চলমান সংবাদ

সাংবাদিককে গায়েব করতে না পেরে নির্যাতনের অভিযোগ

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় এক সাংবাদিককে আটকের পর পুলিশ হেফাজতে ইলেকট্রিক শক দেয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ-র বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ তিনি ককটেল মেরেছেন এবং চাঁদাবাজি করেছেন৷

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি এবং বাংলা ৭১ পত্রিকার সাতক্ষীরা প্রতিনিধি রঘুনাথকে সোমবার সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে আটক করা হয়, তবে গ্রেপ্তার দেখানো  হয় পাশের উপজেলা দেবহাটা থানায়৷ মঙ্গলবার বিকেলে তাকে আদালতে তোলা হলেও তার পরিবারকে মামলার নথি না দেয়ায় এখনো জামিনের আবেদন করা যায়নি৷

দুই কানে ইলেকট্রিক শক!

সাংবাদিক রঘুনাথের স্ত্রী  সুপ্রিয়া রাণী খাঁ বৃহস্পতিবার দুপুরে ডয়চে ভেলেকে বলেন, তিনি আতঙ্কে আছেন৷ তিনি জানান, মঙ্গলবার বিকেলে রঘুনাথ খাঁ-কে যখন আদলতে আনা হয় তখন তার সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে৷ সুপ্রিয়া রানী খাঁ বলেন, ‘‘তাকে যখন আদালতে আনা হয় তখন তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না৷ দাঁড়িয়ে থাকতেও তার কষ্ট হচ্ছিল৷’’

সুপ্রিয়া রানী খাঁ-র দাবি রঘুনাথ জানিয়েছেন তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ, ‘‘তিনি আমাকে জানান, তার কানে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে৷ তার ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছে ৷ হাতের আঙুল ভেঙে দেয়া হয়েছে৷ হাতের তালু, পায়ের তালু মেরে ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে৷ থানায় তার কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়নি৷ কারাগারে পাঠানোর পর আমরা সেখানকার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে পাঠিয়েছি৷’’

সাংবাদিকের স্ত্রীর আরো দাবি, ‘‘তাকে (রঘুনাথ খাঁ) গায়েব করে দিতো৷ কিন্তু তাকে আটকের পর আমি সব ভয় ভুলে গিয়ে তাকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করি৷ তাই শেষ পর্যন্ত গায়েব করতে পারেনি৷ আটকের সাত ঘণ্টা পর মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়৷’’

সুপ্রিয়া রানী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে দেখা হওয়ার পর তিনি (রঘুনাথ খাঁ) আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ বলেন, ‘আমার কিছু রাখেনি৷ আমাকে আর পাওয়া যেতো না৷ শুধু ঈশ্বরের কৃপা আর সবাই জেনে যাওয়ায় আমি এখনো আছি৷’’

রঘুনাথকে অন্তত দু’দফা নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে- প্রথমে এসপি অফিসে, তারপরে থানায়৷

প্রথমে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের সঙ্গে ভয়ে কথা বলতে চাননি সুপ্রিয়া রানী৷ পরে সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত করার পর তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন ভয় আর আতঙ্কে আছি৷ সাংবাদিকরাও সহায়তা করছেন না ভয়ে৷ জামিনের জন্য আইনজীবী পাবো কিনা জানি না৷ যারা সহায়তা করবে, তাদের সবাইকেই হুমকি দেয়া হচ্ছে৷’’

কথিত অভিযোগ ও আটকের পূর্বাপর

রঘুনাথ খাঁ সোমবার ভোরে পেশাগত প্রয়োজনে ভাড়া করা মোটরসাইকেলে চড়ে দেবহাটার খলিসাখালী যান৷ সেখানে সরকারের এক হাজার ৩০০ একর খাস জমি নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিহীনদের দ্বন্দ্ব চলছিল৷ ভূমিহীনরা ওই জমিতে অবস্থান করতে চান আর প্রভাশালীরা দখলে নিতে চান৷ এ নিয়ে উত্তেজনা চলছিল৷ সুপ্রিয়া রানী খাঁ বলেন, ‘‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি সাতক্ষীরা শহরে ফিরে বাজার থেকে আমাকে ফোন করেন৷ এর কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেল চালক তারেক আমাকে ফোন করে বলে তাকে (রঘুনাথ) বাসায় ফেরার পথে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে৷ তাকে ধরা হয় পিএন হাইস্কুল ও দিবা-নৈশ  কলেজ মোড় এলাকা থেকে৷ তারপর আমি আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি৷ কোথায় আছে তা-ও জানতে পারিনি৷ পরের দিন বিকেলে আদালতে আনা হলে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়৷’’

সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ৷
সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ৷

রঘুনাথ খাঁ-কে সাতক্ষীরা সদর থেকে আটক করা হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ৩০  কিলোমিটার দূরের আরেক থানা দেবহাটায়৷ মামলা করা হয় আটকের সাত ঘণ্টা পর৷ তারও চার ঘন্টা পরে তাকে আটকের কথা স্বীকার করে পুলিশ৷ এর আগ পর্যন্ত পুলিশ সাংবাদিকদের কাছে আটক বা গ্রেপ্তারের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে৷ আটকের পর রঘুনাথের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইন ও চাঁদাবাজির দুটি মামলা করা হয়৷ দেবহাটা থানার ওসি শেখ ওবায়দুল্লাহ বলেন,‘‘দেবহাটা থানার সাপমারা খাল ব্রিজ এলাকায় নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সোমবার সকালে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে পুলিশ রঘুনাথ খাঁ ও তার তিন সহযোগীকে আটক করে৷ তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা করেছে৷ এছাড়া স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন৷’’

শেখ ওবায়দুল্লাহর দাবি, ‘‘রঘুনাথ খুব খারাপ লোক৷ এর আগে একটি মামলায় তার চার বছরের কারাদণ্ড হয়েছে৷ তবে সেটা নাকি স্টে আছে৷’’

রঘুনাথকে সাতক্ষীরা শহর থেকে আটকের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘তাকে দেবহাটা থেকেই আটক করা হয়৷ আর তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি৷ তার স্ত্রী তো অভিযোগ করবেই, এরকম অভিযোগ তো অনেকেই করতে পারেন৷’’

অন্যদিকে রঘুনাথের স্ত্রী বলেন, ‘‘তিনি (রঘুনাথ) প্রশাসনের রোষানলে ছিলেন৷ তিনি তাদের বিরুদ্ধে অনেক রিপোর্ট করায় তারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন৷ স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যেও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে অনেক গ্রুপিং আছে৷ এইসব মামলা তারই ফল৷ আমাদের তেমন কিছু নেই৷ আমার স্বামী পেশাগত কাজে ব্যবহারের জন্য চেষ্টা করেও একটি মোটরসাইকেল কিনতে পারেননি৷ একটি ভাঙা বাড়িতে কোনোমতে থাকি৷ আমাদের দুই ছেলে-মেয়ে৷ ছেলেটি ঢাকায় পড়াশুনা করে আর মেয়েটি আমাদের সঙ্গে থাকে৷’’

তার কী পরিমাণ সম্পদ আছে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ বাপি বলেন, ‘‘না, তার তেমন কোনো সম্পদ বা অর্থ-বিত্ত নেই৷’

রঘুনাথকে আটক ও নির্যাতনের ব্যাপারে সাতক্ষীরার সাংবাদিকদের এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি তাদের তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদের কথাও জানা যায়নি৷ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, এ মুহূর্তে সাংবাদিকরা ‘চাপ ও হুমকির মুখে’  প্রতিবেদনও  লিখতে পারছেন না, যারা প্রতিবেদন লিখেছেন তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হুমকি দিচ্ছে৷ দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের সাতক্ষীরা প্রতিনিধিকে এসপি অফিসে ডেকে নিয়ে আর  প্রতিবেদন না করার জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা৷

সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ বাপির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান৷ রঘুনাথ খাঁ-কে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘রঘুনাথের স্ত্রী আমাদের কিছু জানায়নি৷’’

সাতক্ষীরার মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, ‘‘আমরা তাকে (রঘুনাথ খাঁ) গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না৷ তদন্ত করার পর বলতে পারবো৷’’

এদিকে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নাালিস্ট (সিপিজে) এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান এর আগে রঘুনাথকে তার প্রতিবেদেনের কারণে একাধিকবার গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছেন৷ রঘুনাথের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিষয়টি রেঞ্জ ডিআইজিকে জানিয়েছিলেন রঘুনাথ, তবে কোনো প্রতিকার পাননি৷

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘কোনো সাংবাদিককে আমি হুমকি দেইনি৷ এখন তো সাংবাদিকরা আমাকে হুমকি দিচ্ছে যে, আমি রঘুনাথকে কেন গ্রেপ্তার করেছি৷ যে যা-ই বলুক আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাবো৷’’

তিনি দাবি করেন, ‘‘রঘুনাথ সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে৷ তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে৷ সে সন্ত্রাসীদের নিয়ে বোমা ফাটিয়ে ঘের দখল করতে গিয়েছিল৷ পুলিশ তাকে হাতেনাতে ধরেছে৷’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অবশ্যই তাকে রিমান্ডে আনা হবে৷ সরকারের বিরুদ্ধে যত কাজ আছে সবই সে করছে৷ তার বিরুদ্ধে আরো অনেক মামলা আছে৷’’

রঘুনাথকে তিনি চাঁদাবাজ দাবি করলে প্রশ্ন করা হয়- তাহলে তার অর্থ-বিত্ত নেই কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ডাকাত কখনো ধনী হয় না৷’’ রঘুনাথ খাঁ-কে নির্যাতনের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি৷

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘রঘুনাথ খাঁ’র ব্যাপারে আমাদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল৷ তিনি প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশের নানা অনিয়ম নিয়ে অনেক দিন ধরেই রিপোর্ট করছেন৷ তিনি পুলিশের রোষানলে ছিলেন৷ সোমবার সেই কারণেই তাকে আটক করা হয়৷ পুলিশ, বিশেষ করে এসপি সাহেবের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তিনি৷ সংবাদ মাধ্যমে তাকে নির্যাতনের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা বর্বরোচিত ও নৃশংস৷ এর জন্য দায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এসপি সাহেব যে ভাষায় ওই সাংবদিকের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তার আচরণ এবং কথায় মনে হচ্ছে, তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই৷ তিনি যা খুশি তা করতে পারেন৷ সরকারের উচিত এর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া৷’’দ

# হারুন উর রশীদ স্বপন,  ডয়চে ভেলে, ঢাকা #