মতামত

সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাব্বির মৃত্যুর পর তার আসন শূন্য হয়। আসনটি ছিল গাইবন্ধা জেলার ৫ নং আসন।  গত ১২ অক্টোবর উক্ত আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ধার্য্য ছিল। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন চলাকালীন মাঝপথে কমিশন পুরো নির্বাচন বাতিল করে দেন। এটা সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে অভিনব এবং নজিরবিহীন এক ঘটনা। ইতিপূর্বে এ ধরণের ঘটনা কখনো ঘটেনি। এ ঘটনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে দাবি করতে চাইবে তারা সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত।

এই নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কোন প্রার্থী ছিলনা। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। সুতরাং বিএনপি বা বিএনপি জোটের কোন প্রার্থী না থাকায় এক অর্থে নির্বাচন একপেশে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর বিজয় লাভের সম্ভাবনাই ছিল বেশি। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগ প্রার্থী হেরে যেত তাহলেও ক্ষমতার কোন রদ বদল হতোনা। সেই অর্থে নির্বাচনটি ছিল অনেকটা গুরুত্বহীন। এরকম গুরুত্বহীন একটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন শুধু ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় পর্যবেক্ষন করে নির্বাচন বাতিল করার মত সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস দেখাতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে এধরণের কোন পদক্ষেপ নেয়া আদৌ সম্ভব কিনা সেটা এক জটিল এবং অমীমাংসিত প্রশ্ন।

নিন্দুকেরাতো ইতিমধ্যেই বিষয়টি সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পাতানো খেলা কীনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আবার অনেকে প্রশংসাও করেছেন। বলা যায় দেশে এই ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তবে  নির্বাচন কমিশন একটা বিষয় পরিস্কার করেছেন, সেটা হলো ইভিএম এর মাধ্যমে ভোট হলেও কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন একটা বিশেষ দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

এ ব্যাপারে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিগত নির্বাচনেও আমার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতাও হয়েছে।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আমি চট্টগ্রাম ৯ আসনের ভোটার ছিলাম। আমার ভোট কেন্দ্র ছিল বাগমনিরাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমি ভোট দিতে গিয়ে দেখি, সম্পূর্ণ ভোট কেন্দ্র একটি বিশেষ দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। বুথের গোপন কক্ষে ইভিএম এর পাশে ভোটারদের সহযোগিতা করার জন্য একজন অবাঞ্চিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। তবে সে আমাকে পূর্ব থেকে চিনতো বলে তেমন কিছু বলেনি। যথারীতি আমি আমার পছন্দের প্রার্থী সিপিবি থেকে মনোনীত কমরেড মৃণাল চৌধুরীকে কাস্তে মার্কায় আমার ভোট দিয়েছিলাম। সেটা গোপন বুথে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি দেখতে পায় এবং মুহুর্তের মধ্যে পুরো এলাকায় সংবাদ হয়ে যায়। পরিচিত সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, “তুমি নাকি কাস্তে মার্কায় ভোট দিয়েছ”? কেউ কেউ আমার ভোট পঁচে গিয়েছে ভেবে আমাকে ভৎসনাও করেছেন।

আমার স্ত্রীও একই কেন্দ্রের ভোটার ছিল। তাকে সাহায্য করার নামে একটি বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। আরো অনেকের ক্ষেত্রে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সুতরাং ইভিএম এ ভোট নেয়া হলে কেন্দ্রে কী হতে পারে সেই অভিজ্ঞতা আমার ২০১৮ সালেই হয়েছে।

পরবরতীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি স্থানীয় বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। বলাবাহুল্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আমার একই অভিজ্ঞতা হলো -দেখলাম গোপন কক্ষে ভোটারদের সহযোগিতা করার জন্য একজন দাঁড়িয়ে আছেন। সে আমাকে দেখিয়ে দিল কোথায় বাটন চাপতে হবে? আমি শুধু হাসলাম। অর্থাৎ ২টা নির্বাচনে দেখলাম ভোট কেন্দ্র কীভাবে একটি বিশেষ দলের প্রার্থীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে থাকে। কেন্দ্রে শুধু ভোটারের আঙ্গুলের ছাপটা নেয়া হয়। ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে না।

ধারনা করছি, বিগত ১২ অক্টোবর সেই ধরণের ঘটনার একটা মহড়া হয়তোবা হয়েছে গাইবান্ধার উপ নির্বাচনে। ইতিমধ্যে সরকারী দলের পক্ষ থেকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা গণমাধ্যমে এই ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল, অধিকাংশ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তাগন নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছে বলে লিখিত রিপোর্ট করেছেন। আবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের জানান নির্বাচনে অনিয়ম দেখার পর, কমিশন কর্তৃক স্থানীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে দেয়া নির্দেশনা মানা হয়নি। এমনকি গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও কমিশনকে সহযোগিতা করেনি।

এই নির্বাচনে দুইটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী এবং ব্যাপক জনভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে জনগনের প্রতি এক ধরণের আস্থাহীনতা কাজ করছে। তারা পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জনভিত্তিহীন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এবং বদরুদ্দোজার বিকল্প ধারার মত নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোর বিপক্ষেও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার মত যথেষ্ট সাহস দেখাতে পারছেন না। এটা আসলেই খুব দুঃখজনক এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটা অশুভ ইংগিত।

দ্বিতীয়ত নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অধিকাংশ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে লিখিত রিপোর্ট দিয়েছে। যা দৃশ্যত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, তারা জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলেও সুষ্টু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েই নির্বাচন বাতিল করেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, স্থানীয় প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা।

এছাড়া গাইবান্ধা নির্বাচনের পূর্বে নতুন নির্বাচন কমিশন মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের সাথে প্রথম মতবিনিময় সভাতেই নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমানের বক্তব্য প্রদানে বাধা প্রদান এবং হৈ চৈ করে তারা কমিশনের কাছে তাদের অবাধ্যতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে এবং আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় কোন দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচন হলে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এক ধরণের টানাপড়েন থাকে ফলে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের মধ্যে দোদুল্যমনতা তৈরি হয়। যা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান অন্তরায় বলে আমি মনে করি। আমরা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে দেখেছি সেই সময় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন যতটুকু নিরপেক্ষ ছিল সেটা অতিতে কিংবা পরবর্তীতে আর কখনো দেখা যায়নি। সুতরাং নাগরিক সমাজের অংশ হিসাবে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নাই।

(লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী)