মধ্যেই একটি ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এর মধ্যেই একটি ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে

আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন, ‘’সরকারের ভুল-ত্রুটি থাকলে তারা সরকারের সমালোচনা করতেই পারে। এ নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি হলো যখন একটা সংবাদপত্র বা সাংবাদিক বা সম্পাদক রাজনৈতিক এজেন্ডা ঠিক করেন।‘’

‘’এটা কিন্তু পত্রিকার বা সাংবাদিকের দায়িত্ব নেই, যেটা প্রথম আলো করেছিল। কার স্বার্থে তারা এটা করেছিল? এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের কারণেই হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে,‘’ তিনি বলছেন।

২০২১ সালে এই পত্রিকার একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে রাষ্ট্রীয় নথি চুরি ও ছবি তোলার অভিযোগ তুলে সচিবালয় থেকে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছিলেন রোজিনা ইসলাম।

‘আমরা কারো শত্রু নই’

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কেন ক্ষমতাসীন দলটি এতোটা বৈরি হয়ে উঠেছে, সেই বিষয়ে প্রথম আলোর কেউ কথা বলতে চাননি। কারণ তারা চান না, এই বিষয়টি নিয়ে নতুন কোন আলোচনা হোক।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’আমরা মোটেই সরকারের শত্রু নই, আমরা আওয়ামী লীগেরও শত্রু নেই”।

মানব সূচক, অবকাঠামো, বাণিজ্য, কৃষি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি- দেশের যেসব বড় বড় উন্নতি হয়েছে, সেখানে সরকারের ভূমিকার বিষয়টি বরাবরই প্রথম আলোর খবরে উঠে এসেছে বলে পত্রিকাটির সংবাদকর্মীরা বলছেন। এসব নিয়ে অনেক সময় প্রথম আলোয় ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করা হয়েছে।

নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বলছেন, ‘’মানুষের উন্নতি আমরাও চাই, দেশের উন্নতি চাই, সেখানে দেশের অগ্রগতির মধ্যে যদি কোন চ্যালেঞ্জ দেখি, সাংবাদিকতার কর্তব্য হচ্ছে সেই চ্যালেঞ্জগুলো প্রকাশ করা। সেটা প্রকাশ করার মানে আমরা সরকারের শত্রু, এটা তো একদমই হতে পারে না। আমরাও এই দেশের জয় চাই।‘’

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি খবরের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি কোলাজ করে স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে  গ্রেপ্তার করা হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি খবরের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ব্যবহারের অসঙ্গতিকে ঘিরে পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঢাকার একাধিক গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, অনেক সময় সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হয়।

বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশের পর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা, বিজ্ঞাপন বন্ধ করাসহ নানারকম হয়রানি করার অভিযোগও উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক সময় পরোক্ষ চাপ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানগুলোয় এমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে তারা নিজেরাই সেন্সরশিপ করে।

ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সংবাদপত্র সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করে বলে তারা জানিয়েছেন।

সোমবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সন্ধ্যায় কিছু তরুণ প্রথম আলোর অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করে ভয়ভীতি দেখানো এবং ‘প্রথম আলো বয়কট’ জাতীয় শব্দ লিখে গেছে।

এই ঘটনা ঘটলেও এই বিষয়ে কোন অভিযোগ বা আইনি ব্যবস্থা নেয়নি প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ।

তবে আওয়ামী লীগের একজন নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সরকারের তরফ থেকে কোন পত্রিকাকে ভয়ভীতি দেখানো বা তাদের বিরুদ্ধে বড় কোন ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা ঘটেনি। প্রথম আলোর কার্যালয়ে হয়রানি হলে কর্তৃপক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

‘গণমাধ্যমের ভীতি আরও বাড়িয়ে দেবে’

মিডিয়া রাইটস গ্রুপগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে ২৮০ জন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস এর ২০২২ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১৬২।

গণমাধ্যম পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, দেশের অন্যতম শীর্ষ একটি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সরকারের এই খোলাখুলি অবস্থান বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে ভীতি আর সেলফ-সেন্সরশিপের প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, বাংলাদেশে ভিন্নমতকে গ্রহণ করার মতো সংস্কৃতি এখনো তৈরি হয়নি।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, ‘’সরকারগুলো চায় যে, তাদের উন্নয়ন, তাদের কাজের প্রশংসা করবে। কিন্তু সাংবাদিকতার কাজ যে ভুল ধরিয়ে দেয়া, ছিদ্রান্বেষণ করা, সেটা উপলব্ধি করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে।‘’

‘’সে ভুলত্রুটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, যাতে সেটা মেরামত করতে পারে, সংশোধন করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল, সরকার-বিরোধী দলে যেই থাকুক, এটাকে শত্রু মনে করে,‘’ তিনি বলছেন।

তিনি আশঙ্কা করছেন, পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করবে। সরকারের রোষানলের আশঙ্কায় সাংবাদিকদের মধ্যে ভয় আরও প্রবল হবে, যার ফলে সেলফ সেন্সরশিপ আরও বাড়বে।

# সূত্রঃ বিবিসি বাংলা