শিল্প সাহিত্য

কমরেড অনঙ্গ সেন ও কালের ইশতেহার

-নাজিমুদ্দীন শ্যামল

আন্দামান স্মৃতি জ্বলে ওঠে হরিখোলার মাঠে,
কমরেড অনঙ্গ সেন হেঁটে চলেন নিরুত্তাপ
সমুজ্জ্বল স্মৃতি ছড়াতে ছড়াতে আন্দরকিল­ায়
কিংবা বৌদ্ধ মন্দির সড়কে। রথের পুকুর পাড়
হয়ে শহীদ মিনার এবং হাজারী গলিতে
বিষন্ন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে
কী দ্যুতি ছড়িয়ে দেন সময়ের শরীরে

একদিন জালালাবাদÑ স্বপ্ন মাটি ফুঁড়ে
আকাশ ছুঁয়েছিলো,
একদিন ধরের টেক হতে লাঙল কাঁধে
কৃষক এসেছিলো,
একদিন মহাপ্রলয়ের মতো আগুন ছড়িয়ে
সূর্যরা জ্বলেছিলো,
একদিন রাত বাড়তে বাড়তে দিন এসেছিলো
বুকের কাছাকাছি,
একদিন ভোরের আগে দল বেঁধে সমুদ্রে
নেমেছিলো সকলে
একদিন মধ্যাহ্ন আকাশে আদম সুরত দেখে
ঘর ছেড়েছিলো
বালক পদাতিক।

উদাস বিকেলে কি যাপিত জীবন জাবর কাটে!
বাতাসের সাথে ক্ষীণকায় অনঙ্গ
কী এত কথা বলেন,
বাতাস কি তা জানে?

বিকেলগুলো এখন কেবল বিকেলের মতো,
রাতগুলোও শুধু রাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখনতো সারাক্ষণ নিজের সাথে কথা বলা
অন্য কথোপকথনে ক্লান্ত হয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছে পরীর পাহাড়,
এক এক করে ঘুমিয়ে পড়েছে স্বপ্নগুলো।

সন্ধ্যা নামতেই হারিকেনের আলোয়
শৈশব সমস্বরে বলে,
“নোটন নোটন পায়রাগুলো ঝোটন বেঁধেছে,
ঐ পাড়েতে ছেলেমেয়ে নাইতে নেমেছে,
দুই ধারে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠেছে,
কে দেখেছে কে দেখেছে দাদা দেখেছে,
দাদার হাতে কলম ছিলো ছুঁড়ে মেরেছে,
উহ্ বড্ড লেগেছে”।
হায়, দাদারা এখন কিছুই দেখেন না!
কমরেড অনঙ্গ সেন কি কিছু দেখতে পাচ্ছেন,
নাকি ঘুমোচ্ছেন,
আমাদের যাপিত স্বপ্নের মতোন?

কাঁধের ঝোলাতে এক ঝাঁক স্বপ্নকে ঘুম পাড়িয়ে
পাতলা চপ্পলে চটাস চটাস আওয়াজ তোলেন রাস্তায়!
কমরেড পূর্ণেন্দু কি বাসায় আছেন?
অমর সেনকে যদি ঘরে পাওয়া না যায়
তিনি কি আমার কাছে আসবেন
এই ভোর সকালে?
আমাকেই কি গছিয়ে দিতে চান
ঘুমন্ত স্বপ্নের উত্তরাধিকার?

জে এম সেন হলের পাশে তিনি খানিক দাঁড়ান
কখনো কখনো,
টুংটাং বেল বাজিয়ে কালো আকাশে ওড়ে
তিন পাখার প্রত্যক্ষ পাখি।
বুকের হাঁপরে করুণ কণ্ঠে ঘাম ঝরে
শ্রমক্লান্ত পাখিওয়ালার।
দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম,
কমরেড অনঙ্গ সেন কঁকিয়ে ওঠেন ব্যথায়।
আশ্চর্য, যাবতীয় শোষণ বঞ্চনাই কি তাঁকে ব্যথিত করে!
কতো ব্যথা জমা আছে তাঁর বুকে?

একদিন শহীদ মিনারের সামনে
তিনি কথা বলেন,
আমাদের পতাকায় হাজার নদী রক্তের কথা,
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুতে কষ্টে পোড়া প্রজাপতি
আর মথ হয়ে জমাট বাঁধা স্বপ্নের কথা।
কালো মানুষের শরীরে পাস্তুরিত কার্বন কবিতা,
দীপান্তরে পাথর কেটে জল নামানো সংগ্রামী পুরাণ
আর পূর্ব স্বপ্ন বপনের ইতিবৃত্ত বলে চলেন তিনি
বাম হাতের ইস্তেহার ঊর্ধ্বে তুলে…
তাঁর হাতের একতা শূন্যে শূন্যে ওড়ে
মাঝ দরিয়ায় উড়ন্ত শীতের পাখির মতো।

কমরেড অনঙ্গ সেন কি জানেন,
প্রান্তিক শতকে বিশ্ব ভাঙনের সংবাদ;
মহামতি লেনিনের কফিন নিয়ে কি তুলকালাম
কাণ্ডটাই না হলো মিডিয়া ওয়ার্ল্ডে!
বসনিয়া বসরা যুগোস্লাভিয়ার আগুন দাউ দাউ জ্বালায়
তিনভাগ জলজ ভূমি;
ভীষণ ভাঙন নিয়ে ভেঙে গেলো স্বপ্ন বুননের কাল,
যাবতীয় যৌবন আর নপুংশক বুদ্ধিজীবীর মেরুদণ্ড!

শহরের সোডিয়াম আলো মাড়িয়ে কালো পাটিতে
এলিয়ে দেন গা…
জেলÑজীবন ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেনবা স্মৃতির দরিয়া।
অব্যক্ত ব্যথারা রাশি রাশি জল ছড়ায়
সবুজ পাথরের গায়ে।
একদা ইংরেজ ছিলো, ছিলো হানাদার।
তারপর সারা গায়ে কামড়ে আছে ভিন্ন নামের জোঁক।
তাঁর শরীর যেনবা ব্যথার মৌচাক,
নীল মাছির মতো লেগে থাকা জোক
খেয়ে নেয় নাদুস জীবন অবলীলায়।
তিনি কি তবে বাংলাদেশ,
কালো কুষ্ঠের মতো সারা শরীরে
রক্তচোষা গুটি বসন্তের মানচিত্র?

রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন হাঁটেন তিনি,
ইথারে ইথারে পৌঁছে দেন খবর।
তিনি বিলি করে চলেন স্বপ্ন দ্বীপের সুখ-দু:খ।
রাশিয়ায়, পোলান্ডে এমন কি ভারতেও
স্বপ্নদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে যান চাঁদ সওদাগর।
পূর্ব দিনের সূর্যকে কানে কানে বলেন
ব্যথার নির্যাস অশ্র“
শ্রমের নির্যাস ঘাম
ত্যাগের নির্যাস রক্ত
সংগ্রামের নির্যাস জীবন

.নগরের সব গাড়ি আর যাবতীয় চোখ যখন
ভোঁ দৌঁড় দেয় অন্ধকারে;
অনঙ্গ সেন তখনও নীলাকাশে সাদা ঘুড়ি ওড়ান
নিমগ্ন ধ্যানে।
অনঙ্গ সেন কি জীবন যোজনের ঋত্বিক,
নাকি কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসক,
বনাজী ঔষধ ফেরী করেন গ্রামান্তরে?
অনঙ্গ সেন কি অনন্ত যৌবন,
ছুঁয়ে দিলেই শারোদোৎসব শৈশব
ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে বার বার?
তিনি কি রণ-পা ওয়ালা যোগী,
নগর বাসীকে হতবাক করে দেন
নিরন্তর স্বপ্নের সাধনায়?
তিনি কি তাহাদের উত্তর পুরুষ,
যাহারা মুক্ত আকাশের গায়ে
নিজের চামড়া দিয়ে গড়ে দেন চাদোয়া?

তিনি তো লাল নদীর প্রতিবেশী, শুভ্র স্বপ্নের সন্তান,
দৃশ্যমান রাস্তা ধরে হেঁটে চলেন অধরা পদাতিক।
তিনি লালদীঘিতে ডুব দিয়ে তিন সপ্তাহ থাকতে পারেন,
জ্বালাতে পারেন জলের ভেতর আগুন।
তিনি নদী ও পাহাড়ের ব্যথা বুঝতে পারেন,
বলতে পারেন পাখির ভাষায় কথা।
তিনি মানুষ ও বলদের শ্রমের ব্যাকরণ জানেন,
অনুবাদ করতে পারেন শোষিতের পুরাণ।
তিনিতো পূর্বস্বপ্নের পাখি টাইটনিক আকাশে,
অভিযোজন শিখে উড়াল দেবেন
আগামী প্রাচ্যে।

# নাজিমুদ্দীন শ্যামলঃ কবি ও সাংবাদিক