শিল্প সাহিত্য

নীলাভ নক্ষত্রের অপেক্ষায়

-রুখসানা বিলকিস (শান্তা)

মারুফ আর শাম্মী। ওরা দু’জন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মারুফ দু বছরের সিনিয়র শাম্মীর থেকে। কয়েক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল শাম্মী। এখানেই প্রথমে চান্স পায় ইকোনোমিক্সে আর ভর্তি হয়ে যায়। শাম্মী ঢাকা থেকে এসেছে। আর মারুফ পড়ছে কেমিষ্ট্রিতে। ওর বাড়ি ন‌ঁওগায়। মেধাবী ছাত্র হিসাবে প্রায় সবাই তাকে চিনে। ভদ্র এবং পড়ুয়া ছেলে। ক্লাসের বাইরে কোথাও তাকে দেখা যায় না তেমন একটা। দেখতেও বেশ ভালো। মেয়েরা নাকি ওকে খুব পছন্দ করে। এক মেয়ে তো সাহস করে বলেই ফেলেছিল ভালো লাগার কথা। কিন্তু মারুফ নাকোচ করে দেয়। কারন তার স্বপ্ন একটাই তাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এই সব প্রেম টেম করে সে সময় নষ্ট করতে চায় না।
কিন্তু শাম্মীকে দেখে তার খুব ভালো লেগে যায়। শাম্মী তখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাম্মী কবিতা আবৃত্তি করে। আর তা শুনেই মারুফ ফিদা‌‌ হয়ে পরে। শাম্মীও দেখতে বেশ। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের একহারা গড়নের ওকে অনেক আকর্ষনীয় লাগে। স্নিগ্ধ আর খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে। যে দেখে তার‌ই ভালো লেগে যায়। মারুফের আর দোষ কি। কিন্তু কি ভাবে বলবে শাম্মীকে তার মনের কথা তা খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে সব ভয় আর জড়তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে একদিন সরাসরি বলে দেয়। শাম্মী তো লজ্জায় মাথা নীচু করে এক দৌড় দিয়ে চলে যায় ক্লাসে। এর পরদিন আবার ক্লাসের এক ফাঁকে মারুফ শাম্মীর সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব গুছিয়ে সুন্দর করে আর ধীরে ধীরে কথা বলতে পারে ও। শাম্মীকে বলে যে সে যেন ভেবে উত্তর দেয়। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। কয়েকটা দিন ভাবনার পর শাম্মীও একদিন মারুফকে হ্যা বলে দেয়।
এরপর থেকে মাঝে মাঝে তারা সময় পেলে দেখা করে। কেউই ক্লাস ফাঁকি দেয় না। দুজনেই খুব ভালো পড়াশুনায়। মারুফ এখন মাষ্টার্সে পড়ছে। অনার্সে সে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট হয়েছিল। আশা করা যায় মাষ্টার্সেও তেমন রেজাল্ট হবে। যদি হয় তবে এই ক্যাম্পাসেরই শিক্ষক হতে পারবে সে। মারুফ ওকে ভবিষ্যতের স্বপ্নের গল্প বলে। পাশ করে সে দেশের বাইরে পড়তে যাবে। পড়ার প্রতি এক অদম্য নেশা তার। ক্যাম্পাসে এই জুটির একটা ভালো পরিচিতি আছে। অন্যদের মতন ওরা ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট করে না। নিজেদের কেরিয়ার গঠনে খুব বেশি মনোযোগ ওদের। শাম্মীর রেজাল্ট ও খুব একটা খারাপ হয় না।
আর কিছুদিন পর মারুফের মাষ্টার্স ফাইনাল আর শাম্মীর সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে ওরা। এর মাঝেই একদিন ওরা দেখা করে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। তারপর সন্ধ্যার দিকে যার যার হলে ফিরে যায়। দেখতে দেখতে একদিন তাদের রেজাল্ট বের হলো। যথারীতি মারুফ ফার্ষ্ট হলো। শাম্মীর খুশি‌ দেখে কে। পারে তো পৃথিবীর সব কিছু এক করে এনে জড়ো করে মারুফের জন্য। ওর এই অবস্থা দেখে বান্ধবীরা মুখ টিপে হাসে। আর ওদিকে শাম্মীর সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট দিল। সেও ভালো রেজাল্ট করেছে।
রেজাল্টের কিছুদিন পর‌ই একটা স্কলারশীপ পেয়ে মারুফকে চলে যেতে হলো কানাডায়। যাওয়ার আগে শাম্মীকে কথা দিয়ে গেলো সে ফিরে এসেই বিয়ে করবে ওকে। আর শাম্মী যেন প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লেখে। সামনে অনার্স পরীক্ষা। পড়াশুনাটা যেন ঠিক ভাবে করে।
একটা বছর হয়ে গেছে মারুফের যাওয়ার।‌ প্রথম প্রথম মারুফ নিয়ম করেই চিঠি দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। অনেকদিন অপেক্ষা করার পর যদি শাম্মী চিঠি দেয় তবেই তার চিঠি আসে। কিন্তু খুব ছোট করে লেখা। ব্যস্ত আছে পড়ালেখা নিয়ে। তাই সময় করে চিঠি লিখতে পারে না। এইসব কথা থাকত মারুফের চিঠিতে। শাম্মী যদি আগে চিঠি না লেখে তবে মারুফ চিঠি দেয় না। কেনো অমন হচ্ছে শাম্মী ঠিক বুঝতে পারছে না।
আর ঐ দিকে শাম্মীর বাবা উঠে পরে লেগেছেন শাম্মীকে বিয়ে দেয়ার জন্য। কারন তার অনার্স পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাসায় সে এখনো মারুফের কথা জানায়নি। পড়ালেখা আর সামনে মাষ্টার্স ফাইনাল তাই পরে বিয়ে করবে এই বলে বিয়েটা পিছিয়ে রাখার চেষ্টা করছে শাম্মী। কিন্তু ওর বাবা নাছোড়বান্দা। একটার পর একটা ছেলে দেখেই যাচ্ছেন উনি।
গতকাল শাম্মীর মাষ্টার্সের শেষ পরীক্ষা হয় গেছে। আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল বিকালের ট্রেনে বাড়ি যাবে আজ তাই। আর আজ‌ই দুপুরের ডাকে ওর নামে দুটো চিঠি এসেছে। একটা মারুফের আরেকটা ওর বাবার। কোনোটাই পড়া হয়নি। ট্রেন ধরতে হবে। তাই দ্রুত বের হয়ে গেলো স্টেশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সাথে ওর আরো কিছু বান্ধবী ছিল।
একটু পর ট্রেনটা ছেড়ে দিল। ব্যাগ থেকে চিঠি দুটো বের করল শাম্মী। কার চিঠি আগে পড়বে বুঝতে পারল না। অনেক ভেবে বাবার চিঠিটা আগে খুলল। পড়তে শুরু করল সে-
” মা আমার। আজ প্রায় এক বছর ধরে আমি তোমার জন্য পাত্র দেখছি। দেখতে ভালো আবার চাকরী ও ভালো। তবু তুমি বিয়ে করতে রাজী হচ্ছো না। আমি জানি না কেনো এমন করছ। সব বাবা মায়ের একটা দায়িত্ব থাকে তাদের মেয়েকে যোগ্য কোনো ছেলের হাতে তুলে দেয়ার। যাতে মরে গিয়েও শান্তি পায়। তোমার মা বেঁচে থাকলে হয়ত সে জানতে পারত কেনো তুমি বিয়ে করত চাচ্ছ না।
তোমরা বড় হয়েছ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজের পছন্দ ভালো বুঝতে পারো।
যাই হোক, এবার আমি শেষ একটা চেষ্টা করছি। ভালো আরেকটা পাত্রের খোঁজ পেয়েছি। তুমি রাজি হলে আমাকে বলো। আমি কথাবার্তা চালিয়ে নিবো। আর রাজি না থাকলে…..
ভালো থেকো। বাড়ি কবে আসবে চিঠি দিয়ে জানিও।
তোমার বাবা।”
চিঠিটা পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল শাম্মীর। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বের হলো তার বুকটা চিরে।
এরপর খুলল মারুফের চিঠি।
কিছুদিন আগে শাম্মীই চিঠি পাঠিয়েছিল। সে কবে আসবে, বাবা অস্থির হয়ে পরেছেন তার বিয়ে নিয়ে, বাসায় মারুফের কথা বলবে কি না এ সব কথা বলে। ভেবেছিল মারুফ এ ব্যাপারেই হয়ত লিখেছে। কিন্তু নাহ্! খুব হতাশ হলো শাম্মী। কোনো কথাই সে লেখেনি। কোনো আলোচনা না। এমন কি শাম্মীর পড়ালেখার ব্যাপারেও মারুফ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।
সেই আগের মত‌ই দু কথায় চিঠি শেষ। আমি পড়ালেখা আর রিসার্চ নিয়ে খুব ব্যাস্ত আছি। মনে হয় যেন একটা লেখাই ও বার বার কপি করে পাঠাচ্ছে।
মারুফের চিঠি পরে ও ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে র‌ইল। ওর দুহাতে দুজন প্রিয় মানুষের চিঠি। দুজনকেই সে খুব ভালোবাসে। কিন্তু ওকে কে বেশি ভালোবাসে? বাবা নাকি মারুফ?
প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা বাহির থেকে একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা ওর মুখে এসে পরছে। ছোট ছোট চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বার বার তাকাচ্ছে চিঠি দুটোর দিকে। আর এভাবেই একটা সময় সেই ঠান্ডা বাতাস‌ই যেন তার উত্তর দিয়ে গেলো। হ্যা, সে তার কাছেই যাবে যে তাকে বেশি ভালোবাসে। যে নাকি তার কথা বেশি ভাবে।
কঠিন এই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। তবে এই সিদ্ধান্তটায় মনের একটা দিক যেমন হালকা হলো তেমনি অন্য একটা দিক কিছুটা হলেও ভার ভার করতে লাগল।
ট্রেনটা এগিয়ে চলছে তার নিজস্ব গন্তব্যে। চারিদিকের অন্ধকারকে ছাড়িয়ে। ঘরবাড়ি, চা বাগান, দেবদারু গাছ সব কিছুকে পিছনে রেখে ছুটছে তো ছুটছেই।
সেই দিকে তাকিয়ে থেকে শাম্মী ধীরে ধীরে মাথাটা পেছনের সীটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। তারপর সে ট্রেনের সুমধুর ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দ এক মনে শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে নিজেকে সপে দিলো।