মোবাইল ফোন হাতে একজন নারী
মোবাইল ফোনে আড়ি পেতে তথ্য হাতিয়ে নেয়া হয় প্রযুক্তির সাহায্যে

সম্প্রতি ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ থাকার পরও বাংলাদেশের কাছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করা হয়েছে।

সংবাদপত্রটির এমন প্রতিবেদনের পর বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক চলছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে তারা ইসরায়েলের কাছ থেকে ‘সরাসরি’ কিছু কিনে নাই।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৃহস্পতিবার সংসদে বলেন যে, তারা রাষ্ট্র এবং সরকার-বিরোধী তৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে নজরদারী বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে।

একই দিন, দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে বা টিআইবি এক বিবৃতিতে ইসরায়েল থেকে নজরদারী সরঞ্জাম ক্রয়ের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

তারা নজরদারীর এই প্রযুক্তিকে ”অধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার” হিসেবে বর্ণনা করে বলে, এ’ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যক্তিগত তথ্যর গোপনীয়তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে।

বাংলাদেশে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, এমন অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, এ’ধরনের প্রযুক্তির অপব্যবহার হলে দেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না।

তাদের মতে, সরকার তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন সংশোধন করে, নতুন বিধি-বিধান তৈরি করে। ফলে, প্রযুক্তি ক্রয় বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা আর থাকে না।

তবে বাংলাদেশ এই প্রথম কোন ইসরায়েলি কোম্পানির কাছ থেকে প্রযুক্তি কিনছে না।

এর আগে ২০২১ সালে, কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে একই ধরনের নজরদারী প্রযুক্তি কেনার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।

নজরদারীর হাতিয়ার স্পেয়ারহেড

হারেৎজ পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আধুনিক সাইবার টুল বা হাতিয়ার এই প্রযুক্তি স্পেয়ারহেড নামে পরিচিত।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে, আধা কিলোমিটার পরিধিতে থাকা সব ডিভাইসে হোয়াটসঅ্যাপের এনক্রিপ্টেড বার্তা, ফেসবুকের চ্যাট, কন্ট্যাক্ট লিস্ট, কল এবং বার্তায় প্রবেশ করা যায়।

রপ্তানীর বিভিন্ন নথির কথা উল্লেখ করে হারেৎজ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জুন মাসে একটি স্পেয়ারহেড সিস্টেম সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো হয়।

প্যাসিরোটা নামে একটি প্রতিষ্ঠান এটি সরবরাহ করে এবং এটি কিনে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা সংক্ষেপে এনটিএমসি।

পুরো শিপমেন্টের ওজন ছিল ৯৯১ কেজি যার মধ্যে রয়েছে নেটওয়ার্কে ইন্টারসেপশন সিস্টেম, এটি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সফ্টওয়্যার এবং সার্ভার, ড্রাইভ ও মনিটরের মতো হার্ডড্রাইভ উপাদান। এর মোট খরচ হয়েছিলো ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার।

হারেৎজ বলছে, এনটিএমসি বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যম ট্র্যাকিং, অনলাইনে সেন্সর দেয়া এবং নাগরিকদের উপর আড়িপাতার কাজ করে থাকে।

হারেৎজ এর প্রকাশিত খবর
হারেৎজ এর প্রকাশিত খবর

কিভাবে কাজ করে স্পেয়ারহেড?

হারেৎজ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্যাসিটোরা নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি তৈরি করে যার মালিকানা ইসরায়েলের গোয়েন্দা প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক কমান্ডার তাল দিলিয়ানের।

তিনি ফোর্বসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, স্পেয়ারহেড নামে একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম রয়েছে। সেসময় কোম্পানিটির নাম ছিল ওয়াইস্পেয়ার।

এই ব্যবস্থায় একটি ভ্যান থাকে, যার মধ্যে নজরদারির বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ট্র্যাক করার সফ্টওয়্যার থাকে, যা ফোনের নিজস্ব নেটওয়ার্ক বা ওয়াইফাই ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের তথ্য সংগ্রহ করে।

এর মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপের এনক্রিপ্টেড বার্তা, ফেসবুকের চ্যাট, কন্ট্যাক্ট লিস্ট, কল এবং বার্তায় প্রবেশ করা যায়। আধা কিলোমিটার পরিধিতে থাকা সব ডিভাইসের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য হবে।

এর আগে ওয়াইস্পেয়ার এর এক উপস্থাপনায় বলা হয় যে, এই পরিধির মধ্যে থাকা মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে স্প্যাইওয়ারও ঢুকিয়ে দেয়া যায় এই প্রযুক্তির মাধ্যমে।

ঝুঁকিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

প্রযুক্তিবিদ সাবির আহমেদ সুমন বলেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন মোবাইল ফোন ট্যাপ করা সম্ভব। ওই ফোনে কী কল আসছে, কী কথা হচ্ছে, কী ধরণের বার্তা আসছে তা সবই জানা সম্ভব।

মি. আহমেদ বলেন, কোন ব্যক্তির অগোচরেই তার ব্যবহৃত ফোনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব। তার মতে, কারো ব্যক্তিগত ফোন নজরদারির আওতায় আছে কিনা তা বুঝতে হলে এক জন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।

“এদিক দিয়ে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ শক্তিশালী। তারা চাইলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।”

তিনি বলেন, এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করা হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কিছু থাকে না। আর তাই বিশ্বের অনেক দেশে এটি আইনগত ভাবে বৈধ নয় বলেও উল্লেখ করেন।

যেসব দেশে মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে সেখানকার নীতি হচ্ছে, কোন ব্যক্তিকে যদি কোন সরকার বিপজ্জনক, তাকে নজরদারিতে আনা দরকার, তাহলে প্রথমে একটি পুলিশ রিপোর্ট করতে হয়। পরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা সংস্থা তাকে ট্যাপ করতে পারে।

তবে বাংলাদেশে এই চিত্রটি ভিন্ন।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, কোন ব্যক্তির অগোচরেই তার ব্যবহৃত ফোনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব স্পিয়ারহেডের মাধ্যমে
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, কোন ব্যক্তির অগোচরেই তার ব্যবহৃত ফোনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব স্পিয়ারহেডের মাধ্যমে

আইনে কোন বাধ্যবাধকতা নেই

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ডিজিটাল যুগে এই যোগাযোগ অনলাইন এবং অফলাইন-দুই ক্ষেত্রেই বিস্তৃত।

কলম্বোভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাইদ খান বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ ধরণের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অধিকার সরকারকে দেয়া হয়েছে।

এই আইন ২০১০ সালে সংশোধনের সময় এতে “টেলিযোগাযোগ” শব্দের পরিবর্তে “টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ” শব্দের ব্যবহার সংযোজিত হয়।

মি. খান বলেন, “এতে বলা আছে যে সরকার আইন ভাঙতে পারবে এবং এ সম্পর্কিত বিস্তারিত প্রক্রিয়া সংশোধনীতে বলা আছে।”

তিনি বলেন, আইনের বাইরেও সরকার নিজেদের প্রয়োজন মতো বিধি বিধান তৈরি করে। তাই আইনগতভাবে এমন প্রযুক্তি কেনার বিষয়ে কোন বাধা নেই।

ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে মি. খান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিসিএল যা বিটিটিবি বা বাংলাদেশ টেলিগ্রাম এন্ড টেলিফোন বোর্ড নামে সরকারের একটি বিভাগ ছিল।

“তারা ইসরায়েলের ইসিআই টেলিকমের তৈরি বিসিএমই নামে একটা যন্ত্র ব্যবহার করতো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিদেশে কল আদান-প্রদানের চ্যানেল সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।”

ইসরায়েল ছাড়া তখন ওই প্রযুক্তি আর কেউ তৈরি করতো না বলেও জানান তিনি।

নজরদারির এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকারকর্মীরাও।

বাংলাদেশে ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার ক্ষেত্রে ফোনে আড়িপাতা আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭১ ধারা অনুযায়ী, আড়িপাতা অপরাধ। এটি প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে।

তবে এই আইনও সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী ভাঙে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মি. খানের মতে, বাংলাদেশে যেখানে গুমের মতো ঘটনা ঘটে, সেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকই বটে।

তিনি বলেন, “সরকার যেখান মানুষ গুম করে, সেখানে আপনি এটা নিয়ে কী বলবেন? সরকার ভায়োলেন্ট করতেছে হিউম্যান রাইটস, সরকার নিজের আইন নিজেই ভাঙতেছে।”

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ক ধারা অনুযায়ী সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না বলে শর্ত রয়েছে।

ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য

বাংলাদেশ ইসরায়েলকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং দুই দেশের মধ্যে কোন কুটনীতিক সম্পর্ক নেই।

এমনকি ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাসপোর্টে “এই পাসপোর্ট ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সব দেশের জন্য প্রযোজ্য” লেখা থাকতো।

তবে ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দাপ্তরিকভাবে কোন ঘোষণা বাংলাদেশে নেই।

হারেৎজ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করা হয়েছে।

তবে ইসরায়েল যেসব দেশের কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করতে পারে সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। কারণ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ রয়েছে বলেও হারেৎজের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে।

ইসরায়েল থেকে ক্রয়ের ইতিহাস

তবে ইসরায়েল থেকে নজরদারি যন্ত্রপাতি কেনার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০২১ সালে হারেৎজ সংবাদপত্রেই আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, ইসরায়েলি কোম্পানি সেলেব্রাইট বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র‍্যাবের কাছে মোবাইল ফোন হ্যাকিংয়ের সরঞ্জাম বিক্রি করেছে।

আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, পিকসিক্স নামে আরকেটি ইসরায়েলি কোম্পানি বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে মোবাইল ফোন ট্রান্সমিশনে আড়ি পাততে পারে এমন একটি ফোন হ্যাকিং ও নজরদারি ব্যবস্থা বা সিস্টেম বিক্রি করে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক নথির উল্লেখ করে হারেৎজ তাদের প্রতিবেদন বলেছে যে, ২০১৯ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইও ওয়াই-ফাই যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে ৩০ লাখ ডলার দিয়ে একটি সিস্টেম কিনেছে প্রিলিসিস নামে একটি কোম্পানীর কাছ থেকে। এই কোম্পানিটও ইসরায়েল ও সাইপ্রাসে নিবন্ধন করা।

স্পেয়ারহেড প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপের বার্তাও পাওয়া সম্ভব
স্পেয়ারহেড প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপের বার্তাও পাওয়া সম্ভব