মতামত

একজন নির্লোভ প্রাজ্ঞ মানুষের মুখচ্ছবি

-মুহম্মদ তারিকুল ইসলাম

“বলো চায়না থেকে তাদের দেশের কোনও ডাক্তার বা নার্স কেনও বিদেশে চাকরী করতে যায়না?” বলে তিনি লিটারেলি খেকিয়ে উঠলেন। তার মুখ থেকে কিছু থুতুর ছিটা টেবিলের গ্লাসে শিশির বিন্দুর মত পড়ে রইল। আমি থতমত হয়ে বসে আছি বিশাল মিটিং রুমের এক চিপায়। আড় চোখে আমার বসের অপ্রস্তুত অসহায় থমথমে মুখটা দেখে খুব মায়া লাগছে। বিগত প্রায় ১০ মিনিট মিটিংয়ের শুরু থেকেই লেদাভেদা টাইপের এক বুড়া আমার বসরে প্রায় কান্দায়া ফেলছে। কথার থেকে ধমকান বেশী, আর প্রতিটা ধমকে ছিল অভিভাবকসুল্ভ মমতা এবং অপরিসীম দৃঢ়তা!
২০১২ সালের জুনের ঘটনা এটা। বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু স্বাস্হ্য সেবায় নতুন একটি হেল্থ ক্যাডার তৈরীতে গভর্নমেন্ট নার্সিং ইন্সটিটিউট গুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বপ্রথম প্রাইভেট ইন্সটিটিউট হিসেবে আমরাও সনামধন্য এক দাতা সংস্থার অর্থনৈতিক সহায়তায় ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারী ইডুকেশনের রেসিডেন্সিয়াল কোর্স সারা দেশব্যাপি চালু করব। তার জন্য দেশের বিভিন্ন অন্চলে মা ও শিশু স্বাস্হ্যসেবা নিয়ে কাজ করে এ ধরনের কিছু এন,জি,ও এবং এন,জি,ও ঘরনার হাসপাতালের সাথে পার্টনারশিপের প্রয়োজন। আমাদের প্রতিস্ঠানটি দেশের সনামধন্য প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অন্যান্য সব সনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা যখন আমাদের অফিসে এসেছিলেন কথা বলতে, তখন এই অভদ্র লোকটার সাথে মিটিংয়ের জন্য তার অফিসে এসে আমার বস কেন যে কিছুক্ষন পর পর বিনাপয়সার ধমকে বিপন্ন হচ্ছেন তা মাথায় ঢুকাতে পারছিলাম না। তবে লোকটা রূঢ়ভাবে কথা বল্লেও তার প্রতিটা পয়েন্টই অকাট্য যুক্তিতে ভরা।
“তুমরা কি বুঝাইতাছো আমারে! এই গ্রামের মেয়েগুলা ৩ বছর তোমাদের এসি ক্লাশরুমের ভেতর ইংলিশ কারিকুলামে লেখাপড়া শেষ করে সার্ভিস দেয়ার জন্য আবার গ্রামে তার কমিউনিটির কাছে ফিরা যাবে!” – বলে যে এক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন তা এখনও আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি। তিনি আবার চেচিয়ে বলতে লাগলেন “তোমার ডাইরী দেও, আমি লেখে দেই, এরা সব ইংলিশ শিখা বিদেশে চাকরী নিয়া চলে যাবে। তোমাদের মানব পাচারের এই ব্যবসায় আমার প্রতিষ্ঠানের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।”
“দেখেন জাফর ভাই, আমাদেরতো গভর্ণমেন্টের কারিকুলামই ফলো করা লাগবে। তা না হলে মেয়েগুলাতো সরকারী লাইসেন্সিং এক্সাম দিতে পারবেনা!” বসের এই যুক্তি প্রচন্ড শক্তিশালী একটা সত্য। এবার আমি খুশিতে হুদাই সজোরে মাথা নাড়ালাম। ভদ্রলোক আমার দিকে এই প্রথম খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। আমিও বেকুবের মত একটা হাসি দিয়ে অচেনা এই লোকটাকে অভিবাদন জানালাম। ভাবছিলাম অন্যান্য পার্টনারদের মত বসের উপস্থিতিতে গনস্বাস্থ্যকেও চিপা একটা বাজেটের মধ্যে আটকে আমার ইয়ার্লি এপ্রাইজাল আরও ঝালায়া নিবো। কিন্তু এই সাদা মোচওয়ালা চাচার থুতু বৃষ্টিতে সব আশা নিভু নিভু। তিনি আমার বসের অকাট্য এই যুক্তি শুনে খুব নরম ভাষায় বল্লেন – “তাহলে আর কি! তোমরা আর গভর্নমেন্ট মিলেই মানবসম্পদ পাচারের ব্যবসা কর। এর মধ্যে আমাদের টেনোনা। যদি সত্যি তোমরা এদের কমিউনিটিতে ফিরায়া কাজ করাতে চাও তাহলে চাইনিজদের মত মাতৃভাষার কারিকুলামে শিক্ষা দাও। তাহলে চাইনিজ ডাক্তার আর নার্সদের মত কেউই আর ইংলিশ বলতেও পারবেনা আর বিদেশে পালাতেও পারবেনা। ওরা নিরুপায় হয়ে দেশেই সার্ভিস দিবে। আমার গনস্বাস্থ্যের অভিজ্ঞতা থেকেই তোমাকে বল্লাম। তুমি কিছু মনে করলে আমার কিছুই করার নাই। নাও চা খেয়ে চলে যাও।”
আমরা উনার মতই টেস্টবিহীন ঠান্ডা চা কোনও মতে খেয়ে মন খারাপ করে চলে আসলাম। অফিসে এসেই ওনার নাম লিখে গুগল সার্চ দিলাম। তারপর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সম্মন্ধে যা জেনেছিলাম তা যদি আগে জানতাম তাহলে উনাকে সেদিন কঠিন এক হাগ দিয়ে উনার বুকের হাড্ডিগুড্ডি আমি ভেঙে দিয়ে আসতাম!
নিশ্চই আমাদের বিশ্বাসের রব আপনাকে আপনার কৃতকর্মের জন্য বেহেস্তে সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন স্যার, যদিও প্রতিদান পাবার লোভ কখনই আপনার ছিলোনা।
লেখকঃ সিনিওর ম্যানেজার ফাইনান্স এন্ড অপারেশন, মিডওয়াইফারী ইডুকেশন প্রগ্রাম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি