চলমান সংবাদ

‘বই উৎসবে’ সবাই বই পায়নি

সারাদেশে বছরের প্রথম দিন ‘বই উৎসব’ হয়েছে৷ কিন্তু সব শিক্ষার্থী প্রথম দিনে বই পায়নি৷ আবার যারা পেয়েছে তারা সব বই পায়নি৷ এমনকি পুরো সেটের শুধু একটি বা দুইটি বই দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে৷

এদিকে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছে নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট কাগজে৷ ফলে ছাপার মানও খারাপ হয়েছে৷ এর আগে ৮৫ ভাগ উজ্জ্বলতার সাদা কাগজে পাঠ্যবই ছাপা হতো৷ এজন্য কাগজ সংকটকে দায়ী করা হচ্ছে৷

একদিন আগে ৩১ ডিসেম্বরই বই উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী৷ আর বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি বই বিতরণ কর্মসূচি পালিত হয়েছে৷ গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বই উৎসবের কর্মসূচি উদ্বোধন করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘‘কাগজের আর কোনো সংকট থাকবে না, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সবাই বই পেয়ে যাবে৷ ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বই দেয়া হয়েছে৷’’

বই উৎসব যেমন হয়েছে

এই সংকট যে হবে তা আগেই ধারণা করা হয়েছিলো৷ এজন্য আগে থেকেই বিভিন্ন স্কুলে  একদিনে সবাইকে বই না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিনে বই দেয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়৷ আবার কোন বই কবে দেয়া হবে সেটিও ঠিক করা হয়৷ কিন্তু সেই সময়সূচী অনুযায়ীও বই দেয়া যায়নি৷ জানা গেছে, ঢাকার ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের একটি-দুইটি করে বই দেয়া হয়েছে৷ আজিমপুর সরকারি স্কুলে দেয়া হয়েছে দুইটি করে বই৷ ইস্কাটন সরকারি স্কুল ও ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয়ে বই উৎসব হয়নি৷ সোমবার তারা বই বিতরণ করবে বলে জানা গেছে৷

ঢাকার বাইরে থেকেও একইরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার রামনগর সরকারী প্রাথিমিক বিদ্যালয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক ড.মুনসুর আলম খান৷ কিন্তু সব বই পাননি শিক্ষার্থীরা৷ প্রাথমিক পর্যায়ে মিলেছে বাংলা ও ইংরেজি বই৷ আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মিলেছে একটি করে বই৷ আবার কোথাও কোথাও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বইই পাননি৷ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সবাইকে বই দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে৷

পটুয়াখালী কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে সকালে মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং দুপুরে ডিবুয়াপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রাথমিক পর্যাযের বই বিতরণ উৎসবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোঃ শরীফুল ইসলাম৷ তবে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সব বই জেলায় না পৌঁছানোয় শিক্ষার্থীদের হাতে শতভাগ বই তুলে দেয়া সম্ভব হয়নি৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসব বই পৌঁছালে তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে৷

জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রথম দিনে সব বই হাতে পায়নি৷ আর মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই উৎসবে গিয়ে কোনো বই পায়নি৷ জানা গেছে ওই এলাকার এক হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী কোনো বই পায়নি৷

খালি হাতে বাড়ি ফিরে গেছে শিক্ষার্থীরা

ঢাকার অদূরে টঙ্গির সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যা নিকেতন এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের সব বই না দিয়ে দুই-একটি করে বই দেয়া হয়েছে৷ একজন অভিভাবক এস এম মিন্টু জানান, ‘‘আমরা ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে৷ সে ১১টি বইয়ের মধ্যে মাত্র দুইটি বই পেয়েছে৷ তার মন খুব খারাপ৷’’

মেহেরপুর  মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরাইয়া পারভীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোনো বই পায়নি৷ তাদের বই আসেনি৷ আমরা দুপুর ১২ টা পর্যন্ত বই আসবে এই আশায় তাদের বসিয়ে রেখেছিলাম৷ শেষ পর্যন্ত বই না আসায় তারা হতাশ হয়ে বাড়ি চলে গেছে৷ আর তিনটি শ্রেনিতে বই দেয়া হলেও সব বই দেয়া হয়নি৷ ছয়টি বইয়ের দুই-তিনটি করে বই দেয়া হয়েছে৷”

তিনি জানান, শিক্ষা অফিস থেকে জানানো হয়েছে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বাকি বই দেয়া হবে৷ সরিষাবাড়ির বিলবালিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার এম এ রউফ জানান, ‘‘ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির কোনো বই দেয়া হয়নি৷ শিক্ষা অফিস থেকে বলা হয়েছে বই আসলে দেয়া হবে৷ অন্যান্য শ্রেণিতে বই দেয়া হলেও পুরো সেট দেয়া হয়নি৷’’

মেহেরপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ভুপেশ রঞ্জন রায় বলেন, ‘‘আসলে আমাদের জেলায় সব শ্রেণির সব বই আসেনি৷ শুধু পি-প্রাইমারির সব শিক্ষা উপকরণ সব এসেছে৷ ফলে সবাই বই পায়নি৷ আবার যারা পেয়েছে তাদেরও সব বই দেয়া যায়নি৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বই এসে যাবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আগের বছরের বই আছে৷ সিলেবাস তো একই৷ ফলে বইয়ের সংকট হবে না আশা করি৷”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সব জেলা ও উপজেলার চিত্র প্রায় একই৷

প্রাথমিকের ৪০ ভাগ বই ছাপানো বাকি

এনসিটিবির তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে চার কোটি নয় লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে৷ তাদের জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ কোটি ৯৬ লাখ নয় হাজার কপি বই ছাপানোর কাজ এখনো চলছে৷ এরমধ্যে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকে নয় কোটি ৯২ লাখ ৮৩ হাজার, মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮, ইবতেদায়ি শ্রেণিতে দুই কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার, দাখিলে চার কোটি এক লাখ ৪৪ হাজার কপি বই ছাপা হচ্ছে৷ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর’ মাতৃভাষায় বই ছাপা হচ্ছে দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৭ কপি৷ আগামি ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বই ছাপার সময় আছে বলে জানান পুস্তক প্রকাশকরা৷

তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন এবার পাঠ্য পুস্তকের কাগজ এবং ছাপার মান ভালো নয়৷ শুধু তাই নয় কয়েকটি মুদ্রণ সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা নিম্নমানের কাগজে আগেই বই ছেপে গুদামজাত করেছে৷ শেষ মূহুর্তে তারা ওই বই সরবরাহ করেছে পরিস্থিতি সামাল দিতে৷

জানা গেছে বাজারে অব্যবহৃত (ভার্জিন) পাল্পের ঘাটতির কারণে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতার কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না৷ এমনকী রিসাইকল বা পুরোনো কাগজ প্রক্রিয়া করে বানানো পাল্পেরও ঘাটতি আছে৷ এই সুযোগে পুরোনো কাগজ সরবরাহকারী এবং কাগজ উৎপাদনকারীদের অনেকে সিন্ডিকেট করে নিম্নমানের কাগজের ব্যবসা করেছে৷ আর প্রকাশকরা সুযোগ নিয়ে অধিক মুনাফা করেছে৷

রোববার চেষ্টা করেও এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামকে এনিয়ে কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি৷ তবে তিনি গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘‘দুই-একটি বই কম হতে পারে৷ তবে তারা জানুয়ারি মাসের মধ্যেই সব বই পেয়ে যাবেন৷ আমরা এরইমধ্যে ৮০ ভাগ বই পাঠাতে সক্ষম হয়েছি৷”

তবে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, ‘‘সব শিক্ষার্থীকে সব বই দিতে পুরো জানুয়ারি মাস লেগে যাবে৷ প্রাথমিকের ৪০ ভাগ বই ছাপানো এখনো বাকি আছে৷ আর মাধ্যমিকের বাকি আছে ২০-২৫ ভাগ৷”এজন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেরিতে পাওয়া আর কাগজের সংকটকে দায়ী করেন তিনি৷

# হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা #