মতামত

মালিকের সম্মান বনাম শ্রমিকের জান

-ফজলুল কবির মিন্টু

 

সম্প্রতি সীমা অক্সিজেন প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭ জন শ্রমিক নিহত এবং আরো প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়েছেন। যাদের অনেকেই হয়ত চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবে। আর কখনোই কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবে না – অনেকেই হয়ত আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারবে না। সারাক্ষন তাদেরকে হয়ত স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হবে কিংবা বিছানায় শুয়ে থেকে বাকী জীবন অতিবাহিত করতে হবে। এর দায় কার? কেউ জানে না। দায় হয়তো তাদের দারিদ্রতা। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা হয়ত নিজেদের পেটকেও দায়ী করতে পারে। কারন পেট আছে বলেই ক্ষুধা লাগে। ক্ষুধা নিবারনের জন্যই তাদেরকে পেটের দায়ে বার বার বিপজ্জনক কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। এই পেটের দায়কে আমরা ভদ্র ভাষায় জীবন ও জীবিকা হিসাবে অভিহিত করে থাকি।

তাজরীন ফ্যাশনে আগুন, রানা প্লাজা ধ্বস, সেজান জুস কারখানায় আগুন, বি এম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণ, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প সেক্টরে প্রতি বছর গড়ে ১৪/১৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং সর্বশেষ সীমা অক্সিজেন প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রতিটি কর্মক্ষত্রেই শ্রমিকদের চরম নিরাপত্তা ঘাটতি রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড শিল্পাঞ্চল যেন মহাবিপজ্জনক হয়ে মৃত্যুকুপে পরিনত হয়েছে। এই শিল্প অঞ্চলটির কর্মক্ষেত্রগুলোই যে কেবল বিপজ্জনক তা নয় বরং আশেপাশে গড়ে উঠা বসতিগুলোতেও বসবাস করা এখন রীতিমত হুমকিতে পরিনত হয়েছে। কারন সীমা অক্সিজেন প্লান্ট বিস্ফোরণের পর আধা কিলোমিটার দূরে লোহার টুকরার আঘাতে একজন সাধারণ মানুষেরও মৃত্যু হয়েছে এবং সীমা অক্সিজেন প্লান্টের পার্শ্ববর্তী ১/২ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত অনেক বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্বে কেবল কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকা থাকলেও এবার কর্মক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকাগুলোও যে আর নিরাপদ নয় সেটা প্রমানিত হয়েছে। তাই সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নতুন মাত্রা ও উদ্বেগ যোগ হয়েছে।

বাংলাদেশে কর্মক্ষত্রে দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রতিবারই একটা গতানুগতিক এবং লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। এরপর কয়েক দিন হৈ চৈ হয় অতঃপর সবকিছুই আগের মতই চলতে থাকে। হতভাগ্য শ্রমিকদের জীবন যথারীতি অনিরাপদ থেকে যায়। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট মালিক বা তদারকি সংস্থা সমুহের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, অযোগ্যতা কিংবা অন্য কোন ত্রুটি উদঘাটিত হলেও কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়না। এমনকি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে দোষ প্রমানিত হলেও কেউ শাস্তি পেয়েছে এমন নজির নাই। শুধুমাত্র গত বছর সেজান জুস কারখানায় আগুন লাগার পর উক্ত কারখানার চেয়ারম্যান সহ কয়েকজন পরিচালককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য খুব দ্রুত তারা জামিনে মুক্তি পান। কারন তারা সম্মানিত লোক।

পড়ুন:  টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মস্থলে পেশাগত স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা এবং শোভনকাজ বাস্তবায়ন - ফজলুল কবির মিন্টু

গত ২/৩দিন পূর্বে সীমা গ্রুপের পরিচালক পারভেজ সান্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তার করে কোমড়ে দড়ি দিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়ার একটি ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এতে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমনকি টেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেক শ্রমিকনেতাকেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখলাম। এতে  তাদের উদারতা নাকি অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে বুঝতে পারলাম না।

গতবছর বিএম ডিপোতে শ্রমিক হতাহতের ঘটনার পর চট্টগ্রামে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ছাড়া আর কোন শ্রমিক সংগঠনকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। সম্প্রতি সীমা অক্সিজেন প্লান্টে শ্রমিক হতাহতের পর শুধুমাত্র চট্টগ্রাম যুব ট্রেড ইউনিয়ন নেটওয়ার্ক ছাড়া আর কাউকে সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। এমনকি চট্টগ্রামের অভিভাবক সংগঠন শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকেও কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে একজন মালিককে কোমড়ে দড়ি দিয়ে গ্রেপ্তারের ছবি দেখে আমাদের সর্বমহলে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিলেও শত শত শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে কর্মস্থলে মৃত্যুবরনের খবরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না। আমি আসলে বুঝিনা কোনটি বড় মালিকের সম্মান নাকি শ্রমিকের জান? আমি বুঝিনা শ্রমিকেরা মানুষ কিনা? কারন একজন মানুষের কোমড়ে দড়ি বাঁধলে যে প্রতিক্রিয়া হয় শত শত শ্রমিক মারা গেলেও তেমন প্রতিক্রিয়া হয়না কেন? কোটি কোটি মানুষের দেশে রাষ্ট্র এবং শিল্পের মালিকদের কাছে শ্রমিকের জীবনের গুরুত্ব নাও থাকতে পারে। এতে মোটেও আশ্চর্য হই না কিন্তু এত শ্রমিকের মৃত্যুতে আমরা নিজেরাও যখন উদ্বিগ্ন হওয়ার মত সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হই তখন আমার কাছে সামনের পথ ভীষণ কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয়।

লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি