চলমান সংবাদ

আওয়ামী লীগ কেন এতো গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপির সমাবেশকে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দশই ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে রাজনৈতিক অনেক হিসাবনিকাশ রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মঞ্চ তৈরি করে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি।

আবার ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়ার পর তারাও অবস্থান নিয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে হয়। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা আশঙ্কা করছেন, বিএনপিকে যদি মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে হয়তো সেরকম কোন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণ আছে। বিএনপি নিজেই এই সমাবেশ নিয়ে তাদের আলাদা কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে আগে জানিয়েছে, যাতে হয়তো পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ৮ অক্টোবর মন্তব্য করেছিলেন, ১০ই ডিসেম্বর সরকারের পতন হবে। সেদিনের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। বিএনপির কোন কোন নেতা গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন যে, সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত খালেদা জিয়া দশই ডিসেম্বরের সমাবেশে অংশ নেবেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২২শে নভেম্বর বলেছেন, ‘’এখনো আমরা আসল ঘোষণা তো দেই নাই। আসল ঘোষণা আসবে ১০ তারিখে। সেদিন থেকে শুরু হবে এক দফার আন্দোলন।‘’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘’যেহেতু একবছর পরে নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচনে তাদের দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, সেই দাবির পক্ষে যে অনেক মানুষ আছে, সেটা দেখানো তাদের জন্য জরুরি। ফলে সমাবেশে তারা যত বেশি মানুষ জড়ো করতে পারবে,  বড় সমাবেশ করতে পারবে, তারা মনে করে, তারা দেখাতে পারবে যে তাদের কত সমর্থন আছে। ‘’

‘’মেঠো রাজনীতিতে শো-ডাউনের একটা প্রতিযোগিতা থাকে। বিএনপির সমাবেশের পরে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগও নানারকম জনসভা করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেখানে বক্তব্য দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের জন্য ভোট চেয়েছেন। এখানে একটা পাল্টাপাল্টি শো-ডাউনের প্রতিযোগিতা চলছে। এখানে একটা আছে রাজনীতির লড়াই, আরেকটা আছে দলীয় আছে ইগোর লড়াই।‘’

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনরকম চিন্তিত নয়, কোন গুরুত্বও দিচ্ছে না।

‘’আমার মনে হয় না আওয়ামী লীগ এটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মিডিয়া বিভিন্ন সময় প্রচারের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গিয়ে জানতে চায়, বিএনপি নেতারা এই বললো, আপনাদের বক্তব্য কি? অনেক সময় আমাদের নেতারা হয়তো বিভিন্ন বক্তব্য দেয়, তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ চিন্তিত। বিএনপির সমাবেশ বিএনপি করবে, তাতে আওয়ামী লীগের কি আসে যায়?’’

‘’বিএনপির সমাবেশ নিয়ে, সমাবেশের অনুমতি, স্থান নির্ধারণ-এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এখানে আওয়ামী লীগের মাথা ঘামানোর কিছু নেই।  এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুব বেশি কিছু ভাবছে বলে আমি মনে করি না,’’ বলছেন মি. হানিফ।

তবে ঢাকায় ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন নেতা নানারকম বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সমাবেশের স্থান নিয়েও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলেও দলটি চাইছে নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে।

এর আগে যে নয়টি বিভাগীয় শহরে বিএনপির সমাবেশ হয়েছে, সেখানে সরাসরি কোন বাধা দেয়া না হলেও, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার এবং সরকারি দল নানানভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, যাতে বিএনপির সমাবেশে বেশি লোকজন না আসতে পারে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনে বলেছেন, ‘’১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা (বিএনপি) জানান দিল যে, তারা সন্ত্রাস করবে। আবার আগুন সন্ত্রাস ফিরে আসছে। খেলা হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারা দেবে নেতা-কর্মীরা।‘’

রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোর মতো ঢাকা সমাবেশেও পরোক্ষভাবে বাধা তৈরি করা হবে আওয়াম লীগের পক্ষ থেকে।

এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  ঢাকার অনেক হোটেল ওই সময় খালি রাখার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।

র‍্যাব জানিয়েছে, ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘’তারা (আওয়ামী লীগ) কিছুটা আতঙ্কিতও। আওয়ামী লীগ এবং তাদের নানান অঙ্গ সংগঠন যেভাবে বলছে, পাহারা দেবে, যে সমস্ত কথা বলছে, তাতে বোঝা যায় যে, তারা চিন্তিত। যদি কোন কারণে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বিএনপির দাবি যদি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাহলে তো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করে, তাদের জন্য ভালো হবে না। ফলে তাদের মধ্যে চিন্তা আছে। আবার বিএনপিও চাইবে, যত বেশি চাপ দিয়ে এটা আদায় করার চেষ্টা করবে।‘’

তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই টানাপড়েনে উদ্বেগে পড়েছেন মনির হোসেনের মতো অনেক সাধারণ মানুষ।

বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে তার ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আসা ঠিক হবে কিনা, এসে কোন বিপদে পড়তে হয় কিনা, তিনি সেই চিন্তায় পড়েছেন।

‘’আমার জরুরি কাজ আছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ভিসার আবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু সমাবেশ নিয়ে যেসব কথা শুনছি, তাতে এখন তো ঢাকায় যেতেই ভয় পাচ্ছি, কি হয় না নয় ভেবে। কিন্তু এখন পরীক্ষাটা করাতে না পারলে আমার বিদেশে যাওয়া তো পিছিয়ে যাবে,’’ বলছিলেন মি. হোসেন।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা