বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮৪): শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

-বিজন সাহা

 

সব সমীকরণের সমাধান থাকে না। আবার কোন কোন সমীকরণের সাধারণ সমাধান থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে সেই সব সমাধান অকেজো। এই বিশেষ অবস্থা নির্ভর করে ইনিশিয়াল আর বাউন্ডারি কন্ডিশনের উপর। সমাজের ক্ষেত্রে এসব বিশেষ শর্ত সমাজের আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভৌগলিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।  যেটা ইউরোপ বা আমেরিকার জন্য গ্রহণযোগ্য বা কার্যকরী সেটা উপমাহাদেশে কার্যকরী নাও হতে পারে। তাই আমরা যদি কোন দেশ বা সমাজে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম বা জীবনযাত্রার কোন মডেল জোর করে চাপিয়ে দিতে চাই সেটা হবে ডিক্টেটরশিপ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এমনকি যদি সেটা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে রঙিন বিপ্লবের মধ্য দিয়েও হয়। তাই এসব মডেলকে পরিবর্তিত করে কিভাবে স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো যায় সেটা দেখতে হবে। ফ্লেক্সিবিলিটি কথাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যখন মগজ পাচার নিয়ে  লিখতে শুরু করি ভাবিনি এখানে এত কথা চলে আসবে। কথার পিঠে কথা আসে। এভাবেই বিভিন্ন প্রসঙ্গ চলে এল। আমার কেন যেন মনে হয় দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য আমি বা আমরাও কোন না কোন ভাবে দায়ী। কয়েক বছর  আগে দেশে বেড়াতে গিয়ে স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দেখা। গ্রামের চকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সূর্যাস্তের আগে। ও আমাকে একটার পর একটা জমির প্লট দেখিয়ে বলছিল, এটা তোদের ছিল, এটা তোদের ছিল। তুই যদি রাশিয়ায় থেকে না গিয়ে দেশে ফিরতি আর এখানে চাকরি করতি, এসব জমি হাতছাড়া হত না। আমাকে বাড়িতে এ নিয়ে কেউ কোনদিন কিছু বলেনি। কারও কোন অনুযোগ ছিল না, নেই। তারপরেও আমার কেন যেন নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। দেশে থাকতে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। কথা ছিল দেশে ফিরে খেলাঘর বা অন্য কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হব। না, কেউ আমাকে এটা বলেনি, আমি নিজেই ভেবে রেখেছিলাম। আজ দেশে বা আমাদের গ্রামাঞ্চলে এসব আর আগের মত নেই। অনেক দিন খেলাঘরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ইয়াদিং কালে আবার সেটা আজ করতে শুরু করেছে। তাতে আমার পক্ষ থেকেও কিছু উদ্যোগ ছিল। তবে আমাদের নিষ্ক্রিয়তায় এই যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল সেটা পূরণ করছে বিভিন্ন ধর্মীয় বা উগ্রবাদী সংগঠন। এখানেই আমি মনে করি আমার দায়িত্ব আমি পালন করতে পারিনি।

আমি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আসার আগে জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই, তিনি বলেন সব জায়গায় ভালো মানুষ যেমন আছে, মন্দ লোকও তেমনি আছে। ভালো মানুষের সাথে মিশবে, মন্দদের এড়িয়ে চলবে। আমি বলেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমি বুঝেছিলাম কতটা অন্ধ ছিল আমার বিচার। বাড়িতে আমরা ছিলাম স্বাধীন। যেকোনো ব্যাপারে মত প্রকাশ করতে পারতাম। এখানে দেখলাম সেই স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই আর নেই। ফলে ধীরে ধীরে মনে হল গণতন্ত্রই একমাত্র না হলেও সোভিয়েত সমাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট পথ। আমার জীবন কেটেছে তরা ঘাটে যা ছিল ঢাকার সাথে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান রাস্তা। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে অনেক নেতা, অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী এখানে অপেক্ষা করেছেন। গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে তাদের দেখার জন্য। এমনকি সেই ছোটবেলায়ও এদের দেখতে যাবার কোন রকম আগ্রহ বোধ করিনি। হয় বই পড়েছি নয়তো খেলেছি একা একা। সেই আমি ১৯৮৮  সালে যখন রোনাল্ড রিগ্যান মস্কো আসেন, হোস্টেলের পাশে লেনিনস্কি প্রস্পেক্টে দাঁড়িয়েছিলাম তাঁকে দেখার জন্য, কারণ মনে করেছিলাম তাঁর হাত ধরেই আসতে পারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যুগ। আসেনি। কেন? লোভ। অর্থের লোভ, ক্ষমতার লোভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে বিশ্ব হতে পারত শান্তির গ্রহ তা আজ আবার নতুন করে ধ্বংসের পথে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইউক্রেন…। কেন? আমরা নিজেদের ধোঁকা দিয়েছি, নিজেদের বোকা বানাতে দিয়েছি। বার বার মানবতা, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এসব গালভরা বুলিতে বিশ্বাস করে আমরাই দিয়েছি এসব গলাবাজ রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে। আমাদের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তারা আসলে অস্ত্র ব্যবসা করেছে, করছে। আজ আমেরিকার স্কুলে সন্ত্রাসবাদীর বন্দুকের গুলিতে নিরীহ ছাত্রছাত্রী মারা গেলে আমরা তার প্রতিবাদ করি আবার সেই একই  সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ আমরা সর্বান্তকরণে সমর্থন করি, এমনকি নিজেরা চাঁদা তুলে পাঠাই। আমাদের এই দ্বৈত স্বত্বার কারণেই শান্তি বার বার হাত ফস্কে চলে যায়। আর আমরা আনন্দে বগল বাজাই এই ভেবে যে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, যা খুশি বলার অধিকার আছে। অথচ সেই অধিকার যে কতখানি শর্ত সাপেক্ষ, কতখানি নিয়ন্ত্রিত সেটা কখনই দেখতে পাই না। গণতন্ত্রের মূল কথা পরের অধিকারের প্রতি সম্মানবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা। কিন্তু আজ কি সেটা আছে? অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তির শক্তিতে বলশালী কিছু দেশ কি সারা বিশ্বের উপর তাদের মতামত, তাদের খেয়াল খুশি চাপিয়ে দিয়ে কৃত্রিম ভাবে বৈষম্য তৈরি করছে না? তারাই কি ভাবছে না পশ্চিমা বিশ্বের সমস্যা সারা বিশ্বের সমস্যা কিন্তু সারা বিশ্বের সমস্যা পশ্চিমা বিশ্বের সমস্যা নয়? আমরা ভোল্টেয়ারকে কোট করে নিজেদের ওয়ালে লিখতে পারি “তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় আমি জীবন দিতেও দ্বিধা করব না।” আবার এই আমরাই বিভিন্ন অজুহাতে যখন আরটি বা অন্যান্য রুশ সংবাদ মাধ্যম পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয় সেটা সমর্থন করি। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব এক সময় এটাকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ ত্রুটি হিসেবে দেখতে। বাকস্বাধীনতা শুধু বলার স্বাধীনতা নয়, শোনার ও পড়ার স্বাধীনতাও। আমরা মনে করি পশ্চিমা বিশ্ব বাকস্বাধীনতার অভয়ারণ্য। বছর দুই আগে এক বন্ধু ফোন করল আমেরিকা থেকে। খুবই সফল – কী বিত্তে, কী যশে! আমরা ১৯৮৩ সালে একই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম সিপিবির বৃত্তি নিয়ে। কথায় কথায় বলল সিপিবি বা কমিউনিজম নিয়ে ভাবে না, ওখানে নাকি এসব ভাবা ভাল নয়। যদিও জানি পরিচিত অনেকেই সেখানে এ নিয়ে ভাবে, বিভিন্ন অনলাইন আলোচনা সভায় অংশ নেয়। একটু অবাক হলাম। মনে হয় খুব উপরে উঠতে হলে ওদেশে এসব না ভাবাই ভাল। এটাও হয়তো গণতন্ত্র বা আমেরিকান সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য। সোভিয়েত আমলে আমেরিকায় কমিউনিস্ট হওয়া বিপদজনক ছিল। হয়তো এখনও তাই। আসলে আদর্শ সমাজ বলে কিছু নেই, কেউ কেউ কোন আদর্শে বিশ্বাস করে সেটা তৈরি করার চেষ্টা করে – হয়তোবা কিছুটা পারেও। তবে কথায় আছে যত্র জীব তত্র শিব – সেই সূত্র ধরেই বলা যায় যত লোক তত মত, যত মত তত পথ। আর যখন কোন পথের সন্ধানীরা হয় সংখ্যায় অথবা অর্থ বা বাহু বলে বলীয়ান হয় – তারা অন্যদের ঘাড়ে নিজেদের মতটা চাপিয়ে দেয় সেই গণতন্ত্রের দোহাই দিয়েই।

লেখাটা শুরু করেছিলাম একাত্তরের কথা দিয়ে। ঈশ্বরের কথা দিয়ে। ছোটবেলায় ধর্ম বইয়ে পড়তাম ঈশ্বর মানে সত্য, ঈশ্বরের সন্ধান মানে সত্যের সন্ধান। “আমি কে? কেন জন্ম? কিসে বা কল্যাণ? এইরূপ প্রশ্ন করি লভ তত্ত্ব জ্ঞান”। জীবন থেকে ঈশ্বর বিদায় নিলেও সত্যের সন্ধান শেষ হয়নি। একজন পদার্থবিদ হিসেবে, একজন গবেষক হিসেবে সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন মানেই সত্যের সন্ধান। উৎস থেকে গন্তব্যে পৌঁছুতে ইলেট্রন হাজারটা রাস্তা নিতে পারে। যদিও সে কোন এক নির্দিষ্ট পথই বেঁছে নেয় তাতে কিন্তু অন্য পথগুলোর গুরুত্ব কমে যায় না। যদি প্রকৃতির এই হিসেবটা মানব সমাজ ঠিক বুঝতে পারত তাহলে মানুষ অনেক বেশি পরমতসহিষ্ণু হত বলেই আমার বিশ্বাস। আর আমরা যারা গবেষনা করি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করি তারাও এক অর্থে সত্যের সন্ধান করি। সত্যের সন্ধান মানে প্রশ্ন করা। কোন কিছু অন্ধভাবে গ্রহণ না করে প্রশ্ন করেই পথ চলা, অন্যের কথায় নয়, নিজের যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা। সেটাই আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে আজ, যখন চারিদিকে মিথ্যা আর মিথের ছড়াছড়ি, যখন সত্য নয় স্বার্থই শেষ কথা, যখন ফেইক নিউজে ভরে গেছে পত্রিকার পাতা তখন প্রশ্ন করাটা, বিশ্বাস না করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকদিন আগে স্পেনে জুফিল মানে প্রাণীদের সাথে যৌন সম্পর্ক করার বিষয়ে পার্লামেন্টে আইন পাশ হল। যেন অন্য কোন সমস্যা নেই। যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব তো বটেই, খোদ স্পেনে যখন মানুষের অবস্থা তথৈবচ তখন এসব কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে পশ্চিমা বিশ্ব, পশ্চিমা সভ্যতা কোন পথে যাচ্ছে। আমাদের জন্য এটাও এলারমিং, কারণ ওরা শুরু করে, পরে আমাদের উপর জোর করে এসব চাপিয়ে দেয়।

মনে রাখবেন অন্ধ বিশ্বাসই জন্মও দেয় গোঁড়ামির। অন্ধ বিশ্বাসই মানুষকে মৌলবাদী করে তোলে তা সে বিশ্বাস ধর্মেই হোক, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রেই হোক আর বিজ্ঞানেই হোক। বিজ্ঞান আলোর পথ, অন্ধের, অন্ধত্বের এখানে স্থান নেই।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো