শিল্প সাহিত্য

তোমার পতাকা যারে দাও

– চৌধুরী জহিরুল ইসলাম

ঢাকা মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। মা-বাবার অনুমতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাননি। যেমন যাননি জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি কিংবা আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরী নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ। খুব সাহসী একজন সেনা অফিসার। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। ক্যাপ্টেন হায়দার বয়সে খুবই নবীন। আর যেসব যোদ্ধাদের কমান্ডের দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন, তারা সবাই ছিলেন আরো নবীন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পলানো। আমাদের গতরাতটি ছিল অনুজ ভাই’র ৫০তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে কয়েকটি বন্ধুপ্রতিম পরিবারের সম্মিলন। সারোয়ার ভাই সস্ত্রীক এসেছেন শ্যালকের এই অনুষ্ঠানে। আমাদের একত্রিত হওয়া মানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ডালপালায় বসে তত্ত্ব কপচানো! এরমধ্যে ইউটিউবে চলছিল বাংলাদেশের ইউটিউবার সালাহউদ্দিন সুমনের গ্রামীন জীবন ধারার উপর প্রামাণ্য চিত্র। আমাদের চড়াগলার রাজনৈতিক সংলাপে কিছুটা বিরক্ত হয়ে সারোয়ার ভাই বললেন- আপনাদের কাউকে গ্রামে যেতে বললে কেউ যাবেন না। আপনারা কেউ কাঁদাপানিতে নামতে চাইবেন না! কাজেই বিদেশের মাটিতে বসে চড়া স্বরে কথা না বলাই ভালো। আমরা একটু নড়েচরে বসলাম। আসলে আমরা দেশের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত? মুখে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশপ্রেমের ফেনা তুলি, দেশের ভেতরে-বাইরে। দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষার মুথোমুখি হলে আমরা আদৌ সাড়া দিতে পারবো কি-না? আমাদের পক্ষ থেকে রকিব ভাই অনুরোধ জানালেন সারোয়ার ভাইকে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলার জন্য। প্রথমে ইতস্ততঃ। আমাদের নীরবতায়, মুগ্ধতা নিয়ে অপেক্ষার পর বলতে লাগলেন- মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হতে তিন-চার মাস সময় লেগেছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রণাঙ্গনে এবং রণাঙ্গনের বাইরে যে দু’জন প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তার একজন ছিলেন- তাজ উদ্দীন আহমেদ, আরেকজন ছিলেন জেনারেল ওসমানী। ঢাকা থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় তরুণ ছাত্রকর্মীরা জড়ো হতেন। আমাদের ১৮ বছরের সারোয়ার ভাই সেখানেই নাম লিখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মা-বাবার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কারণ তিনি জানতেন- অনুমতি মিলবে না! ছয় সপ্তাহ ট্রেনিং দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের এসাইনমেন্ট দেয়া হতো, একেক দিন একেক ফ্রন্টে। আজ সেতু উড়িয়ে দেয়া তো, কাল ডিআইটিতে বোমা হামলা। তারা জানতেন- এগুলো করা মানেই যুদ্ধ জয় নয়! কিন্তু এসব ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার সু্যোগ ঘটত। মানুষ বুঝতো- দেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। প্রত্যেকের কিছু না কিছু করার আছে! সারোয়ার ভাই বললেন- সেদিন ভারতের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাশে না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আরো কত বছর অপেক্ষা করতে হত, কে জানে? ভারতের মত একটি দরিদ্র দেশ যে আমাদের এক কোটি শরনার্থীকে শুধু আশ্রয় নয়, খাবারও জুগিয়েছিল, সেটা ভাবতে এখনো আশ্চর্য হতে হয়! মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ছিল যবের তৈরি রুটি আর ডাল। যবের রুটি মুখে দেয়ার মত ছিল না। সারোয়ার ভাই বল্লেন- আপনাদের খেতে দিলে খেতে পারবেন না! অথচ সেসব খেয়েই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনে যেতে হত! প্রশ্ন করেছিলাম- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আপনারা যে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ আপনারা পেয়েছিলেন কি-না। স্বখেদে বলছিলেন- মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ভালবাসেনি। যেমন রাজনীতিবিদরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঝামেলা মনে করেছিলেন, তেমনি সেনাবাহিনীতেও মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অপাংক্তেয়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের ভূমিকা যেন অগ্রগণ্য হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের সেই অধিকার দিতে রাজি ছিলেন না। তারা বলতে লাগলেন- মুক্তিযোদ্ধারা যেন অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার পেশায় ফেরত যায়। ছাত্ররা চলে গেল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃষক চলে গেল ক্ষেত-খামারে, শ্রমিক গেল কারখানায়। কিন্তু দেশটা রয়ে গেল লুটেরাদের হাতে।
বঙ্গবন্ধু কিংবা কয়েকজন জাতীয় নেতার পক্ষে এদেরকে নিয়ন্ত্রণ সহজ ছিল না! মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রতিটি মানুষ অংশ নিয়েছিল। কতিপয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ছাড়া। তিনি বলছিলেন- আমরা রাতে অপারেশনে শেষে হয়ত কোনো কৃষক-ক্ষেতমজুরের বাড়িতে উঠেছি, আমাদেরকে চরম দারিদ্র অবস্থার মাঝেও ডাল-ভাত খাইয়েছেন, ভোর হওয়ার আগে নিরাপদ পথের নিশানা দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জন্যই সব সিদ্ধান্ত ও কাঠামো তৈরির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাটা চলে যায় কতিপয় স্বার্থান্বেষী লুটেরাদের হাতে! তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা তাতে মর্মাহত হয়েছিলেন। তাদের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছিল। কিন্তু করার কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেই সব লুটেরাদের খপ্পরে থেকেই জীবন দিলেন! বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শুরু হলো রাজাকারের আমল। এতকাল রাজনীতিতে কোনঠাসা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এবার সেনাবাহিনীতেও তাদের কোনঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাকিস্তান ফেরত আর্মী অফিসারদের পূনর্বাসন করতে যেয়ে জিয়াউর রহমান যে কত মুক্তিযোদ্ধাকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন, সে তালিকা এখন জানা যাচ্ছে! বঙ্গবন্ধু যেমন অবজ্ঞা করেছেন সিভিল মুক্তিযোদ্ধাদের, জিয়া তেমনি মৃত্যু পরোয়ানা ধরিয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের। যে বাংলাদেশ আমরা এখন পেয়েছি, সেটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- সকল মানুষের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খোলার সু্যোগ ঘটেনি। কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। বাকি সবাই পড়ে আছে তলানিতে! তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুযোগে আমরা আজ বহির্বিশ্বের আলো দেখছি। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের পাসপোর্ট তৈরি হয়ে জাহাজে আসত ইসলামাবাদ থেকে। তাতে কয়েক মাস সময় লাগত। সে কারনে মানুষ পাসপোর্ট তৈরিতেও অনাগ্রহী ছিল। আজ আমরা সহজেই পাসপোর্ট তৈরি করে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। ডাক্তার সালেহ সারোয়ার আমেরিকার একজন কার্ডিওলজিস্ট। হৃদরোগের চিকিৎসক। ঢাকা শহরে জন্ম কিংবা বড় হলেও নিজের বাপ-দাদার ভিটে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নিখরচায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। বছরে ছয় মাস থাকেন বাংলাদেশে। শুধু চিকিৎসা নয়, বন্যার সময় ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। না, নির্বাচনে দাঁড়ানো তার উদ্দেশ্য নয়। সময়ের সাহসী সন্তান সব সময়ে দেশের মানুষের পাশে আছেন। তার ইউটিউবে একটি ভিডিও ( https://youtu.be/xCj9gIpg10Q ) প্রেরণার উৎস হয়ে টিকে থাকবে অনাগত প্রজন্মের জন্য। সারোয়ার ভাইদের মত কিছু মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন। বাঙালির সাহস আর মুক্তির কাহন ইতিহাসে লিখা থাকবে। আর থাকবে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে, সাধারণ মানুষের অন্তরে। ১৯৫২-রসভাষা আন্দোলন, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৮০-৯০ দশক ধরে চলা গণতন্ত্রের আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখাবে। অনেক সময় সাময়িক লাভের আশায় আমরা পথভ্রষ্ট হই। ভুলে যাই সত্যকে। শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করি। সত্যকে তাই বারবার মাটি খুঁড়ে উপস্থাপন করতে হয়। সত্য ও ন্যায়ের মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখবে যে তরুণ প্রজন্ম, তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন-
“তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।
তোমার সেবার মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি॥
আমি তাই চাই ভরিয়া পরান দুঃখের সাথে দুঃখের ত্রাণ,
তোমার হাতের বেদনার দান এড়ায়ে চাহি না মুকতি।
দুখ হবে মম মাথার ভূষণ সাথে যদি দাও ভকতি॥
যত দিতে চাও কাজ দিয়ো যদি তোমারে না দাও ভুলিতে,
অন্তর যদি জড়াতে না দাও জালজঞ্জালগুলিতে।
বাঁধিয়ো আমায় যত খুশি ডোরে মুক্ত রাখিয়ো তোমা-পানে মোরে, ধুলায় রাখিয়ো পবিত্র ক’রে তোমার চরণধুলিতে—
ভুলায়ে রাখিয়ো সংসারতলে, তোমারে দিয়ো না ভুলিতে॥”
নিউইয়র্ক, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২২