মতামত

জাসদ রাজনীতির ৫০বছর: ১৯৭২ – ২০২২(২য় পর্ব)

– অপু সারোয়ার

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জাসদের যাত্রা শুরু। আ স ম রব ও মেজর জলিলকে যুগ্ম আহবায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি ঘোষিত হয়েছিল। (১১)জাসদের প্রথম ঘোষণা পত্রের ছত্রেছত্রে  জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা উচ্চারিত হয়েছে। এই ঘোষণা পত্রের ভাষ্যানুযায়ী  ” বিপ্লবী চেতনার অধিকারী বাঙালী জাতির জীবনে কৃষক , শ্রমিক ও প্রগতিশালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই কেবল একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সংগঠন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারাই সেই ইস্পিত শ্রেণীহীন সমাজ ও কৃষক -শ্রমিকের রাজ্ কায়েম করা যেতে পারে। শ্রেণী দ্বন্দ্ব অবসানের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতর করে সামাজিক বিপ্লবকে ত্বরানিত করার জন্য পরিস্থিতি ও পরিবেশগত কারণে ‘ সহায়ক শক্তি ‘হিসেবে রাজনৈতিক গণ সংগঠনের যে ঐতিহাসিক প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করেই এবং বাংলাদেশের লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি লাভ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশের শোষিত , বঞ্চিত কৃষক- শ্রমিক , মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব সংগঠন হিসেবে জন সমক্ষে আত্মপ্রকাশ করছে এবং এই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক জন যুদ্ধ ঘোষণা করছে। “ (১২) জাসদ ঘোষণা পত্রে ৮ দফা দাবী পেশ করে। এই দাবী গুলির অধিকাংশই জাতীয়তাবাদী । এই দাবীর তৃতীয় ধারা ” সমাজতান্ত্রিক বিধি -ব্যাবস্থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত  হিসেবে গণ্য করা। “ সাধারণ ভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা  সমাজতান্ত্রিক মত ও পথ প্রচারের সহায়ক। জাসদের ঘোষণা পত্রে বিষয়টি উল্টা ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ! সম্ভবতঃ ছাপার বিভ্রম অথবা চিন্তার গোল্লাছুট খেলা! জন্ম লগ্ন থেকেই জাসদ যে সমস্ত রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে তা সব গুলি গণতান্ত্রিক আন্দোলন।

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জাসদের প্রথম কেদ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অহ্বায়ক কমিটির বক্তব্য শিরোনামে জাসদ গঠনের কারণ ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয় ।  ‘বিপ্লবী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং রায় ‘ নিয়ে জাসদ গঠনে কথা উল্ল্যেখ করা হয় এই পুস্তিকাতে । গঠনের পর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়ে ছিল জাসদ। তবে ‘ জনগণের রায়’  দিয়ে তৎকালীন জাসদ উদ্যোক্তারা কি বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। সচরাচর নির্বাচনে জয় লাভকে জনগণের রায় হিসেবে গণ্য করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে ডিসেম্বরের আগে দেশে কোন নির্বাচন হয় নাই।  কোন গোষ্ঠীর মতামত বা চিন্তাকে জাতি বা জন রায়  নামে চালিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকেই সৃষ্ট হয় স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।  এই পুস্তিকায় যুদ্ধত্তোর দেশের শাসন ব্যাবস্থাকে ‘এক ব্যক্তির শাসন ও ব্যক্তি পূজার  ‘ অভিযোগ এনেছেন জাসদ গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে । ২৫ মার্চ ১৯৭১ পূর্ব সময় কালে আওয়ামী লীগের নীতির তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে এই পুস্তিকায়। ” পঁচিশে মার্চ [১৯৭১ সাল ] রাত্রি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সম্পর্কে জনগণকে কেন নির্দেশ তো দেয়নি বরং পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছিলেন। ………..আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছিল জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশ দিতে। তাই কোন প্রকার নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছাড়াই স্বতন্ত্র ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা। যুব সমাজের নেতৃত্বে কারখানার শ্রমিক , গ্রামের কৃষক, ছাত্র জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ” (১৩)

১৯৬০-৭০ এর দশক বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের জয়-জয়কারের সময় কাল। ঠিক একই সময় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিকাশের যুগ। বিশ্বব্যাপী এই সময়ে নানা ধরণের যুদ্ধবিরোধী , নারীবাদী ও পরিবেশ বাদী আন্দোলনের বিকাশ কাল। বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে জাতিগত নিপীড়ণ – উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল । এই ধারায় ১৯৪৭-১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ছাত্র ফেডারেশন – ছাত্র ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ছাত্র যুবকদের সংগঠন ছিল। শহরের মধ্যবিত্তের ছাত্র-যুবকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি ভূমি হয়ে উঠে শহুরে মধ্যবিত্ত। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের উৎপত্তি মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে। ছাত্রলীগের বিকাশ জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনে। ১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ ‘ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছিল। এই প্রস্তাবের পক্ষের শক্তি যুদ্ধত্তোর দেশে প্রথমে ছাত্রলীগ ( বৈ: স ) এবং এর ধারাবাহিকতায় জাসদের জন্ম দিয়েছিলেন । এই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগে ভাঙ্গন দেখা দেয় ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে। ১৯৭০ সালের ১২ অগাস্ট ‘ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ ‘ প্রস্তাবনার স্বপক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা কত টুকু প্রসারিত ছিল তা আলোচনার দাবী রাখে। ” সত্তর [ ১৯৭০ ] সালে নেতাদের মধ্যে না হলেও কর্মীদের ব্যাপক অংশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অধ্যায়নের তাগিদ অনুভূত হয় , আগ্রহের সৃষ্টি হয়  মার্ক্সবাদী দর্শন সম্পর্কে জানার। ……ছাত্রলীগের বিপুল কর্মী বাহিনীর মধ্যে যেভাবেই হোক এই উপলব্ধি জন্মেছিল যে , বাংলার দুঃখী অনাহারক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির একমাত্র পথ। ”  (১৪) এই সময় কালে ছাত্রলীগের মধ্যে সমাজতন্ত্র বিরোধী চিন্তার প্রভাবশালী নেতা কর্মীদের অবস্থান ছিল। আবার যাঁরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতেন তাঁদের একাংশই হো / মাও / চীনে যাও ব্যাঙ খাও  এর মত অসহিষ্ণু ও নিচু মানের স্লোগান দিত।

জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অভিমুখী প্রবণতাকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ অগাস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশগঠন করার প্রস্তাব পেশ করেন তৎকালীন প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরী (‘৭১ মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ / শহীদ হন ) কেন্দ্রীয় কমিটিতে তখন সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৫ জন অনেক বাকবিতন্ডার পর এই প্রস্তাব পাশ হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ছাত্রলীগের জন প্রভাবশালী সদস্য ভোট দেয়। আব্দুর রাজ্জাকের মারফত শেখ মুজিব এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে খবর পাঠান। ….. কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রস্তাব শেখ মুজিব আব্দুর রাজ্জাকের অনুরোধে সংশোধন করতে হয়। শেষ পর্যন্তস্বাধীন বাংলাদেশগঠনের প্রস্তাব নেয়া হয়। …………. ছাত্রলীগের ভেতরে অবস্থিত দুটি পরস্পর বিরোধী গ্ৰুপের কারণেই হয়তো তারা [ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের ] বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। (১৫) কাজী আরেফ আহমেদের বর্ণনা থেকে জানা যায় শেখ মুজিবের বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাবনা থেকে সরে আসে সমাজতন্ত্রী পক্ষ। যুদ্ধত্তোর দেশে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ও জাসদ প্রতিষ্ঠা পক্ষে যুক্তি দিতে নিজেদের পরিত্যক্ত স্লোগানকে হাতিয়ার হিসেবে তুলে নেয় ছাত্রলীগের একাংশ। নিজেদেরকে পরিচিত করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে। জাসদ ইতিহাস বর্ণনায় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের কথা বিশেষ গুরুত্ব পায়।

তৃতীয় এবং সর্বশেষ পর্ব আগামী রবিবার প্রকাশিত হবে

অপু সারোয়ারঃ ফ্রি ল্যান্স লেখক

তথ্য সূত্রঃ

(১১) ১ নভেম্বর ১৯৭২, গণকণ্ঠ। জাসদ ঘোষণা কালীন ৭ সদস্য: মেজর এম এ জলিল, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতান উদ্দিন আহমদ, নূরে আলম জিকু ও রহমত আলী। রহমত আলী কখনই জাসদ রাজনীতিতে যুক্ত হন নাই। জাসদ পক্ষ অভিযোগ করে থাকে রহমত আলীকে অপহরণ করে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল।

(১২) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম ঘোষণা পত্র। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২।

(১৩) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনে -আহ্ববায়ক কমিটির বক্তব্য। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল।

(১৪) কাছের মানুষ দূরের মানুষ – রায়হান ফিরদাউস মধু। কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক স্মারক গ্রন্থ। পৃষ্ঠা ৩৪৯ ।

(১৫) বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্র – কাজী আরেফ আহমেদ। পৃষ্টা ৭৫ ।