বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮১): শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

– বিজন সাহা

 

আমাদের সময় মানে আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই পড়াশুনা করত নিজের বেছে নেওয়া পথে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য। অন্য দেশের কথা বলতে পারব না, তবে রাশিয়ায় ব্যাপারটা আর আগের মত নেই। যেহেতু রাশিয়া বিশ্বের বাইরের কোন দেশ নয়, তাই ধারণা করতে পারি যে এটা সারা বিশ্বেরই ট্রেন্ড। অধিকাংশ তরুণ তরুণীর মূল লক্ষ্য বেশি বেশি উপার্জন করা। আর তাই পাশ করার পর কোথায় কাজ করবে সেটা নির্ভর করে কোথায় বেতন বেশি তার উপর অথবা কোথায় কাজ পাবে তার উপর। অধিকাংশ মানুষই আজকাল কাজ বলতে বেতন বা আর্থিক দিকটা বোঝে যদিও প্রথম স্থানে থাকা উচিৎ ছিল কি করছে সেটা। যদি সে কাজটাকেই উপভোগ না করে তাহলে বেতনের পরিমাণ দিয়ে কি হবে? তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। হয়তো অধিকাংশ মানুষ ভালো বেতনটাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। যেহেতু ফিজিক্সে পড়াশুনা করে তুলনামুলক সহজ ভাবে বিভিন্ন ফিল্ডে কাজ পাওয়া যায়, তাই অনেকেই এখানে আসে অনেকটা ট্রানজিট হিসেবে। অন্তত আমার সেটাই মনে হয়েছে এত দিনের অভিজ্ঞতায়। সেদিক থেকে বলা যায় ভোগবাদী মানসিকতা ছাত্র সমাজকেই অনেকটা বদলে দিয়েছে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে নিজে নিজেই বদলে গেছে। আসলে শিক্ষক হিসেবে আমরা যেমন চাই একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ গড়তে, ছাত্র হিসেবে যে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সে চায় নিজেকে একটা ভালো পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে যাকে বাজারে বেশি দাম দিয়ে কিনবে। ফলে অনেকেই ফর্মাল এডুকেশনের প্রতি যতটা না গুরুত্ব দেয় তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বিভিন্ন অনলাইন কোর্সের উপর যা তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে বিসিএস দেবার প্রবণতা এ কারণেই বেড়েছে। বিসিএস অনেকটা প্যারাসুটের মত – বিপদে কাজে আসবে।

আমরা যখন পড়াশুনা করতাম, সোভিয়েত সরকার খুব ভালো অংকের টাকা স্টাইপেন্ড হিসেবে দিত, ফলে খাওয়া পরার চিন্তা করতে হতে না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ছাত্রদের নিজেদের কাজ করে জীবন ধারণ করতে হয়, স্টাইপেন্ডে আর চলে না। কিন্তু না সরকার, না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – কেউই ছাত্রদের কাজের ব্যাপারে কোন রকম সাহায্য করে না। তবে ইদানিং অন্তত কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা দেয় না। এটাও অনেককে বাধ্য করে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ খুঁজতে। মনে পড়ে ২০০১ সালের কথা। আমি তখন কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা করি। ছাত্ররা প্রথম ক্লাসেই বলল যে ওরা চাকরি করে, তাই সবাই সব ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারবে না। তবে আমার যাতে অসুবিধা না হয় তাই ওরা দুই গ্রুপে আসবে এক সপ্তাহ পর পর। আমি বা আমরা নিজেরাই তখন কঠিন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। এখনও যে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে তা কিন্তু নয়। প্রায় সবাই কাজ করে, ফলে এসব মেনে ও মানিয়েই কাজ করতে হয়। এই তো কিছুদিন আগে ক্লাসে গিয়ে দেখি কেউ আসেনি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বসলাম। ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে এলাম যে আমি ডিপার্টমেন্টে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডোমিনিকান রিপাবলিকের মেয়েটা এল। কি একটা জরুরি কাজে দূতাবাস যেতে হয়েছিল। লেকচার হলে গিয়ে ক্লাস নিলাম। চাইলে ক্লাস না নিলেই পারতাম, কিন্তু মনে পড়ল দুটো ঘটনা। সুব্রামোনিয়াম চন্দ্রশেখর এক ঝড়ের দিনে যখন ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন পথে তাঁর ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল কত জন ছাত্র যে এত বিপদ মাথায় করে তিনি ক্লাসে যাচ্ছেন? “দুই জন” উত্তর দিলেন প্রফেসর। ড্রাইভার অবাক হল উত্তর শুনে। মাত্র দুই জন ছাত্রের জন্য এই ঝড়ের মধ্যে না গেলেই কি হত না? প্রফেসর কোন উত্তর দিলেন না। কয়েক বছর পরে ওই ড্রাইভারকে তিনি বললেন যে সেই দু’ জন ছাত্র নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। এই দুই ছাত্র ছিলেন লি ও ইয়ং।  আরেকটা গল্প শিল্পী কালিকা প্রসাদের বলা। তার সাথে কথা প্রসঙ্গে বাউল আব্দুল করিম বলেছিলেন যে যদি একজন শ্রোতাও উপস্থিত থাকে তিনি গান গাইবেন। কারণ বাউল হিসেবে তার কর্তব্য গানের দর্শন মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, কত জন মানুষ সেটা বড় কথা নয়। আসলে শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব তো পড়ানো, শেখানো, কত জন মানুষকে শিক্ষাচ্ছি সেটা তো বড় কথা নয়! শিক্ষক যদি ছাত্র বান্ধব না হয় তাহলে শিক্ষা ব্যাপারটাই মাটি হয়ে যায়। আমি আমার ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকদের ছাত্রদের প্রতি ভালবাসা সব সময়ই অনুভব করেছি। তবে এটা ঠিক, এর জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ দরকার।

গত বছর এক লেখায় বলেছিলাম যে ফিজিক্সের সবকিছুর বাংলা পরিভাষা দরকার নেই, কেননা শুধু ফিজিক্স নয়, প্রতিটি বিষয়ে টেরমিনোলোজিগুলো এক বিশেষ অর্থ বহন করে। আমরা যখন ব্ল্যাক হোল বলি সেটা কালো কোন গর্ত নয়, এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোন বস্তু যাকে বিশেষ গাণিতিক ভাষায় প্রকাশ করা হয়। এখানে আসল কথা এক বিশেষ আইডিয়া। আমাদের কাছে লাল সবুজ শুধু দুটো রঙ নয় বা লাল ও সবুজ রঙের এক টুকরো কাপড় নয় এটা আমাদের পতাকা যা একটা বিশেষ ধারণা বহন করে। তাই পরিভাষার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে ওই ধারণাগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দান করা। ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা সকল পর্যায়েই। আগে একটা পর্বে বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে এমনকি উচ্চ শিক্ষাও শুধু রুশ ভাষা নয় বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় দান করা হত, ছাত্ররা নিজেরাই ঠিক করত সে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করবে নাকি রুশ ভাষায়। মাতৃভাষায় শিক্ষা শুধু বিষয়টা ভালো ভাবে আয়ত্ব করতেই সাহায্য করে না অনেক ক্ষেত্রেই নিজের দেশে কাজ করতে উৎসাহী করে তোলে।

কিছুদিন আগে পাঠ্য বইয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে দুটো প্যারাগ্রাফ হুবহু তুলে দেবার অভিযোগে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ এসেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মৌলিক গবেষণা আর টেক্সট বুক – এই দুটো ব্যাপার এক নয়। মৌলিক গবেষণা এটা লেখকের নিজস্ব কাজ। সেটা হতে পারে আগের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করা অথবা আগের তত্ত্ব সঠিক ভাবে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় না বিধায় সেটাকে সংশোধন বা পরিপূর্ণ করা। এসব ক্ষেত্রে নকল শুধু অবাঞ্ছনীয় নয়, গুরুতর অপরাধ। ফলে আজকাল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত জার্নালে লেখা জমা দেবার সময় লিখিত দিতে হয় যে গবেষণা লেখকের নিজের কাজ। অন্যদিকে পাঠ্য পুস্তকের কাজ শিক্ষার্থীদের কাছে সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব তুলে ধরা। এখানে মূল কাজ শিক্ষার্থীদের সঠিক ভাবে শিক্ষা দেওয়া। বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো অনেকটা আইনের মত, প্রতিটি শব্দ সঠিক জায়গায় সঠিক ভাবে লেখা একান্ত অপরিহার্য। তাই মৌলিক গবেষণায় অন্যের ফলাফল নিজের বলে চালিয়ে দেয়া আর আর পাঠ্য পুস্তকে কোন ভাল বই থেকে দু একটি প্যারাগ্রফ তুলে দেয়া এক নয়।

১৯৯৮ সাল। দুবনায় ইন্ডিয়া থেকে বিশাল ডেলিগেশন এসেছে। সেখানে আমার এক পরিচিত ছিলেন। নামকরা পদার্থবিদ। আমার চেয়ে বছর দশেক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতে এসেছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে গেছেন। বাসায় নিমন্ত্রণ করলাম। গল্পগুজব হল। তখন আমাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে। আমার স্ত্রী আবারও সন্তানসম্ভবা। বলে রাখি আমাদের ছেলেমেয়ের সংখ্যা চার। উনি একটু অবাক হয়েই বললেন যে ভারতের আকাডেমিক সার্কেলে ছেলেমেয়ে হয় শূন্য নয়ত এক। আমি হেসে বললাম ডিজিটাল যুগে কেউ শূন্য আর একের বাইরে চিন্তাই করতে পারে না। আমরা প্রায়ই আমাদের জনগণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করি যে তারা শিক্ষিত নয়, তারা ধর্মে অন্ধবিশ্বাসী। কিন্তু আমরা নিজেরা যদি সন্তান নিতে অনাগ্রহী হই তাহলে দেশের জনসংখ্যায় এদের হার তো বাড়বেই। তার উপর আমরা যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের ইউরোপ আমেরিকার জন্য গড়ে তুলি তাহলে দেশ নিয়ে এই হা-হুতাশ করেই বা কী লাভ?

ইদানিং ফেসবুকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেটিং নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। যারা রেটিং করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এই নিয়মগুলো তারা করে নিজেদের কথা মাথায় রেখে। রেটিং শুধু প্রেস্টিজ নয়, অর্থও। আর আজকাল সবই বানিজ্যিক, এমনকি যুদ্ধও। মানবতা, মানবাধিকার এসব আসলে নিজেদের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করার একেকটা মোড়ক যা আমরা সাধারণ মানুষ চোখ বন্ধ করে কিনি। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি অগাধ বিশ্বাস পশ্চিমা সবকিছুতে আমাদের অন্ধবিশ্বাসী করে তুলেছে। আর অন্ধবিশ্বাস – এটাই মৌলবাদ। সেই অর্থে আমরা যারা পশ্চিমা গণতন্ত্রের অন্ধ পূজারী তারাও এক ধরণের মৌলবাদী। মৌলবাদের ধর্মীয় রূপ নেই। মৌলবাদ অন্ধবিশ্বাস – তা সে ধর্মেই হোক, সমাজতন্ত্রেই হোক, গণতন্ত্রেই হোক আর বিজ্ঞান বা যা কিছুতেই হোক। আমার মনে পড়ে সোভিয়েত আমলের কথা যখন আমার বন্ধুদের কেউ কেউ লেনিনকে ভগবানের মত মনে করত। এখনও আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক নেতা বা খেলোয়াড় তাদের ভক্তদের কাছে ঈশ্বর তুল্য। আসলে এটা মানুষের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। কেউ যুক্তিবাদী, কেউ ভক্তিতে বিশ্বাসী। তার সামনে যদি ঈশ্বর না থাকে সে কোন নেতাকে ঈশ্বর বানিয়ে পূজা করবে। আবার কাউকে পছন্দ না হলে সে তাকে শয়তান বানিয়ে তার প্রতি কারণে অকারণে ঢিল ছুঁড়বে।  এদের দেখার জন্য খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, আয়নায় তাকালেই আমরা অনেকেই নিজেদের মধ্যেই এসব অন্ধবিশ্বাসী মৌলবাদীদের দেখতে পাব।

যাহোক, কথা হচ্ছিল রেটিং নিয়ে। রেটিংএ স্থান না পাওয়া নিঃসন্দেহে লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু এটাই কি সব? আমি দেশে থাকাকালীন আমাদের বানিয়াজুরী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শুধু কায়কোবাদ ভাই বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে বুয়েটে আছেন। এর পর আমি। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি ব্যাচের ভালো ছাত্রছাত্রীরাই বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে, সবাই আজ প্রতিষ্ঠিত। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর ছেলেমেয়ে বাইরে যায় পিএইচডি করার জন্য আর প্রায় সবাই সেসব দেশেই থেকে যায়। দেশের পড়াশুনা যদি এতটাই নীচু মানের হত তাহলে এরা কি বাইরে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারত? আমার ধারণা রেটিংএর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো ছাত্রছাত্রীদের দেশে কর্ম সংস্থান করা, প্রতি বছর দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে চলে যাবে আর তারপর আমরা ভালো রেটিং আশা করব সেটা তো হয় না। মনে রাখবেন একজন বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে দেশের জনগণ বিশাল অংকের টাকা খরচ করে। এমনকি ফুটবল ক্লাবগুলো তাদের তৈরি খেলোয়াড়দের বড় কোন ক্লাব কিনলে সে জন্যে মোটা অংকের কমপেনসেশন পায়। আর দেশ? তাই আমরা যখন শিক্ষা খাঁতে বাজেট বাড়ানোর কথা বলি সেটা হওয়া উচিৎ শিক্ষা ও কর্ম সংস্থান খাঁতে। আগে আমরা ইউরোপ আমেরিকার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করতাম, এখন কাঁচা বিশেষজ্ঞ সরবরাহ করি। এটা যতদিন চলবে আমরা অনন্ত কাল ধরে উপনিবেশ হয়েই থাকব।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো