বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(৭৭): তথ্য – সত্য ও মিথ্যা

– বিজন সাহা  

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় লেখালেখি করি। কখনও কখনও বন্ধুদের সাথে কথা বলি। স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্ন সামনে চলে আসে তা হল এসব খবরের উৎস কি? আমার ক্ষেত্রে খবরের উৎস বিভিন্ন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুই পক্ষের খবর আসে টেলিগ্রাম চ্যানেলে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে লেখা ও ছবি আসে। এছাড়া আছে রাশিয়ার অফিসিয়াল ও সরকার নিয়ন্ত্রিত টিভির খবর, আছে বিবিসি, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। তবে সবচেয়ে বড় কথা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য পেয়ে নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে উপসংহারে আসা। কারণ উপরের মাধ্যমগুলো সবাই কমবেশি বায়াস – এরা নিজ নিজ পক্ষের কথা বলে, বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছবি, বিশেষ করে লাইভ সম্প্রচার মিথ্যা বলে না। কিন্তু ঠিক কী কারণে কোন ঘটনা ঘটছে সেটা যদি জানা থাকে, তাহলে এসব তথ্য ব্যবহার করে কমবেশি একটা অবজেক্টিভ পিকচার পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। আমি অন্তত সেটাই চেষ্টা করি। তাছাড়া বাইরের সংবাদ মাধ্যমে এ দেশ সম্পর্কে যেসব খবর দেওয়া হয় সেটা নিজেরা যাচাই করতে পারি। যেমন দেশ থেকে অনেক সময় আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুরা ফোন করে আমাদের অবস্থা জানতে চায়, বলে তারা শুনেছে এখানে দোকানে খাবার দাবার নেই ইত্যাদি। কিন্তু দোকান যখন খাবার দাবার দিয়ে ভর্তি (উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুদ্ধ শুরুর পর পর প্রথম কয়েকদিন চিনির অভাব দেখা দিয়েছিল, তবে পরে ধরা পরে সেটা ছিল কয়েকটা চেইন স্টোরের ষড়যন্ত্র – এই সুযোগে বাড়তি লাভ করার জন্য) তখন বুঝি এক সময়ের নামীদামী সংবাদ মাধ্যম আজকাল নিজদের স্বার্থে সাদাকে কালো দেখতে বা দেখাতে মোটেও দ্বিধাগ্রস্থ নয়। এটা অবশ্য আগেও দেখেছি সিরিয়ার খবরে। এটা ঠিক যে দ্রব্যমূল্য কিছুটা বেড়েছে। এটা এ দেশে মোটামুটি রেগুলার ভিত্তিতে হয়। তবে না ছেলেমেয়েদের, না বন্ধুবান্ধবদের, না সহকর্মীদের, না দোকানে অপরিচিত মানুষজনদের – কাউকে বলতে শুনিনি জিনিসপত্রের দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। কারণ বিভিন্ন সময়ে ডলারের দাম ওঠানামার ফলে হঠাৎ করেই কোন কোন জিনিসের দাম বেড়ে গেছে, এ নিয়ে লোকজন কথা বলেছে, বিভিন্ন ফোরামে লিখেছে। এখন সেটা নেই। কেন? এখন পশ্চিমা বিশ্বের স্যাঙ্কশনের ফলে অধিকাংশ জিনিস এখানেই তৈরি হচ্ছে, তাই দোকানে জিনিসের মূল্য আর ডলারের কোর্সের উপর আগের মত নির্ভরশীল নয়। আবার উল্টা এই স্যাঙ্কশনের ফলে বিশেষ করে ইউরোপের মার্কেটে জ্বালানী সংকট দেখা দিয়েছে, তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম আকাশ্চুম্বী হয়ে গেছে। আর আমরা তো নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি মানে সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি। ফলে অনেক দেশের সরকার তাদের জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছে ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে, নিয়মিত স্নান না করতে ইত্যাদি। এসব খবর পশ্চিমা মাধ্যম নিজেরাই দেখাচ্ছে আর সেটাই পরে এখানে প্রচার করা হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। ও আমার বছর তিনেক পরে মস্কো এসেছে। এখানেই থাকে। অনেকের সাথেই যোগাযোগ রাখে, রাজনীতি, যুদ্ধ এসব নিয়ে কথাবার্তা বলে, তর্ক বিতর্ক করে। আমার সেই সময়, সুযোগ, ইচ্ছে কোনটাই তেমন নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমি লিখতে যতটা পছন্দ করি, কাউকে ফোন করতে তততাই অপছন্দ করি। এমনকি ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত ফোন করা হয় না, যদিও কেউ ফোন করলে আগ্রহ নিয়ে গল্প করি। আমাদের সেই কথার সূত্র ধরেই কিছু প্রশ্ন বেরিয়ে আসে ওর মুখ থেকে আর সেটাই প্রশ্নোত্তরের ফর্মে আজকের লেখা।

আচ্ছা রাশিয়ান টিভি পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে যেসব রিপোর্ট করে সেটা কতটুকু সত্য? আপনি কি এদের রিপোর্ট বিশ্বাস করেন?
দেখ বিগত অনেক বছর যাবৎ এরা বলে আসছে আমেরিকা ইউক্রেনকে এন্টিরাশিয়া বানাতে চায়, রাশিয়ার উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায়। আগে মনে করতাম স্রেফ প্রোপাগান্ডা। কিন্তু ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড নিজেই স্বীকার করেছেন ইউক্রেনে পাঁচ বিলিয়ন ডলার খরচ করার কথা। আমেরিকা যদি আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট এসব তৈরি করতে পারে ইউক্রেনে উগ্র জাতীয়তাবাদী দল তৈরি করতে বাধা কোথায়? তারা তো সব সময়ই রাশিয়াকে শত্রু বলেই মনে করে আসছে। এখন কী আমেরিকা, কী ন্যাটো – নিজেরাই বলছে ২০১৪ সাল থেকেই ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে। আমরা সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে দেখছি। বায়োলজিক্যাল ল্যাবের কথা ন্যুল্যান্ড কংগ্রেসে স্বীকার করেছেন। মিনস্ক চুক্তি করা হয়েছিল ইউক্রেনকে অস্ত্র সজ্জিত করতে – এটা ওরা নিজেরা বলছে। তাই এদের খবর ডাহা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবার কারণ দেখি না।
কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের অনেক বন্ধুরা বলে তারা রুশ টিভি দেখে না কারণ সেখানে মিথ্যা ছাড়া কিছু বলেই না।
এটা আমাকে মাদ্রাসার ছাত্রদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওরা হুমায়ূন আজাদের লেখা ধর্মের অবমাননা করে বলে বিশ্বাস করে। তাঁর কোন লেখা পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে বলে ওরা কিছুই পড়েনি, তাঁর লেখা পড়া পাপ। তোমার বন্ধুরা দেখছি মাদ্রাসার ছাত্রদের মত। ডাহা মিথ্যা বলে অথচ কি খবর এরা প্রচার করে সেটা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। আমি এদের বলি মৌলবাদী।

এর মধ্যে ইংল্যান্ডে অনেকেই সেক্স ইন্ডাস্ট্রির শরণাপন্ন হয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। ওদের কথায় এটা ডাহা মিথ্যা। সেখানে সবাই বেকার ভাতা পায়। আপনি দেখছেন এই রিপোর্ট? কি মনে করেন এই খবর সম্পর্কে?

আমি দেখেছি এদের টিভিতে। তবে সেটা ছিল স্কাই নিউজ বা ইংল্যান্ডের অন্য কোন টিভির খবর। এর উত্তর আমি একটু অন্য ভাবে দেব। আমি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি সেই ১৯৮৩ সালে ইত্তেফাকে একটা নিউজ ছিল – স্তালিনের লৌহ যবনিকা তুলে সোভিয়েত মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে। বিশ্বাস করিনি। তবে আসার কিছুদিন পরেই দেখেছি এদেশে অনেকেই দেহ ব্যবসা করে। অবাক হয়েছি। কারণ এদের মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র মিটিয়েছিল। সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার গ্যারান্টি ছিল। আমরা যে সমাজ থেকে এসেছি সে তুলনায় এটা ছিল যাকে বলে স্বর্গরাজ্য। তাই এটা বলতে পারি অন্তত হোস্টেলের আশেপাশে যারা ঘুরত তারা খাদ্যের জন্য ঘুরত না, ঘুরত বিদেশি জিনিসের জন্য। জিন্সটা, কোন একটা নগণ্য বিদেশি পণ্য এসবই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এরপর থেকে কোন সম্ভাবনাই আমি উড়িয়ে দিই না। তাছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কোন কিছু ঘটার সম্ভাবনা অস্বীকার করে না। এমনকি দুই দুগুনে চার না হবার সম্ভাবনাকেও। তাছাড়া দেখ কোন দেশেই বেকার ভাতা বেতনের চেয়ে বেশি হয় না। লোকজন যেখানে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছে, যেখানে তেল গ্যাসের সাথে সাথে দ্রব্য মূল্য হু হু করে বাড়ছে সেখানে কেউ সেক্স ইন্ডাস্ট্রির শরণাপন্ন হতেই পারে। তাছাড়া আমাদের দেশে সেক্স কর্মীদের যেভাবে দেখা হয় ইউরোপ আমেরিকায়কিন্তু সেভাবে হয় না।  তারা সমাজের অন্য যেকোনো সদস্যের মতই। তাই আমি এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিই না। বরং অবাক হচ্ছি এতকাল উন্নত দেশে বাস করেও এরা মানসিক ভাবে এতটা পশ্চাদপদ রয়ে গেছে দেখে। কারণ আমার বিশ্বাস তুমি যদি বলতে লোকজন টিকে থাকার জন্য একাধিক কাজ করছে – এরা কেউ টু শব্দটি করত না। সেক্স ইন্ডাস্ট্রি কথাটাকে এরা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।
কিন্তু আপনার খবরের উৎস যে ঠিক, তারা যে মিথ্যা বলছে না সেটা কীভাবে বুঝবেন? কোন কিছু বিবেচনায় নেবার আগে তো সেটার সত্যতা বা নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও নিঃসন্দেহ হতে হবে।

সেটা ঠিক। আমি সাধারণত বিভিন্ন উৎস থেকে খবর জানার চেষ্টা করি। যারা কোন পক্ষের শুধুই গুন গায় বা শুধুই সমালোচনা করে তাদের দেখি একটা অভার অল আইডিয়া পাওয়ার জন্য। তবে অনেকেই আছে যারা ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলতে ভয় পায় না। দ্বিধা করে না। অনেক আগে এক পরিচিত ভদ্রলোক আফগানরা কেন সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করে এ ব্যাপারে একটা স্ট্যাটাসে প্রশ্ন রাখলে আমি বলেছিলাম সেটা জানতে হলে আমাদের সে দেশে আমেরিকা ও সোভিয়েত হস্তক্ষেপের কথা বিবেচনায় আনতে হবে। উনি বলেছিলেন এ ধরণের প্রশ্ন করা আসলে তালিবানদের উৎসাহিত করা। আমি এদের এড়িয়ে চলি। কারণ যদি কেউ কারণ না খুঁজে শুধু ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে আসে সেটা পক্ষপাতদুষ্ট হয়। যখন রাশিয়া কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে তখন অনেকেই এর সমালোচনা করেছিল যেভাবে সেটা করা হয়েছিল তার খারাপ দিকটা দেখিয়ে। অথবা সরকারি ভাবে সব ঠিকঠাক চলছে বললেও অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন ত্রুটির কথা বলে। এদের খবরে বুঝি এরা রাশিয়ার বিজয় চাইলেও প্রোপ্যাগান্ডার থেকে সঠিক অবস্থা প্রকাশে আগ্রহী আর সেটা করে যতটা না সরকারের সমালোচনা করতে তার চেয়ে বেশি সরকার যাতে সেনাদের ও স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তার প্রতি আরও যত্নশীল হয় সে জন্যে। তাই এদের বিশ্বাস করা যায়। কারণ সত্য গোপন করা বা সত্যকে আংশিক ভাবে প্রকাশ করা মিথ্যাকে উৎসাহিত করে। যারা এটা এড়িয়ে চলে তাদের আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। যদি প্রথম দিকে অনেক খবর যেমন মস্কো জাহাজ ডোবার সঠিক কারণ আমরা পেয়েছি অনেক দেরিতে, এখন এমনকি এঙ্গেলসে বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণের খবর আমরা প্রায় সাথে সাথেই জানতে পারি। আর এসব হচ্ছে এই সব সাংবাদিকদের কারণেই। এমনকি বর্তমানে বেশ কিছু কমিটি গঠন করা হয়েছে যেখানে এসব ক্রিটিক্যাল সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের যুক্ত করা হয়েছে। এসব করা হচ্ছে ফ্রন্টের সাথে সরকারের যোগাযোগ যাতে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক ও প্রশাসনের বাইরের লোকজনের মাধ্যমেও হয় সেটা নিশ্চিত করতে। আর এসবই এমনকি ঘটনার সরকারি ভার্সনের প্রতিও মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনছে।

কিন্তু এদেশের মানুষ কি সরকারকে বিশ্বাস করে?

কঠিন প্রশ্ন। আসলে বিভিন্ন দেশে মানুষ বিভিন্ন ভাবে সরকারকে কল্পনা করে। মনে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নে একটা স্লোগান ছিল – লেনিনের তৈরি স্লোগান – পার্টি ও জনগণ এক। কিন্তু লোকে কি পার্টিকে বিশ্বাস করত? তারা লেনিনকে বিশ্বাস করত, স্তালিনকে বিশ্বাস করত, খ্রুশেভ, ব্রেঝনেভ বা গরবাচভকে বিশ্বাস করত, কিন্তু পার্টিকে? মনে হয় না। কারণ সাধারণ মানুষ দেখত পার্টির লোকজন নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। ইয়েলৎসিনের সময় তারা না বিশ্বাস করত পার্টিকে না ইয়েলৎসিনকে। পুতিন তাঁর নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। কিন্তু সব জরীপ দেখায় তাঁর জনপ্রিয়তা অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি তা সেটা তাঁর দলই হোক বা কোন মন্ত্রীই হোক। বাংলাদেশেও দেখবে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি। কারণ সেই একটাই – অন্তত স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীরা দলকে যতটা না জনগণের সেবায় ব্যবহার করে তারচেয়ে বেশি করে নিজেদের সেবায়। রাশিয়ায় অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। অন্তত আমার সেটাই মনে হয় তাদের কর্মকাণ্ড দেখে। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের অধিকাংশ ব্যর্থতা ধরা পড়ে সরকারি দলের কর্মীদের হাতে। আমার ধারণা পশ্চিমা বিশ্বে এসব একটু অন্য রকম। সেখানে সিস্টেমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস অনেক বেশি। যতদূর মনে হয় স্থানীয় নেতাকর্মীরা সেখানে অনেক বেশি সৎ যদিও সেটা উপরের দিকের নেতাদের ক্ষেত্রে বলা যাবে না। তারা বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির প্রতিনিধি – এটা এখন আর গোপন কিছু নয়। সেখানে এ ধরণের দুর্নীতি আইনের মধ্যে থেকেই করার সুযোগ আছে। কে না জানে সেই বিখ্যাত উক্তি – দুই ডলার চুরি করলে তুমি চোর আর মিলিয়ন ডলার চুরি করলে তুমি মিলিয়নার। এ জন্যেই মনে হয় নীচের দিকের নেতাকর্মীরা দুর্নীতি করতে ভয় পায়, সৎ থাকে, আর উপর তলার নেতারা সেটা রাখঢাক না করেই করে। হান্টার বাইডেন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাই বিশ্বাস ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক।

কিন্তু ভালো সিস্টেম কি ভালো নেতার চেয়ে ভালো নয়? পশ্চিমা বিশ্বে কিন্তু কেউ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কে হবে এ নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না, কিন্তু রাশিয়া বা আমাদের দেশে এটা বিরাট ফ্যাক্টর, বিশেষ করে নেতা বা নেত্রী যদি সত্যিকার অর্থেই শক্তিশালী হন।

দেখ এটা যেকোনো শক্তিশালী নেতা নেত্রীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইতিহাস বলে পবিত্র স্থান শূন্য থাকে না, সে জায়গা কেউ না কেউ দখল করে। তবে কে দখল করে তার উপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। এই যে ইউরোপ বা আমেরিকার কথা বলছ, এখন তাদের, বিশেষ করে ইউরোপের দুর্ভাগ্যের মূল কারণ কিন্তু দুর্বল নেতৃত্ব যারা আমেরিকার প্রভাবের কাছে এতটাই নতজানু যে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য পর্যন্ত মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। অথবা আমেরিকার অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট বড় বড় কোম্পানির উপর এতটাই নির্ভরশীল যে সাধারণ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়ে অথবা অন্য দেশকে যুদ্ধের ইন্ধন যোগায়। সেটা আমরা দেখেছি ইরান – ইরাক যুদ্ধে, দেখছি বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধে। তাই কী সিস্টেম, কী নেতা – তাদের উপর যদি জনগণের প্রভাব না থাকে তাহলে কোন কিছুই কাজ করে না।  তবে এটা ঠিক এদের বা আমাদের যেমন সিস্টেম গড়ে তোলা দরকার, ইউরোপ আমেরিকাকে সেভাবেই যারা প্রয়োজনে ছায়া কেবিনেট বা ডীপ স্টেটের সাথে লড়াই করার সাহস রাখে এমন শক্তিশালী নেতা গড়ে তোলা দরকার।

কিন্তু সেই বিকল্প কি আছে? বিশেষ করে অনেক কংগ্রেস ম্যান যেখানে পুতিনকে হত্যার আহ্বান জানাচ্ছে সেখানে এদের বিকল্প কী?
দেখ, পশ্চিমা বিশ্ব বিকল্প হিসেবে দেখে নাভালনি বা তাদের অনুগত বিভিন্ন তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের যাদের এদেশে তেমন কোন ভিত্তি নেই। সত্যি বলতে এরা পশ্চিমা বিশ্বের নিজের তৈরি। কী ১৭৫৭ সালে কী আজ – এরা সবসময় সব দেশে মীরজাফর খোঁজে। কিন্তু কী নব্বুইয়ের দশকে, কী আজ – এই তথাকথিত লিবারেলরা নিজেদের এতটাই জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে যে এমনকি যারা পুতিন বা বর্তমান সরকারকে সমর্থন করে না তারাও এই লিবারেলদের বিশ্বাস করে না। খেয়াল করে দেখবে আমাদের দেশেও কোন দল সম্পর্কে সবচেয়ে নেগেটিভ মন্তব্য হল ভারতের, পাকিস্তানের বা চীনের দালাল। দালালদের কেউ কোন দেশেই পছন্দ করে না। আর লিবারেলদের এ দেশের মানুষ পশ্চিমা বিশ্বের দালাল বলেই মনে করে। তবে তুমি জানতে চাইছ দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য কে আছে? ইয়েলৎসিনের সময় অনেকেই মনে করত তাঁর বিকল্প নেই জুগানভ ছাড়া। তিনি পুতিনকে সামনে নিয়ে আসেন আর পুতিন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। ইয়েলৎসিনের পরে আসলে সবাই ছিল গ্রহণযোগ্য – প্রিমাকভ, লুঝকভ, জুগানভ। এখন পুতিনের পর, বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় মানুষ শক্ত নেতৃত্ব চায়। আমেরিকা, ইউরোপ বা পুঁজিবাদের প্রতি আগের মোহ নেই। তার মানে এখানে সেসব মানুষই জনপ্রিয় হবে যারা দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে। পুতিনের পর জনপ্রিয়তার দিক থেকে লাভরভ আর শইগু এগিয়ে আছেন। কিন্তু লাভরভ মনে হয় তাঁর জায়গায় ফিটেস্ট যেমন শইগু তাঁর জায়গায়। শইগু সেই ১৯৯১ সাল থেকেই সামনে। তিনি একমাত্র মন্ত্রী যিনি সব সময় জনপ্রিয় ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে জরুরি অবস্থার মন্ত্রণালয় ছিল সবচেয়ে সক্রিয় আর তিনি ছিলেন সেই মন্ত্রণালয়ের প্রধান। মাঝে তিনি কিছুদিন মস্কো রেজিওনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এটা বেসামরিক প্রশাসন। তিনি সেখানে খুব সফল ছিলেন বলে মনে হয় না। পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই মনে হয় বেসামরিক প্রতিষ্ঠানে তিনি তেমন সফল হবেন না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিশুস্তিন খুবই সফল, তবে তিনি টেকনোক্র্যাট। রাজনৈতিক ভাবে কতটা সফল হবেন বলা কষ্ট। এছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে তরুণ থেকে মধ্য বয়স্ক পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্মের লোকজনদের রাজনীতি সহ বিভিন্ন প্রজেক্টে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে আঞ্চলিক নেতৃত্ব। এদের কেউ যদি সামনে চলে আসে অবাক হবার কিছু থাকবে না। বিশেষ করে বর্তমান সামরিক অভিযানে অনেকেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ আবার সামনে আসছেন। যুদ্ধ নিয়ে প্রায়ই কড়া বক্তব্য রাখছেন। চীন ঘুরে এলেন। আমার ধারণা তাঁকে সামনে আনার চেষ্টা চলছে। তবে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে কে জানে? আমরা প্রায়ই বলি পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সব কন্ট্রোল করে। এটা শুধু পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই সত্য নয়। আমেরিকা, রশিয়া ও চীনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কম নয়। ট্রাম্পের সময় সেনাবাহিনী ও সিআইএ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে না থাকলেও সহযোগী ছিল না। সেটা ট্রাম্পের জন্য বিরাট সমস্যা ছিল। ইয়েলৎসিনের সময়ে সেনাবাহিনী তাঁর কাছের মানুষদের বিশ্বাস করত না। সেক্ষেত্রে পুতিন সব সময় জেনারেল স্টাফ বা গেনস্তাবের আনুগত্য পেয়েছেন। এদেশে সেটা ছাড়া কিছু করা অসম্ভব। মেদভেদেভের সেটা আছে কি? সবচেয়ে বড় কথা সবাই এক টিম হয়ে কাজ করতে পারবে কিনা। আফগান ও পারস্যের মুসলিম শাসকরা যখন ভারত আক্রমণ করে তখন তাদের পথে ছিল রাজপুতরা। এরা ছিল বীর যোদ্ধা। কিন্তু তাদের সমস্যা ছিল কেউ কারও বশ্যতা মানতে চাইত না। এদের অনৈক্য সুলতানদের ভারত বিজয়ে সাহায্য করে। তাই পুতিনের পরে কে আসবে তারচেয়ে বড় কথা তারা এক সাথে কাজ করতে পারবে কি না। আর পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে, ভেতর থেকে এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল – এটাই পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান অস্ত্র। সেটাকে যদি নিষ্ক্রিয় করতে পারে তাহলে কে রাশিয়ার শাসক হবে সেই প্রশ্ন থাকবে না। এটা মনে হয় শুধু রাশিয়া নয় সারা বিশ্বের জন্যই সত্য। আমাদের সব দেশেও পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে দেশকে নিজেদের ক্ষমতার বলয়ে রাখে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো