বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষকের অনেক পদ শুন্য।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন যে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকের যত পদ আছে তার প্রায় অর্ধেকই এখন খালি এবং এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন যে মেডিকেল কলেজগুলোতে সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ হয় না।

আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন কিছু বিষয়ে পড়তে অনাগ্রহের কারণে চিকিৎসকদের মধ্যেই পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে না বলে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শিক্ষক সংকট তৈরি হয়েছে।

মেডিকেল অফিসার হিসেবে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক নিয়োগ হয়ে বিসিএসের মাধ্যমে। সেখান থেকেই প্রভাষক পদের জন্য আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ বলছে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বেসিক সাবজেক্ট হিসেবে পরিচিত বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীও পাওয়া যায় না, তাই শিক্ষকও তৈরি হচ্ছে না।

যদিও এ সংকট নিরসনে ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনা করছে কর্তৃপক্ষ এবং এটি হলে ভর্তি পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে পাওয়া বিষয়েই পড়তে হবে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের।

চিকিৎসার মৌলিক বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ কম বাংলাদেশে।
চিকিৎসার মৌলিক বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ কম বাংলাদেশে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বলেছেন

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত রোববার জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন যে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজে ৫,৫৮৯টি অনুমোদিত ক্যাডার পদের বিপরীতে ২,৬০৫টি শিক্ষক পদ খালি রয়েছে।

একজন সংসদ সদস্যের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল কলেজগুলোতে সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ করা হয় না। মেডিকেল কলেজের প্রভাষক পদে মেডিকেল অফিসার থেকে বিষয়ভিত্তিক পদায়ন করা হয়।’

অনেক বিষয়ে ছাত্র শিক্ষক কিছুই পাওয়া যায় না

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ এএফএম রুহুল হক পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছিলো সব মেডিকেল কলেজেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক সংকট রয়ে গেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনটি গত বছরের মার্চে প্রকাশ করা হয়েছিলো। তখনই জানা গিয়েছিলো যে দেশের অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল নেই। আর বেশিরভাগ কলেজেই শিক্ষকের পদ শূন্য আছে।

সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ঘাটতি কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে মেডিকেলের পরিভাষায় বেসিক সাবজেক্ট হিসেবে পরিচিত কিছু বিষয়ে ছাত্র শিক্ষক কিছুই পাওয়া যায় না।

এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে সরকারি মেডিকেলে বেসিক সাবজেক্ট বা মৌলিক বিষয়গুলোতে প্রায় দুই হাজার পদের মধ্যে সাতশোর বেশি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট অধ্যাপক পদে।

এসব কলেজে অধ্যাপকের ২০৪টি পদের বিপরীতে মাত্র ৭০ কাজ করছেন। যদিও চিকিৎসকদের অনেকে অভিযোগ করে থাকেন নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ার কারণে অনেক বিষয়ে উচ্চপদে শিক্ষক আসার সুযোগই পাচ্ছে না।

একটি মেডিকেল কলেজে কতজন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন, তা সেই কলেজের কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে না। বরং এটি নির্ধারণ করে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল।

এই কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের একজন অধ্যাপক ডা: মো: শরফুদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন মেডিকেল কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়াতে শূন্য পদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে কারণ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশে লোকবল একদমই তৈরি হয়নি।

এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, এনেস্থেশিয়া এবং ভাইরোলজিসহ কিছু বিষয় আছে যেগুলোকে বেসিক সাবজেক্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

এর মধ্যে কিছু বিষয়ে কয়েকটি কলেজে শুধু প্রভাষক পদের শিক্ষক কাজ করছেন। এর উপরের পদগুলোতে নিয়োগের জন্য লোকবলই নেই।

মেডিকেল কলেজের শিক্ষক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়মিত না হওয়াও শিক্ষক সংকটের একটি কারণ।
মেডিকেল কলেজের শিক্ষক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়মিত না হওয়াও শিক্ষক সংকটের একটি কারণ।

‘বেসিক সাবজেক্টে ছাত্র বাড়াতে হবে’

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীই খুব একটা পাওয়া যায় না বলে বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও হাতে গোনা। ফলে সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের উচ্চপদগুলোতে নিয়োগের জন্য বিশেষজ্ঞ পাওয়া যায় না।

এমবিবিএস পাশ করার পর চিকিৎসকরা সাধারণত মেডিসিন, গাইনি, সার্জারির মতো বিষয়গুলো বেশি পড়তে চান। এসব বিষয়ের শিক্ষকরা কলেজের কার্যক্রমের বাইরে প্রাইভেট প্রাকটিস করে প্রচুর অর্থ আয়ের সুযোগ পান বলে ধারণা আছে।

শরফুদ্দিন আহমেদ বলছেন বেসিক সাবজেক্টের কোর্সগুলোতে ছাত্র সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং কলেজগুলোতে নতুন নতুন কোর্স খুলতে হবে।

“এর মধ্যে অনেক কোর্সে ছাত্র বেড়েছে। তবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে আরও বাড়াতে হবে বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য। প্রয়োজনে ইনসেনটিভ দিতে হবে। সবমিলিয়ে এসব বিষয়ে শিক্ষক তৈরির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগুতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মূলত শিক্ষক না থাকার কারণেই অনেক সরকারি কলেজে পদ থাকলেও সে অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কোথাও কোথাও একই শিক্ষক কাছাকাছি এলাকার দুটি কলেজে গিয়ে একই বিষয় পড়াচ্ছেন।

তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষক সংকটের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

অধিদপ্তর অবশ্য মনে করছে নিয়মিত নিয়োগ আর পদোন্নতি হলে দ্রুতই শিক্ষক সংকট কেটে যাবে।

“করোনার দুই বছর নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়নি। এ দুটি বিষয় ঠিক মতো বা নিয়মিত হলে সংকট থাকে না। মন্ত্রণালয় এগুলো দেখভাল করছে। আশা করছি সংকট কেটে যাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল বাশার মো: জামাল।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব নীতিশ চন্দ্র সরকার বলছেন সরকার ইতোমধ্যেই শিক্ষক সংকট কাটাতে বেসিক বিষয়ের উচ্চপদে থাকা শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ বেশি বেতন দিচ্ছে।

“এখন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা তাদের ইচ্ছেমতো বিষয়ে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করে। তবে আমরা নীতিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছি। সেটি হলে মেধা অনুযায়ী পাওয়া বিষয়ে পড়তে হবে। তখন সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়ে যাবে। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রাকিব হাসনাত, বিবিসি বাংলা, ঢাকা #