বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা:(৭২) যুদ্ধকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি

– বিজন সাহা

আসলে মানুষ যখন চাপের ভেতর থাকে তখন সে জীবনকে যতটা ও যেভাবে অনুভব করে সুখের দিনে সেভাবে পারে না। শুনেছি অন্ধদের শ্রবণ শক্তি নাকি দুর্দান্ত। তারা এক অঙ্গের অভাব অন্য অঙ্গ দিয়ে পুষিয়ে নেয়। মনে হয় কষ্টে থাকলে মানুষ কল্পনায় অনেক না পাওয়াকে পুষিয়ে নেয়, তাই কঠিন সময়ে সৃষ্ট  শিল্প সাহিত্য হয় অনেক মর্মস্পর্শী। বাহান্ন, একাত্তরে কালজয়ী অনেক সাহিত্য, অনেক কবিতা, অনেক গান এভাবেই তৈরি হয়েছে। একই ঘটনা ঘটছে দনবাসে। অনেক স্থানীয় কবি, সাহিত্যিকের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ যেন গান বা কবিতা নয়, এ যেন জীবন – অনেক কষ্টে, অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত জীবনের জয়গান।  উল্টো দিকে যেসব কবি, গায়ক, শিল্পী যুদ্ধের শুরুতে এদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল তাদের অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। কবি সাহিত্যিকদের চারণভূমি সেটা যেখানে মানুষ তার ভাষায় কথা বলে, তার সৃষ্টি ধারণ ও বহন করতে পারে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের পিঠ চাপড়ানোর লোভে অনেকেই তখন দেশত্যাগ করে। এখন তাদের না আছে এদেশে অনুগ্রাহী, ওদেশে তো কখনই তেমন ছিল না আর থাকলেও সেটা সীমিত, সীমাবদ্ধ স্থানীয় রুশ ভাষাভাষী অভিবাসীদের মধ্যে। এখন যখন রুশ ভাষা, রুশ শিল্প সাহিত্যই নাই হয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সেখানে রুশ শিল্পী সাহিত্যিকদের কদর থাকবে কীভাবে?  আসলে যতদিন তাদের দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারবে সেখানে তত দিনই তাদের দাম আছে, কাজ ফুরিয়ে গেলেই তাদের আদর শেষ। সেদিক থেকে দেখলে যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই করে না, তৈরিও করে। তৈরি করে নতুন মানুষ, নতুন শিক্ষা, নতুন সাহিত্য। বিশেষ করে সেই যুদ্ধ যদি হয় আত্মরক্ষার জন্য। হানাদার বাহিনী সেটা পারে না, হানাদার দেশও না। পারে তারাই যারা সৃষ্টির জন্য যুদ্ধ করে, মৃত্যু নয়, জীবনের জন্য যুদ্ধ করে। শুধু দনবাসে নয়, নতুন কবিতা, নতুন গান, নতুন সাহিত্য তৈরি হচ্ছে রাশিয়ায়। যে সমস্ত শিল্পী সাহত্যিক যুদ্ধের পর দেশ ছেড়ে গেছে তাদের বেশির ভাগ ছিল সরকারের প্রিয়, জাতীয় রেডিও, টেলিভিশনে তাদের রাজ্যত্ব ছিল অবিসংবাদী। আর যাদের টিভিতে দেখায় সমাজের কাছে তারাও কমবেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের প্রতাপে অনেক প্রতিভাবান উঠতি শিল্পীরা সুযোগ পেত না নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে, অনেক প্রকাশক প্রকাশ করত না ট্র্যাডিশনাল রুশপন্থী লেখকদের বই। পশ্চিম পন্থী শিল্পী, লেখক, সাহিত্যিকদের ভিড়ে হারিয়ে যেত রুশপন্থীরা। এমনকি যুদ্ধের এই নবম মাসেও দেশপ্রেমী, দনবাসের সমর্থক অনেক লেখক (এবং বলতে চাই ভালো লেখক) তাদের বই প্রকাশ করতে বিভিন্ন সংস্থার সমর্থন পাচ্ছে না বিভিন্ন অজুহাতে। যদি আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও ট্র্যাডিশনাল বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী লেখক বিভিন্ন কারণে লাইম লাইটে আসতে না পারত তাহলে যে অবস্থার সৃষ্টি হত এটাও সেরকমই। এই যুদ্ধ দেশপ্রেমিক বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে যারা পজিটিভ ধারণা পোষণ করে সেই সব কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতাদের জন্য পথ করে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে যখন রাশিয়ার বাজার বিদেশী পণ্যে ভর্তি ছিল, তখন দেশী পণ্য হালে পানি পেত না। শিল্প ও ব্যাবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির চাপে ছিটকে পড়া স্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যেমন এখন একটু একটু করে বাজারে নিজেদের স্থান দখল করে নিচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তুলনামূলক কোয়ালিটি পণ্য সররাহ করছে, ঠিক একই ভাবে নতুন শিল্পীরা শুধু দেশত্যাগী শিল্পী সাহিত্যিকদের স্থান পূরণই করছে না, বরং সময়ের সাথে পায়ে পা রেখে যুগোপযোগী শিল্প ও সাহিত্য উপহার দিচ্ছে। নীচে কিছু সাম্প্রতিক গানের কথা দিচ্ছি। এটা অনেকটা আক্ষরিক অনুবাদ, হয়তো সে কারণে আবেদনটা ঠিকমত পৌঁছুতে না পারে, তবুও দিচ্ছি

আকিম আপাচেভ

«হাঁস সাঁতার কাটে, মেয়েরা গান গায়
আজোভস্তালে দৈত্যদের কবর দেয়া হয়
স্তেপের মাঝে ঘর পুড়ে
মেরী মাতা শিশুর জন্ম দেয়। »

অথবা ইউতার গান

«মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতার উপরে উঠতে হবে,
এটাই আমাদের দায়িত্ব।
ঈশ্বর শুনছেন।
ঈশ্বর দেখছেন। কূল দেখা যাচ্ছে না।
সংঘর্ষের ক্ষমাহীন আগুন,
বালক আগুনে প্রবেশ করে
শান্তিপূর্ণ আকাশের জন্য।»

অথবা আলেক্সাদর দাদালির

«হে দনবাস, আগুন জ্বালো!
সমস্ত রাশিয়ার জন্য, ভাইয়েরা, জ্বালো।
তাদের পায়ের নীচের মাটি পুড়ে ছারখার হয়ে যাক
আমাদের শহীদদের জন্য, ভাইয়েরা।
হে দনবাস আগুন জ্বালো –
কাজ কর ভাইয়েরা। »

কাজ কর ভাইয়েরা – এটা মগামেদ নুরবাগানদভ নামে দাগিস্তানের এক পুলিশের মৃত্যুর আগে উচ্চারিত শেষ কথা। পুলিশের এই সদস্য যখন তার বন্ধু ও সন্তানদের নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিল তখন তারা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ধরা পড়ে। মগামেদকে বলা হয় সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষে কিছু বলার জন্য, না বললে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। সে মৃত্যুকে বেঁছে নেয় এই বলে «ভাইয়েরা, কাজ কর»। পরে সন্ত্রাসবাদীরা ইউটিউবে সেই ভিডিও প্রচার করে। মগামেদ নুরবাগানদভকে রাশিয়ার বীর উপাধি দেয়া হয় আর তার শেষ বাক্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার কারণ হয়।

আগেই বলেছি যুদ্ধ শুধু ধ্বংস করে না, যুদ্ধ সৃষ্টিও করে। সৃষ্টি করে নতুন শিল্প, নতুন সাহিত্য, নতুন মানুষ। সৃষ্টি করে নতুন সময়। এক সময় মনে হত আজকালকার রাজনীতিবিদ মাত্রই সুবিধাবাদী। এখন যখন দেখি অনেক সাংসদ ছুটি নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন, অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা বিপদ মাথায় নিয়ে দনবাসের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন তখন বুঝি – না, এখনও সব কিছু বিক্রি হয়ে যায়নি। অনেক মহিলা দিনের পর দিন মোজা, সোয়েটার এসব বুনছেন সৈন্যদের জন্য, এরা এটা করছেন নিজের থেকেই। কেউ তাদের বলেনি। যেখানে ধনীরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে সাধারণ মানুষ তাদের সামান্য আয় থেকে কিছু বাঁচিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঠাচ্ছে। ইয়ানা পাপ্লাভস্কায়া নামে এক অভিনেত্রী যিনি রেড হুড সিনেমায় বাচ্চা মেয়ের অভিনয় করে সেই শিশুকালেই প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, আজ বললেন তাঁর সন্তান যুদ্ধে যেতে চাইছে। এসে বলেছে, “মা যদি তুমি আমাকে যেতে বারণ কর তাহলে বুঝব এতদিন তুমি যা যা করেছ, যেসব আদর্শে আমাকে বড় করেছ সেসবই ছিল লোক দেখানো।” “আমি কি বলব, বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু ছেলেকে না বলতে পারিনি। হয়তো আমি নিজেও যাব, যদি কোন ভাবে সেনাদের সাহায্য করতে পারি।” এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি। আবারও সাধারণ মানুষ প্রমাণ করছে দেশটা আসলে তাদেরই। তারাই ঝড়ে, বৃষ্টিতে, খরায়, তুষারপাতে, দুর্যোগে দেশের পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্যদিকে  শিক্ষিত মানুষদের এক বিরাট অংশ বসন্তের কোকিলের মত অপেক্ষায় থাকে কখন ঝড় থামবে, কখন তারা আবার নতুন করে অনেক টাকা আয় করতে পারবে আর সে টাকা বিদেশে পাচার করতে পারবে। আমাদের দেশের দিকেই তাকিয়ে দেখেন, শিক্ষিত মানুষ সুযোগ পেলেই বাইরে চলে যাচ্ছে। এমনকি চাকরি শেষে বিদেশেই যাপন করছে অবসর জীবন। তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়াশুনা করছে, সেখানেই গড়ে তুলছে নতুন জীবন। যদি তারা নিজেদের, নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ দেশের সাথে জড়িত না দেখে তাহলে সে দেশ তাদের কেমন করে হবে? আবার অল্প পড়াশুনা জানা মানুষ, গ্রামের কৃষক বা শ্রমিক যারা বিভিন্ন দেশে কাজ করছে, আরব সহ বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবন যাপন করে টাকাপয়সা দেশে পাঠিয়ে শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাড়াতেই সাহায্য করছে না, নিজেরা দেশে ফিরে সেখানে বসবাস করছে, সন্তানদের জন্য বাড়িঘর করছে, যাদের সমস্ত স্বপ্ন এই দেশ, এই মাটিকে ঘিরে – এ দেশটা তাদের হবে না কেন? আমরা শিক্ষিত মানুষরা প্রায়ই দেশপ্রেমের কথা বলি। নিজেদের দেশত্যাগের পক্ষে যুক্তি হিসেবে দুঃশাসন, গণতন্ত্রের অভাব ইত্যাদির কথা বলি। কিন্তু ভালবাসা যদি শর্ত সাপেক্ষ হয় সেটা কি আর ভালোবাসা থাকে? সাধারণ মানুষ মনে হয় সেভাবে ভাবেই না। তারা ভাবে না যে দেশকে ভালোবাসছে অথবা ভালোবাসছে না। তারা কোন প্রশ্ন না করে এই মাটিকে আঁকড়ে পড়ে আছে। কেন? কারণ তাদের অন্য কোন জন্মভূমি নেই। কারোই নেই। তবে আমরা যারা শুধু নিজেদের ভালোমন্দ নিয়ে ব্যস্ত, যারা দেশকে ভালোবাসার পরিবর্তে কিছু একটা পেতে চাই তারা সব জেনেও দূরে কোথাও সুখ শান্তি খুঁজি, আকাশের সমান আমাদের স্বপ্নগুলো ধরার জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ঘুরে বেড়াই। আর আমাদের চোখে যারা চাষাভুষা তারা নিঃশর্ত ভাবে দেশকে, দেশের মাটিকে ভালবেসে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দেয়। আর তাই তো দিনের শেষে দেশটা তাদেরই হয়। খবরে প্রকাশ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার এই পয়সাওয়ালা শ্রেণি এ পর্যন্ত ৬০ বিলিয়ন ডলারের উপর অর্থ বিদেশী ব্যাঙ্কে জমা রেখেছে। এটা বিভিন্ন দেশে রুশদের টাকাপয়সা আটক করার পর। এরাও এ দেশেরই মানুষ। এটাও রাশিয়া – ভিন্ন রাশিয়া। যুদ্ধের আগুন অনেককেই পোড়াবে। কিন্তু যুদ্ধের আগুনে শুচি হওয়া এই মানুষেরা কিভাবে নতুন দেশ তৈরি করবে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর। আমাদের দেশে শুরু করেও ধরে রাখতে পারিনি, বরং একাত্তরের পরাজিত শক্তির কাছে ধীরে ধীরে সমস্ত অর্জন বিকিয়ে দিয়েছি, দিচ্ছি। এখানে কী হবে সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারে। তবে আশা করা যায় যুদ্ধের পরে এদেশে অলিগারখদের ক্ষমতা কিছুটা হলেও খর্ব হবে আর দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক সম্পর্কের চাহিদা বাড়বে। আর সেজন্য দরকার যুদ্ধকে ঘিরে যে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে সেটাকে ধরে রাখা, তাকে যত্নে বড় করা। সে সম্পর্কে আমরা আগামী পর্বে বলব।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো