চলমান সংবাদ

ফুটবলের কল্যাণে বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনার সম্পর্কে গভীরতা

এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সমর্থকদের ভালবাসা হৃদয় ছুঁয়েছে আর্জেন্টিনার মানুষের৷ খেলার ভালবাসা এখন রূপ নিচ্ছে নতুন কূটনৈতিক সম্পর্কে৷

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন বার্তার জবাব দিয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট৷ আগামী মার্চে বাংলাদেশে সফরে আসতে পারেন আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ এমনকি বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলার বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে৷ দুই দেশের সম্পর্ক এখন গভীর হচ্ছে৷ এতে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে? বাংলাদেশের ফুটবলেরই বা কতটা কাজে আসবে এই সম্পর্ক?

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সবকিছু চূড়ান্ত না হলে এখনই এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন৷ তবে দুই দেশের  বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে৷ পাশাপাশি পর্যটন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই সম্পর্ককে কাজে লাগানো যেতে পারে৷

বাণিজ্যে সম্ভাবনা

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় ৬৮ লাখ ৫৪ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে৷ তবে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয় তার ৮৮ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক৷ অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্জেন্টিনা ৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে৷ মূলত সয়াবিন তেল, ভুট্টা ও তুলা বেশি আমদানি করে বাংলাদেশ৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিটি পণ্য আর ই কমার্সের জন্যও আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে৷ ইউরেনিয়ামসহ নানা ধরনের খনিজ আছে দেশটিতে যা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে৷ গত জুলাইতে ঢাকায় আসা আর্জেন্টাইন সরকারি প্রতিনিধি দলটি তাদের দেশ থেকে তুলা, গুঁড়ো দুধ ও রসুন আমদানির প্রস্তাব দিয়েছিলো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে৷ আবার বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ঔষধ, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক ও তৈরি পোশাক আমদানির জন্য আর্জেন্টিনার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা৷

তবে সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আর্জেন্টিনা তো আর্থিকভাবে অতটা স্বচ্ছল না৷ তাদের মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি৷ তবে হ্যাঁ, আমাদের দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির সম্পর্ক আছে৷ সেটা বাড়ানো যেতে পারে৷ সেটাও যে খুব বেশি কিছু হবে আমার সেটা মনে হয় না৷ সব মিলিয়ে কারও সঙ্গে সম্পর্ক হলে সেটা তো খারাপ না৷’’

ফুটবলের উন্নতিতে কী কাজে আসবে?

আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশের ফুটবলের ব্যবধান যোজন যোজন৷ একটি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল অন্যটি র‍্যাংকিংয়ে শেষের দিকে৷ আর্জেন্টিনার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন কি ফুটবলে কাজে লাগানো যায়? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরো বিষয়টি তো এখন মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে৷ মূলত আলোচনার টেবিলে না বসলে কোনো কিছুই পরিস্কার করে বলা যাবে না৷ তবে এটুকু বলা যায়, ওখানে তো ক্লাবগুলোর উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই৷ তারা স্বাধীন৷ সরকার চাইলে কী হবে জানি না, তবে কোনো ক্লাব যদি চায় আমাদের কোন ক্লাবের সঙ্গে কাজ করতে পারে৷ আসলে কী হবে এখনই বলা যাচ্ছে না৷’’

১৯৮৬ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল মাদরেকা কাপ৷ সেখানে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল বাংলাদেশ ফুটবল দলের মুখোমুখি হয়েছিল৷ আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কয়েকজন খেলোয়াড় ওই ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন৷ ম্যাচটিতে ৫-২ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশের পক্ষে গোল দুইটি করেছিলেন আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও শেখ মোহাম্মদ আসলাম৷ আর্জেন্টিনার সঙ্গে সম্পর্কে ফুটবলের কতটা লাভ হবে জানতে চাইলে শেখ মোহাম্মদ আসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যদি ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা করতে পারি সেটা ফুটবলে কাজে লাগবে৷ ওদের কোন একাডেমিতে যদি বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলাদের পাঠানো যায় বা একাডেমি থেকে প্রশিক্ষক বাংলাদেশে আসেন সেটা অবশ্যই বাংলাদেশের কাজে আসবে৷ পাশাপাশি তরুণ ফুটবলার হান্ট প্রক্রিয়ায়ও আর্জেন্টিনার প্রশিক্ষকদের আমরা চাইলে কাজে লাগাতে পারি৷’’

ঢাকায় চালু হবে আর্জেন্টিনার দূতাবাস

আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও উপাসনা মন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো আগামী মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সময় নেওয়া হবে৷ দুই দেশের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক আছে৷ আমি আশা করি, এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে৷’’ অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতেও জানিয়েছেন তার দেশ আগামী বছর পুনরায় ঢাকায় কূটনৈতিক মিশন স্থাপনে কাজ করছে৷

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে দূতাবাস খুলেছিল আর্জেন্টিনা৷ ১৯৭৮ সালে সেটি গুটিয়ে নেয়ার পর দেশটি ঢাকায় মিশন খোলার আর উদ্যোগ নেয়নি৷

অন্যদিকে ব্রাজিলে বাংলাদেশের দূতাবাস থাকলেও আর্জেন্টিনায় কোনো দূতাবাস খোলেনি বাংলাদেশ৷ এবারের বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনাকে ঘিরে বাংলাদেশের উন্মাদনার খবর ব্যাপক প্রচার পেয়েছে দেশটিতে৷ এর মধ্যেই দেশটি বাংলাদেশে দূতাবাস খোলার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে যাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷

দুই দেশের সরকার প্রধানের শুভেচ্ছা বিনিময়

২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করায় আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ গত ১৯ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান তিনি৷ বার্তায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের জনগণ এবং আমার পক্ষ থেকে, আর্জেন্টিনার ফুটবলের দুর্দান্ত জয়ে আপনাকে ও আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণকে এবং ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপজয়ী দলকে আন্তরিক অভিনন্দন৷ এ অভিনন্দন জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত৷ আপনার জাতীয় ফুটবল দলের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রশংসা ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছে৷’’

এদিকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন পাওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণকে এক টুইট বার্তায় ধন্যবাদ জানান আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ৷ নিজ দেশ ও বাংলাদেশের পতাকা, ভালোবাসা, হাত মেলানোর চিহ্নসহ টুইট করেন তিনি৷ মেসিদের প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, “ধন্যবাদ শেখ হাসিনা এবং পুরো বাংলাদেশের জনগণকে৷ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে বন্ধন এবং পারস্পরিক স্নেহ দেখেছি, তা বর্ণনাতীত৷ আজ দুই দেশের পতাকা এখানেও (আর্জেন্টিনায়) উড়ছে৷ আসুন এ বন্ধন আরও গভীর ও দৃঢ় করি৷’’

আর্জেন্টিনায় উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা

বাংলাদেশ এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে ভৌগলিক দূরত্ব ১৭ হাজার ৫০ কিলোমিটারের৷ কিন্তু ফুটবলের কল্যাণে সেই দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে৷ বাংলাদেশের সমর্থকরা যেভাবে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছে, একইভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থনে ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছে আর্জেন্টাইনরা৷ তারাও উদযাপন করছেন বাংলাদেশের জয়৷ বাংলাদেশের খেলার সময় কোন গানগুলো বাজানো হয় বা শোনা হয়, আর্জেন্টাইন সমর্থকরা সেসব জানতে চাচ্ছেন৷ অনেক আর্জেন্টাইন নিজের হাতেই বাংলাদেশের পতাকার ট্যাটু এঁকেছেন৷ আর সেই ট্যাটু দেখিয়ে মেসির জন্ম নেয়া বাড়ির সামনে গিয়ে ছবিও তুলেছেন৷ আর্জেন্টিনার অনেক বাড়িতে এখন উড়ে বাংলাদেশের পতাকা৷

১৯৮৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলের সমর্থকরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল দলকে সমর্থন করে আসছে৷ এরপর যতগুলো বিশ্বকাপ হয়েছে সবগুলোতেই দেশের সমর্থকরা এই দুই দলকে সমর্থন করে গেছেন৷ এবারের উন্মাদনার মতো অন্য বিশ্বকাপগুলোতেও উন্মাদনা ছিল৷ তবে এবারের বিশ্বকাপ খেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি জায়গায় বড় পর্দায় দেখার আয়োজন করে মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ৷ সেখানে হাজার হাজার সমর্থক এক সঙ্গে খেলা দেখেছেন৷

নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা মহসিন হলের মাঠে, টিএসসি, ডাচের পেছনেসহ চার জায়গায় জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করি৷ শিক্ষার্থীরা সবাই একসঙ্গে খেলা দেখার সুযোগ পাওয়ায় সমর্থনের বিষয়টি সামনে এসেছে৷ এতদিন একসঙ্গে এত সমর্থককে দেখা যায়নি৷ ফলে বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আসে৷ আমাদের এই আয়োজন যে এতদূর যাবে আমাদেরও ধারণা ছিল না৷’’

সূত্রঃ ডয়চেভেলে