মতামত

আমাদের মোছলেম ভাই

-নাজিমুদ্দীন শ্যামল

মোছলেম উদ্দিন আহমেদ আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির এক বিরল চরিত্র। আমরা সচরাচর আওয়ামী লীগ নেতা বলতে যা বুঝি বা দেখি তার অনেকটা ব্যতিক্রম ছিলেন মোছলেম ভাই। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
মোছলেম ভাইয়ের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ একাধারে তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা এক বর্ষীয়ান নেতা। রাজনৈতিক গুণাবলীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলেন তিনি, কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন এবং কর্মীদের মধ্যে তিনি ধনী–গরীবের চোখে দেখতেন না।

মোছলেম উদ্দিন আহমদ ১৯৪৮ সালের ১ জুন জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীর কধুরখীল এলাকায় হলেও বসবাস করতেন নগরীর লালখান বাজার এলাকায়। সেখানেই পৈত্রিক ভবনে সপরিবারে বসবাস করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় এম.কম পাস করা এই নেতা ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শহর শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরের স্টেডিয়াম সন্নিকটস্থ নৌ দপ্তর আক্রমণকালে মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ পাক বর্বর সেনাদের হাতে আহতবস্থায় বন্দী হয়ে ক্যান্টনমেন্টে দীর্ঘ আড়াই মাস নির্যাতিত হন। পরে সেখানে থেকে পালিয়ে যান। শহীদ মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় ও বোয়ালখালীর যুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. সোলায়মানের নেতৃত্বে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মোছলেম উদ্দিন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় স্কুলজীবনেই কারাবরণ করার স্বাদ গ্রহণ করেন মোছলেম উদ্দিন। সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রথমবার কারাবরণ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেন মোছলেম উদ্দিন। শহীদ মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়ার অপরাধে ১৯৭৬ সালে কারাবরণ করেন। ১৯৮৭ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের আরেক অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ তিনি সাতমাস জেলহাজতে ছিলেন । তিনি স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী সরকারের আমলে কারাগারে প্রথম ডিভিশনপ্রাপ্ত রাজবন্দী ছিলেন। জাসদ, বাকশাল, গণতন্ত্রী পার্টিসহ জোট সরকারের অনেক নেতা সেসময় কারাগারে ছিলেন।
তিনি ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হলে মোছলেম উদ্দিন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সাল থেকে মোছলেম উদ্দিন আহমেদ চারদফায় প্রায় ২৬ বছর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই নেতার সভাপতি ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির আরেক প্রাণপুরুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। দীর্ঘ ২৬ বছর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নেতৃত্বে দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে কাজ করেছেন। শুধু দক্ষিণ জেলায় নয়, দুঃসময়ে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সামনের সারথী ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর ঢাকা থেকে মোছলেম উদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও মফিজুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হন তিনি।
রাজনৈতিক জীবনে মোছলেম উদ্দিনের পূর্ণতার শেষ নেই। জীবনে একবার সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে ২০২০ সালে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার উন্নয়নে পুরোদমে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর কাছে হার মেনে চলার পথ থেমে গেলেও দীর্ঘজীবনে অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন মোছলেম উদ্দিন। ১৯৭৩-১৯৮২ সাল পর্যন্ত লালখান বাজার ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন তিনি। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্টিজের তিনবারের পরিচালক ছিলেন। অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেটের নির্বাচিত সিনেট মেম্বার ছিলেন। জাতীয় শিশু সংগঠন কচিকাঁচা মেলার জেলা সংগঠক, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ ও সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির তিন মেয়াদে সদস্যের দায়িত্বে ছিলেন। গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, পশ্চিম কধুরখীল স্কুল ও পূর্ব কধুরখীল স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। লালখান বাজার শহীদ নগর সিটি কর্পোরেশন গার্লস হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও তিনবার পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। হযরত খাজা গরীবউল্লাহ শাহ মাজার ওয়াকফ এস্টেটের দীর্ঘদিন মোতোয়াল্লী ও সাত বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য ছিলেন। বনেদি ক্লাব চিটাগাং ক্লাবের মেম্বারও ছিলেন তিনি। সাপ্তাহিক সাহসী ঠিকানা নামে একটি কাগজের সম্পাদক ও প্রকাশক হয়ে সাংবাদিকতাতেও নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন মোছলেম উদ্দিন।
মৃত্যুকালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। এই বয়সের তিনভাগের দুইভাগই তিনি রাজনীতির কল্যাণে ব্যয় করেছেন। প্রায় ৫৩ বছর রাজনীতির মাঠে পদবীধারী নেতা হিসেবে বিচরণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে আসীন ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন। ২০২০ সালে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসন থেকে উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শকে বুকে ধারণ করে যাঁরা ‘ভোগ নয় ত্যাগ এর মনোভাব নিয়ে রাজনীতি করতেন তাঁদেরই একজন মোছলেম ভাই। দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দলের দুর্দিনে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়েছেন নিজ কর্মী– অনুসারীদের। রাজনীতিতে সততা, দক্ষতা মোছলেম ভাইকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চাসনে। জেল–জুলুম সহ্য করেছেন, শত প্রতিকূল অবস্থায়ও রাজপথ ছাড়েননি, রাজনীতির সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন যে নেতা তিনি মরহুম আলহাজ্ব মোছলেম উদ্দিন আহমদ। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন সফল নেতা। জিয়া-এরশাদ আমলে মন্ত্রীত্ব সহ অনেক লোভনীয় অফার এসেছিল এই নেতার কাছে। নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি মোছলেম ভাইকে। যেখানে আওয়ামী লীগের অনেক ডাকসাইটে নেতা ক্ষমতার লোভ সংবরণ করতে পারেন নি, সেখানে মোছলেম ভাইদের মত নির্লোভ নেতারা ছিলেন দলের সম্পদ। জিয়া ও এরশাদ আমলে কারাবরণ করেছেন একাধিক বার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদ একজন সুবক্তা ছিলেন। রাজনীতির উপর পড়াশোনা করেছেন প্রচুর। চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে জ্ঞানী ও উচ্চ শিক্ষিত নেতাদের মধ্যে মোছলেম ভাই ছিলেন একজন। যতক্ষণ শারীরিক সামর্থ্য ছিলো ততক্ষণই রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন। ঢাকায় আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।