মতামত

ঝরে পড়ল আরও একটি নক্ষত্র

– ইমরান চৌধুরী

কমরেড রাখাল দাশের সাথে লেখক ইমরান চৌধুরী

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা ও ভাষা আন্দোলনের সার্বক্ষণিক একনিষ্ঠ কর্মী,আজীবন বিপ্লবী, বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট কমরেড রাখাল দাশ (৯৫) গত মঙ্গলবার(১৩ ডিসেম্বর) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্রীয় চার নীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজ প্রগতি, সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে, প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে জীবনের শেষ পর্যন্ত আপোষহীন অবস্থানে ছিলেন।

যারা মনুষ্যজাতির কল্যাণের জন্য, সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনের সবটুকু সময় বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁরাই এ মানব জগতে চির অমর হয়ে থেকেছেন। মানুষের দেহের মৃত্যু আছে কিন্তু তাঁর মহত্ব,কীর্তি ও মহিমার কোনো মৃত্যু নেই। আমরা মাধ্যমিকে থাকতে ভাব সম্প্রাসারণে পড়েছি ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। ‘ আমাদের রাখাল দা সে কীর্তিমান। যিনি নিজের মহত্ব, গুণ ও কর্মের মধ্যে দিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

১৯২৭ সালে বোয়ালখালী উত্তর ভূর্ষি গ্রামে জম্মগ্রহণ করেন মহান এ বিপ্লবী। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে। পড়ালেখায় ছিলেন মেধাবী। উনার বাবা রমনী মোহন দাশ কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ছিলেন পার্টির জন্য অন্তপ্রান। আত্মগোপন পার্টিকে বুকে আগলে রেখেছিলেন জীবনের নানা ঝুঁকি নিয়ে। বাবার অনুপ্রেরনায় বামপন্থী ছাত্র কর্মী হয়েছেন রাখাল দাশ। ছাত্র ফেডারেশন করেছেন। ১৯৪৮ এ জেল খেটেছেন। রাজনৈতিক ঝঞ্জার কারনে বি এ পাশ করতে পারেন নি। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ছিলেন রাজপথে সক্রিয়। সে দায়ে যেতে হয়েছিল জেল। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন চট্টগ্রামের চৈতন্যগলি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেল থেকে বের হয়ে আবার নেমে পড়েন নিজের মাতৃভূমিকে শোষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে।

১৯৫০ সালে কমরেড রাখাল দাশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। টানা ৩০ বছর আত্মগোপনে থেকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই,সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। জেল জুলুম,নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও পার্টির একতা পত্রিকা বিলি করতেন পায়ে হেঁটে। স্বপ্ন দেখতেন সাম্যর ও বৈষম্যহীন সমাজের। তিনি পার্টিকে ভালবাসতেন। মিছিলে সভায় সব সময় আসতে না পারলেও পার্টিকে অসম্মানিত অপমানিত করলে কষ্ট পেতেন। বলতেন, পার্টিকে অসম্মানিত,অপমান করার অধিকার অধিকার কারো নেই’।

২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয় ছাত্র ইউনিয়ন,চট্টগ্রাম জেলার প্রাক্তন সভাপতি ডাঃ আরিফ বাচ্চু ভাইয়ের চেম্বারে । আমার সাথে তখন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক টিকলু দে ছিল। পার্টি,ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে অনেকক্ষন আলাপ হয় উনার সাথে। ছাত্র ইউনিয়নের সোনালী অতীত ও বর্তমান সময়ের সংগঠন নিয়ে আফসোস করলেও আমাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন’ তোমাদেরকে ধন্যবাদ। এই অসময়ে, সুবিধাবাদী ও নষ্ট সমাজে তোমরা প্রগতির মশাল নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছ’। তিনি বলেন,’ শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, সেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে,সে লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।

নির্লোভ, সাদামাটা এ মহান বিপ্লবী দূরারোগ্য ক্যান্সারে(প্রোস্টেড) ভুগছিলেন অনেকদিন ধরেই। গত প্রায় চার বছর পূর্বে তার স্ত্রী(স্মৃতিকনা দাশ) যিনিও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন তাঁর কর্কটে আক্রান্ত( প্যাংক্রিয়াস) হয়ে মৃত্যুর পর থেকে নিজের ক্যান্সার চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। যেন নিজের প্রিয় সাথীর চলে যাওয়ায় অভিমানে স্বেচ্ছায় ক্যান্সার এর কাছে আত্মসমর্পন।
তার মৃত্যু এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলনে উনার অবদান গুরুত্বের সাথে স্মরণ করবে।

লাল সালাম কমরেড রাখাল দাশ।

লেখকঃ ইমরান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি।