মতামত

চৌধূরী হারুনুর রশিদ : বিপ্লবী রাজনীতির প্রবাদপুরুষ

চিন্তায়-মননে, কর্মে-প্রতিজ্ঞায়, আচারে- যাপিত জীবনে আমৃত্যু বিপ্লবী হিসাবে পথচলা বস্তুত এই ভোগবাদী বৈরী সমাজে এক নিরন্তর সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম যত না প্রতিকূল শক্তি ও প্রতিবেশের বিরুদ্ধে তার চেয়ে বেশি মনে হয় নিজের সহজাত স্বার্থান্ধ শ্রেণি সত্তার বিরুদ্ধে। আত্মত্যাগ ও নিরন্তর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ক্রমে শ্রেনিচ্যুত হয়ে সমাজ বদলানোর এই সুকঠিন লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গিত, সর্বস্বত্যাগী, ঋষিতুল্য পরীক্ষিত একটি পুরো বিপ্লবী প্রজন্ম বিগত শতকের ত্রিশের দশকের শেষভাগ থেকে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত আমাদের দেশের বাম রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে সমাজ ও রাজনীতিকে ত্যাগের মহিমায়, নৈতিক শুদ্ধতায়, বিপ্লবী ভাবাবেগে প্রাণিত করেছিল, প্রভাবিত করেছিল জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোত ধারাকে। চৌধুরী হারুন সেই প্রজন্মের একজন বয়োকনিষ্ট বিপ্লবী ছিলেন।

কিন্তু সেই পরিশুদ্ধ, কল্যাণকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজ বাজার রাজনীতি ও লুটেরা অর্থনীতির নৈরাজ্যকর পরিবেশে প্রায় অর্ন্তহিত। এরি প্রভাবে বর্তমানে সমাজে রাজনীতিতে এমনকি কথিত কিছু বাম রাজনৈতিক নেতার জীবনাচরণ, কথা ও কাজের দুস্তর বৈসাদৃশ্য, ভন্ডামি, বুুর্জোয়া নেতাদের মত নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দলে প্রধান্য বজায় রাখার নির্লজ নিবিষ্টতা দেখে কষ্ট হয়, মনে হয় দেশের রাজনীতির এটি এক বড় সংকট। ছোট বড় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের তথা প্রচলিত রাজনীতির দীর্ঘদিনের এই অসহনীয় নীতিহীন দ্বিচারিতা থেকে উদ্ভুত গণতন্ত্রহীনতা ও তার ফলে সৃষ্ট ধর্মান্ধ সমাজ মানসের প্রাবল্যে এবং পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মানব মুক্তির সংগ্রামের ভাবাদর্শগত সংকটের প্রেক্ষিতে বিভ্রান্তির যে কালোছায়া প্রগতিশীলদের মধ্যে এবং পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে তা বলতে গেলে অদৃষ্টপূর্ব। ’৮০ দশক পর্যন্ত আজন্ম যে দল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করল ক্ষমতার সমীকরণে সেই দল গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা ও আস্থাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, যাঁরা শুধু গণতন্ত্র নয় মানব মুক্তির লক্ষ্যে আরো উন্নত গণতন্ত্র ও সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে আজীবন নিরন্তর লড়াই করল সেসব দলের নেতারা দিন শেষে পরস্পর বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত হয়ে পড়ছেন সাংগঠনিক স্তরে, আত্মিকভাবে, এক বিশুদ্ধবাদী চৈতন্যের আত্মগত ভাবনা ও পরিত্যাজ্য বিপ্লবী অহংবোধের অবিপ্লবী সর্বনাশা পথে, ব্যক্তি-প্রাধান্য বজায় রাখার দূর্মর অভিপ্রায়ে। এমনকি খবর নিলে দেখা যাবে অনেকেই সংগোপনে দুর্নীতিতেও জড়িয়ে আছেন, নিছক অর্থহীন ধর্মাচারেও যুক্ত হয়ে পড়ছেন। মার্কসের সেই যে কথা- ৎঁষরহম পষধংং এর াধষঁবং গুলো সমাজ শাসন করে তা যে কত সত্য ও সঠিক তা কিছু কথিত বাম নেতার কাজে আবারো প্রমাণিত হচ্ছে।

কেন যেন মনে পড়ছে সেই কবিতা ুঞযরহমং ভধষষ ধঢ়ধৎঃ/ঃযব পবহঃৎব পধহ হড়ঃ যড়ষফচ। কেন্দ্র ভেঙ্গে পড়ছে, কেন্দ্রাতিগ শক্তি যে দূর্বল হয়ে পড়েছে তা স্পষ্ট। কিন্তু কেন্দ্র তো কোন ধনংঃৎধপঃ কিছু নয়, সঠিক বিপ্লবী কেন্দ্র তো কিছু সর্বার্থে সৎ, উৎসর্গিত, অনুকরণযোগ্য, বিপ্লবী নেতাদের সমষ্টিমাত্র, যাঁরা বিদ্যায়, প্রজ্ঞায়, সৃজনশীল চিন্তা ও তত্ত্বে, বিজ্ঞান মনস্ক ভাবনায় ও আন্তরিকতায় ঋদ্ধ। যাঁদের দেখে অতীতের মত প্রাণিত হবে দেশের তারুণ্য, উদ্দীপ্ত হবে সমাজ, সমস্ত প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে দীপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে সব শ্রেণি পেশার মানুষ। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এ দেশের রাজনীতিতে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত দীর্ঘদিন সময়ের নানা বাঁক বদলের মধ্যেও সিপিবি’র সর্বস্ব ত্যাগী উদার নেতৃত্বের এক ঈর্ষনীয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গ্রাহ্য একটি কেন্দ্র ছিল- যে কেন্দ্রের অমোঘ আকর্ষণে বিরাট এক ঝাঁক তরুণ বিপ্লবী কর্মী ছাড়াও দেশের শ্রেষ্ঠ সব প্রগতিশীল কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের এক বিশাল বলয়ের সৃষ্টি হয়। মনিসিং, মোহাম্মদ ফরহাদ, আবদুস সালাম, অনিল মুখার্জি, খোকা রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী, আবদুস সাত্তার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার প্রমুখ ও জেলায় জেলায় এরকম আরো অনেক জীবন নিবেদিত নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত সেদিনের অতুলনীয় ত্যাগী ও বিপ্লবী রাজনীতির সেই কেন্দ্র সারাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষের কাছে ছিল পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের। বিদগ্ধ বিপ্লবী পুরুষ, মার্জিত ও রুচিশীল ব্যক্তিত্ব, মহান ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, এদেশের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নেতা, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম সাবেক সম্পাদক, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি, বিশিষ্ট বাগ্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, কৌতুকপ্রিয় ও সদালাপী, সাবেক সাংসদ, আমৃত্যু বিপ্লবী ভাবাদর্শিক জীবনবোধ ও আচারে একনিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠক চৌধুরী হারুনুর রশিদ ছিলেন এ দেশের সুস্থ বিপ্লবী রাজনীতির সেই ঈর্ষণীয় কেন্দ্রের একজন বিরলপ্রজ অন্যতম প্রাণ পুরুষ।

চৌধুরী হারুনুর রশিদ পটিয়ার মনসা গ্রামের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। নির্যাতিত হত দরিদ্র মুসলিম সমাজের মুক্তির প্রশ্নে তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগের ছাত্র ও যুবকর্মী হিসেবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন হাবিলাসদ্বীপ ও পটিয়ার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তিনি অসাম্প্রদায়িক মানবিক সত্ত্বায় মনে মননে বেড়ে উঠেন। ফলে চট্টগ্রামে মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রভাবশালী যুবনেতা হিসেবে তিনি মুসলিমের লীগের উদার, অসাম্প্রদায়িক ধারার সাথে যুক্ত হন এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল যুব মানসের মোহ ভঙ্গ হতে শুরু করে। চৌধুরী হারুনও নিজের রাজনৈতিক ভবিতব্যের তথা মানব মুক্তির রাজনীতির ধারায় যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত হন ও চট্টগ্রামের প্রথম পত্রিকা ‘সীমান্ত’ তে কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালে রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের সভাপতি নির্বাচনে মুসলিম লীগের অপর প্রভাবশালী নেতা ও প্রার্থী চেরাগ খানকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন চট্টগ্রামের রাজনীতিক মহলে। শ্রমিক রাজনীতিতে সেই তাঁর হাতে খড়ি। এরি মধ্যে তিনি ১৯৫০ সালে দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৫১ সালে মার্চে হরিখোলার মাঠে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর সময়ে তিনি নিষিদ্ধ কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি চট্টগ্রামের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লালদিঘীর ময়দানের বিশাল জনসভায় অসুস্থ কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তাঁর বিখ্যাত কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” জলদগম্ভীর ও উদাত্ত কন্ঠে পাঠ করে উপস্থিত বিশাল জনসমাবেশকে উদ্দীপ্ত ও আবেগাপ্লুত করে ফেলেন। এর পরপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পরে পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে ১৯৫৭ সালে নবগঠিত ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী করে এবং তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১৩০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। পার্টির নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে চলে যান ও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত হুলিয়া মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামে শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত করেন। জুটমিল শ্রমিক ও রেল শ্রমিক আন্দোলনে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি কর্ণফুলী জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পার্টির বিভক্তির পরে তাঁর অনুপস্থিতিতে মাওবাদীরা জুটমিল শ্রমিক ইউনিয়নে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ও পুরো সংগঠনকে বিপথে চালিত করে। তিনি তৎকালীন সিপিবি ও ন্যাপের জেলা ও প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন। কমরেড অমর সেনের মৃত্যুর পর তিনি পার্টির চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিসেবে তিনি ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের যুগ্ম কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কেন্দ্রীয় ন্যাপ নেতা হিসাবে প্রকাশ্যে সুপরিচিত হন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন ও দেশে বিভ্রান্ত বাম শ্রমিক রাজনীতির বিপরীতে একটি বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতা হিসেবে বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের নানা কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ন্যাপের একাংশের সভাপতি হন। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলের প্রার্থী হিসেবে পটিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। অসুস্থ শরীরেও তিনি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ন্যাপ ও সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে তিনি এ দেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর তাঁর বর্ণাঢ্য ও গৌরবদীপ্ত অসামান্য ত্যাগী জীবনের অবসান ঘটে।

মজুরি দাসত্বের নিপীড়ন থেকে শ্রমিক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষে তিনি এক সংস্কারমুক্ত আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের জন্য নিঃশেষে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। চৌধুরী হারুন শুধু রাজনীতিবিদ ও শ্রমিকনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ সমাজ বিজ্ঞানী। সমাজ বিকাশে জটিল গ্রন্থিগুলোর রহস্য তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় অনায়াসে বিশ্লেষণ করতে পারতেন। সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। আজীবন রাজনীতির ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ধর্মান্ধতা, আচার সর্বস্ব সমাজিকতা, ভোগবাদ, শঠতা ও ভন্ডামির বিপরীতে তিনি ছিলেন বিজ্ঞান মনস্ক, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় উৎসাহী, ব্যক্তিগত জীবনাচারে সংস্কারমুক্ত, আজীবন ত্যাগী ও নিবেদিত একজন নেতা ও এক উন্নত বিপ্লবী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুসারী। আজকের এই দুঃসময়ে দুর্বৃত্তায়িত, লুটেরা, ধর্মান্ধ ও ভন্ডামিতে নিমজ্জিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুঃশাসনে শৃঙ্খলিত জনজীবনের মুক্তির ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক সংগ্রামে চৌধুরী হারুন আমাদের প্রেরণার নিরন্তর উৎস, আজকের প্রকৃত বিপ্লবী তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষিত রোল মডেল। ১৯ অক্টোবর এই মহান বিপ্লবী জননেতার ২২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধায়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট