চলমান সংবাদ

উম্মুক্ত বাজারের পরিবর্তে গম পরিবহনে মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে খাদ্য অধিদপ্তর

– বিক্ষুদ্ধ জাহাজ মালিকরা

আভ্যন্তরীণ নৌ রুটে চলাচলকারী জাহাজ মালিকরা অভিযোগ করেছেন খাদ্য অধিদপ্তর উম্মুক্ত বাজারের পরিবর্তে কোন প্রকার নিয়ম নীতির তয়াক্কা না করে নৌ পথে গম পরিবহনের জন্য মাত্র ৮টি কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যা নজিরবিহীন। এতে জাহাজ মালিকরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

জানা যায়, সরকার দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাড়ে ৭ লাখ টন গম এবং ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানি করছে। সরকারিভাবে আমদানিকৃত এসব চাল ও গম সরকারি গুদামে সংরক্ষণ করা হবে। তবে রাশিয়া থেকে আমদানি করা ৫ লাখ টন গমের একটি বড় অংশ চট্টগ্রাম সাইলো থেকে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে পৌঁছে দেয়ার জন্য খাদ্য অধিদপ্তর ৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রাইভেট মেজর কেলিয়ার বা পিএমসি নামের এসব পরিবহন ঠিকাদার মূলত লাইটারেজ জাহাজের মালিক। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মেসার্স গ্লোবাল মার্কেন্টাইল শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং, মেসার্স ইরা কর্পোরেশন, মেসার্স এসটি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ফারুক ব্রাদার্স শিপিং লাইন্স, মেসার্স মীম সরোদ কনস্ট্রাকশন, মেসার্স শাহজালাল নেভিগেশন লিমিটেড, মেসার্স বাবুল ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড কোম্পানি (জেভিসিএ), মেসার্স ফয়সল নেভিগেশন এবং মেসার্স কাজী শহীদুর রহমান।

চট্টগ্রাম সাইলো থেকে গম বোঝাই করে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে পৌঁছে দেয়ার জন্য উক্ত ৮টি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে খাদ্য বিভাগ। টেন্ডারের মাধ্যমে নির্বাচিত উক্ত ৮টি প্রতিষ্ঠানকে ডব্লিউটির ঘোষিত দর থেকে বেশি দরে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ওই নিয়োগ নিয়েও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, উক্ত ৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মূলত চারজন মানুষের। স্বামী ও স্ত্রীর নামে দুটি দরপত্র কিনে টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পেয়েছেন তারা। এতে করে প্রতিষ্ঠান ৮টি হলেও নিয়ন্ত্রক মাত্র ৪ জন মানুষ। এই চারজন মানুষই দেশের খাদ্য বিভাগের গম পরিবহনের কাজটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজগুলোর তুলনায় বেশি টাকা ভাড়া নিয়েও তারা কাজ পেয়েছেন। তাদের থেকে অনেক কমে এই গম পরিবহনের ব্যবস্থা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে গম পরিবহনের ব্যাপারটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।

লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জ গম পরিবহনের ভাড়া প্রতি টন ৬৮৭ টাকা। অথচ খাদ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সাইলো থেকে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে গম পরিবহনের কাজ দিয়েছে প্রতি টন ৮৮৯.৫০ টাকা দরে।

সম্প্রতি উক্ত চুক্তির সাথে নজিরবিহীনভাবে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করে গম পরিবহনের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। চার ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন উক্ত ৮টি প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে সাইলোর পরিবর্তে বহির্নোঙর ও কুতুবদিয়া থেকে সরাসরি নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে গম পরিবহন করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে করে বহির্নোঙর থেকে সাইলো পর্যন্ত আসা-যাওয়ার জ্বালানি এবং সময় বেঁচে গেলেও টন প্রতি ৩০০ টাকা বাড়তি ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থাৎ সাইলোর পরিবর্তে বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জ গম পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮৯.৫০ টাকার সাথে বাড়তি ৩০০ টাকা মিলিয়ে মোট ১১৮৯.৫০ টাকা। অথচ ডব্লিউটিসি বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জে গমের ভাড়ার হার প্রতি টন ৬৮৭ টাকা। একজন সাধারণ জাহাজ মালিক ৬৮৭ টাকায় যে গম নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে দেন সেই গম নেয়া হচ্ছে ১১৮৯.৫০ টাকা ভাড়ায়। টন প্রতি ৫০২.৫০ টাকা বাড়তি দিয়ে গম পরিবহনের কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

অপরদিকে কুতুবদিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জে গম পরিবহনের ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে প্রতি টন ৮০২ টাকা। কিন্তু খাদ্য বিভাগ পরিবহন করাচ্ছে ১২৮৯.৫০ টাকায়। এক্ষেত্রে ডব্লিউটিসির নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রতি টনে বাড়তি ভাড়া দেয়া হচ্ছে ৪৮৭.৫০ টাকা। পাঁচ লাখ টন গমের মধ্যে দুই লাখ টনও যদি লাইটারিং করা হয় তাহলে এক্ষেত্রে কয়েক কোটি টাকা বাড়তি যোগান দিতে হবে।
খাদ্য বিভাগের গম পরিবহনে এই ধরনের চুক্তির নজির নেই উল্লেখ করে বলা হয়েছে, অতীতে সাইলো থেকে সাইলোতে পণ্য পরিবহন হতো। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম সাইলোর পরিবর্তে বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে গম পরিবহন শুরু করা হয়। কিন্তু এর জন্য বাড়তি কোনো ভাড়া না দিয়ে বলা হয়েছিল পতেঙ্গার গ্রেন সাইলো পর্যন্ত আসা-যাওয়ার জ্বালানি বেঁচে যাওয়ায় লাইটারেজগুলো আরো কম ভাড়ায় গম পরিবহন করতে পারে। কিন্তু তখন ভাড়া কমানো হয়নি। চট্টগ্রাম সাইলো থেকে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে গম পরিবহনের যে ভাড়া নির্ধারণ করা ছিল সেই ভাড়াতে বহির্নোঙর থেকে গম লাইটারিং করে নারায়ণগঞ্জ সাইলোতে পরিবহন করা হতো। এবার একইভাবে গম পরিবহন করার চুক্তি হলেও টন প্রতি কুতুবদিয়া থেকে ৪০০ টাকা এবং বহির্নোঙর থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি ভাড়া প্রদান করা হচ্ছে। দুই লাখ টনের বেশি গম পরিবহনের এই চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে টাকা লেনদেনের পাশাপাশি প্রমোদ ভ্রমণে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

সাধারণ জাহাজ মালিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এভাবে সিন্ডিকেট করে ব্যবসাটি হাতিয়ে না নিলে সব জাহাজ মালিক ব্যবসাটি পেতেন এবং কয়েক কোটি টাকা কম খরচে গমগুলো সরকারি গুদামে পৌঁছানো যেত।

এ ব্যাপারে খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টি উপর মহলের সিদ্ধান্ত। আমাদের কিছু বলার নেই। বিদেশ থেকে সরকার গম আমদানি করেছে। আমরা শুধু এগুলোর মান এবং পরিমাণ দেখে থাকি। কীভাবে পরিবহন হবে, কত টাকায় পরিবহন হবে সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিই না।

# ১২/১১/২০২২, চট্টগ্রাম #