শুরুতেই প্রশ্নের মুখে ফরহাদ মজহারের জাতীয় ইনসাফ কমিটি
তবে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন, নতুন সংবিধান প্রণয়নের মতো লক্ষ্যের কথা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তারা৷ মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘‘এ সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না৷’’ সংগঠনে বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের উপস্থিতি এবং আরো কিছু বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ৷
ফরহাদ মজহার শুক্রবার সন্ধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মানবাধিকারের দিক দিয়ে আমাদের কর্মসূচি ঠিক করেছি৷ রাজনৈতিক কোনো অভিপ্রায় নেই৷ দেশের মানুষের অধিকার- মানবাধিকার৷ তবে প্রয়োজন হলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা ভবিষ্যতে মাঠে নামবো৷’’
বৃহস্পতিবার রাতে বনানীর শেরাটন হোটেলে এক নৈশভোজের মাধ্যমে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির আত্মপ্রকাশের খবর জানানো হয়৷ সংগঠনের আহ্বায়ক ফরহাদ মজহার এবং সদস্য সচিব বিএনপি ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ৷ ২০১৩ সালে এই সংগঠনটি গঠন করা হয়েছিল বলে দাবি করা হলেও এটাই তাদের প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান৷ অনুষ্ঠানে এখনো সব প্রকাশিত হয়নি, বিশেষ করে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম এখনো তারা জানাননি৷
শওকত মাহমুদ সংগঠনের কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন৷ প্রস্তাবে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে৷ অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে৷ তা না হলে গত কয়েক দশকের সুবিধাবাদী-সন্ত্রাসী-লুটেরা শক্তিকে পরাস্ত করা যাবে না৷ প্রস্তাবে আরো বলা হয়, জনগণের বিজয় নিশ্চিত না করে তথাকথিত জাতীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে ক্ষমতা লাভের খায়েশমাত্র৷ তাই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে উৎখাত করে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ছোট-বড় সব দলকে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে৷
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে গঠনতন্ত্র ( সংবিধান) প্রণয়ন, সভা আহ্বান করে জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করা৷ নতুন গঠনতন্ত্রে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের সময় সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে৷
জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির দাবি, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার পদত্যাগ করতে হবে এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন জাতীয় নির্বাচন হবে৷ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠনের এটাই সঠিক পথ বলে মনে করে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি৷
বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের তুলে ধরা লিখিত প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপির জাতীয় সরকারের রূপরেখার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে৷ বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছে৷
শেরাটনে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির নৈশভোজে শওকত মাহমুদ ছাড়া বিএনপির আর কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না৷ কয়েকজনকে দাওয়াত দেয়া হলেও তারা সেখানে যাননি বলে জানা গেছে৷
নৈশভোজে ছিলেন বিএনপির ‘মিত্র’ নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া, জানিপপের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ও গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান৷ এছাড়া পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তাও জাতীয় ইনসাফ কমিটির রাতের আহারে অংশ নেন৷
এই সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না: মাহমুদুর রহমান মান্না
শুক্রবার নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা নৈশ ভোজের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম৷ ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদ ছাড়া আর কেউ সেখানে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখেননি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এই সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না৷ ফরহাদ মজহার যা বলেছেন সেগুলো শো আপ যে বোঝা যায় না৷ আর শওকত মাহমুদ যে লিখিত বক্তব্য পড়েছেন, তা অনেকটা পরিষ্কার ও পলিটিক্যাল৷’’
‘‘বিএনপির যে নির্বাচনকালীন সরকারের ধারণা, তার সাথে শওকত মাহমুদ যা বলেছেন তার পার্থক্য আছে৷ সেটা বিএনপি বুঝবে৷ কিন্তু বিএনপি তাকে এরকম একটি সংগঠন করার অনুমতি দিয়েছে কিনা সেটাই প্রশ্ন৷ আমরা হলে দিতাম না,’’ বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না৷
তার কথা, ‘‘আমরা সেখানে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ৷ খেয়ে চলে এসেছি৷ কোনো বক্তব্য দেইনি৷’’
আর গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘‘এটা অনেক ভালো একটি উদ্যোগ৷ তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে চায়৷ সেটা করলে আমিও আমার দলের কর্মীদের সেখানে পাঠাবো৷’’
‘‘তারা গণঅভ্যুত্থান, সংবিধান পরিবর্তন- এগুলোর জন্য একটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে চায়৷ দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে চায়৷ আমি এতে অসুবিধার কিছু দেখি না,’’ বলেন রেজা কিবরিয়া৷
তার সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ‘‘আমরা ডিনারের দাওয়াতে গিয়েছিলাম৷ সংগঠনের ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না৷ তারা ওই অনুষ্ঠানে প্রথম যা বলেছেন তাতে সামাজিক সংগঠন মনে হয়েছে৷ পরে তারা গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নতুন সংবিধান- এসব কথা বলেন৷ এই বক্তব্য আমার কাছে রাজনৈতিক দলের মতোই মনে হয়েছে৷’’
তার মতে, ‘‘বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদ এখানে যে ধরনের জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন, তার সঙ্গে বিএনপির রূপরেখার কিছু পার্থক্য আছে৷ কেন এই পার্থক্য এটা শওকত মাহমুদ সাহেবই বলতে পারবেন৷’’
নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলের পর্যবেক্ষক হিসেবে দাওয়াত পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন জানিপপ-এর প্রধান অধ্যাপক ড. নামুল আহসান কলিমুল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়নি এটা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন হবে৷ তাদের পুরোনো সামাজিক সংগঠন, নির্বাচনের আগে সক্রিয়তার জানান দিতে চাচ্ছে৷’’
এখানে আরো কয়েকটি দলের নেতাদের দাওয়াত দেয়া হলেও তারা যাননি বলে জানা গেছে৷ তাদের মধ্যে একজন এলডিপির প্রধান কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদ৷ তবে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ জানান, তিনি হোটেল পর্যন্ত গিয়ে ফিরে যান, অনুষ্ঠানে ঢোকেননি৷
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশররফ হোসেন বলেন, ‘‘ওই ধরনের কোনো সংগঠনের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই৷ আমাদের পার্টিতে এটা নিয়ে কখনো কোনো কথা হয়নি৷ শওকত মাহমুদ সাহেব কেন গিয়েছেন, ওই সংগঠনের তিনি কী তা আমরা জানি না৷’’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও সে চেষ্টায় সফল হওয়া যায়নি৷ তবে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘‘আমাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই৷ আমরা যা করছি, তা হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে৷ আপনি যদি জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে না পারেন, তাহলে সেটা মানবাধিধকারের লঙ্ঘন৷ আমরা সেজন্য গণতন্ত্র, সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছি৷’’
‘অরাজনৈতিক’ সংগঠনের সদস্য সচিব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি বিএনপির মতো একটি দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট- এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি বলেন, ‘‘হতে পারে৷ তবে ২০১৩ সালে যখন আমরা সংগঠন করি, তখন তিনি বিএনপির কেউ ছিলেন না৷ আর আমাদের কর্মসূচির সাথে একমত হলে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যে কেউ যোগ দিতে পারেন৷ নানা দলের নানা চিন্তা থাকতে পারে৷ কেউ সংবিধান সংস্কার করতে চাইতে পারেন, জাতীয় সরকার নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে পারেন৷ কিন্তু আমরা সংবিধানের পরিবর্তন চাই৷ আমাদের কর্মসূচি আমাদের মতো৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অধিকার আদায়ের জন্য যদি আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, সেটা ভবিষ্যতে আমরা দেখবো৷ তবে এখন রাস্তায় নামার পরিকল্পনা নাই৷’’
ফরহাদ মজহার জানান, তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো হয়নি, তবে হবে৷
# ডয়চে ভেলে, ঢাকা