বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৬৫): মবিলাইজেশন

– বিজন সাহা

শেষ পর্যন্ত রাশিয়া মবিলাইজেশনের কথা ঘোষণা করেছে আর এই নিয়ে দেশে বিদেশে শুরু হয়েছে নানা রকম জল্পনাকল্পনা। বন্ধুরা প্রশ্ন করছে। বাইরের পত্র পত্রিকায় খবর বেরুচ্ছে কিভাবে লাখ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করছে। আর সেটা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের স্পেকুলেশনের অন্ত নেই। কেউ ভেবে দেখছে না যে মানুষ শুধু মবিলাইজেশনের কারণেই মানুষ বাইরে যায় না, যায় অন্য কাজেও। তাই যেসব বাংলাদেশীরা বিদেশে বসে এই যাওয়ার মধ্যে শুধু পুতিন বা রুশ সরকারের বিরোধিতা দেখছেন তাদের কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন না করে পারছি না। এই যে আপনারা বা বলা যায় আমরা যারা দেশ ছেড়ে বাইরে আছি তারা কি দিশের সরকারের বিরোধিতা করি বলেই আছি? নিজেকে এই প্রশ্ন করুন, তাঁর উত্তর খুঁজুন, দেখবেন অংকটা একটু ভিন্ন হবে।

২১ সেপ্টেম্বর মবিলাইজেশন ঘোষণার পরে সরকারি হিসেব মতে প্রায় আড়াই লাখ লোক দেশত্যাগ করে। যেহেতু প্রায় সব দেশেই এদেশ থেকে বিমান চলাচল বন্ধ তাই টিকেটের দাম হয় গগনচুম্বী। শুনেছি লোকজন এমনকি প্রায় দশগুন বেশি দাম দিয়ে টিকেট কিনেছে। আর এটা ফলাও করে প্রচার করেছে পশ্চিমা মাধ্যম। সেখান থেকেই এ খবর আমাদের দেশে পৌঁছেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাশিয়া বা যে কোন দেশ থেকেই প্রতি দিনই প্রচুর পরিমাণ মানুষ বিদেশে যায়। কেউ যায় কাজে, কেউ ঘুরতে। তাই তখন এসব মানুষের কত জন মবিলাইজেশনের কারণে দেশত্যাগ করছে আর কতজন রেগুলার ভিত্তিতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিল না। কয়েকদিন আগে শুনলাম তখন যারা গেছে তাদের মধ্যে দুই লাখের বেশি ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে আর মবিলাইজেশন এড়াতে গেছে ৪০ হাজারের মত। এ ছাড়াও সব সময়ই যেটা হয়, বিভিন্ন ধরণের টাউট বাটপাড়রা সরব হয়েছে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে মবিলাইজেশন থেকে মুক্ত করে আনার লোভ দেখিয়ে। তাই বলা চলে এখন মবিলাইজেশনের খবর হট কেকের মত বিক্রি হচ্ছে রাশিয়ায় ও বাইরে।

অন্য বিষয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের কথা কিছু বলি। এতদিন দেশ বা অন্য দেশ থেকে বন্ধুরা ফোন করে যখন যুদ্ধের কথা জানতে চাইত তখন বলতাম আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। আদতেই তাই। অফিসে যাচ্ছি, ক্লাস নিচ্ছি, সাঁতার কাটছি। এক কথায় ফেব্রুয়ারির পরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। স্থানীয় বন্ধুদের দেখিনি এ নিয়ে তেমন একটা কথা বলতে। তাছাড়া প্রথম দিকে ডলারের আর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। ডলার শুধু আগের জায়গায়ই ফিরে আসে না, অনেকটাই সস্তা হয়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বিভিন্ন দেশে যে রকম বেড়েছে বলে খবরে আর বন্ধুদের সাথে কথা বলে শুনি, এখানে ততটা বাড়েনি। তাছাড়া যুদ্ধ হচ্ছে দনবাসে। আমাদের এখান থেকে অনেক দূরে। সৈন্যরা যুদ্ধ করছে। হ্যাঁ, টিভিতে যুদ্ধ এখন প্রধান খবর। যদি আমাদের দেশের মানুষ পাড়ার তো বটেই গ্রামের কোন বাড়ির মানুষ কি দিয়ে ভাত খেলো এ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করে এ দেশের মানুষ এমনকি পাশের বাড়িতে কি হল সেটা নিয়েও কখনও মাথা ঘামায় না। তাই যুদ্ধ নিয়ে ভাবলেও সেটা নিয়ে আলোচনা করার তেমন প্রয়োজন বোধ করে না। তবে এটাও ঠিক কেউ জিজ্ঞেস করলে নিজের মতামত ঠিকই বলে।

তবে মবিলাইজেশন ঘোষণার পরে চিত্রটা বদলে যায়। যেহেতু আমাদের নিজেদের দুই ছেলে আর মেয়ের বন্ধু আছে যাদের পটেনশিয়ালি যুদ্ধে ডাকতে পারে তাই এখন কিছুটা হলেও যুদ্ধ আমাদের ঘরে ঢুকে গেছে। একটু হলেও টেনশন আছে যদিও এদের সবাই বর্তমান ক্রাইটেরিয়া অনুয়ায়ী যুদ্ধে যাবার কথা নয়। তবে মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধ হল মানব সমাজের সবচেয়ে ডাইন্যামিক ঘটনা যেখানে প্রতি মুহূর্তে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে আর এ কারণে আমাদের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই বাবা মা হিসেবে এটা যে আমাদের জন্য বাড়তি টেনশন তৈরি করবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমরা মানে আমাদের ফ্যামিলিতে আমার স্ত্রী ও আমি এটুকু বুঝি যে দেশ যখন বিপদে তখন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব দেশ রক্ষা করা। আমার মনে হয় শুধু আমরা নই প্রতিটি পরিবার যাদের সন্তান বা পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে যাদের যুদ্ধে যেতে হতে পারে তারা সবাই কমবেশি চিন্তিত। এই তো মস্কো থেকে ঘুরে এলাম। সাধারণত রবিবার যাই, সোমবার ক্লাস নিয়ে ফিরি। এই সপ্তাহে বুধবার আবার যেতে হবে। তাই ভাবছিলাম দুটো দিন থেকে আসব কিনা। আমার স্ত্রীও বলল থেকে যেন সেভার সাথে কথা বলি, ওকে বুঝিয়ে বলি কেন এই যুদ্ধ। কারণ আজকাল তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন উৎস থেকে খবর পায়, ফলে অনেক সময় সঠিক ভাবে ইন্টারপ্রিট করতে পারে না সব ঘটনার।

মনিকা দেখা করল মেট্রোর ওখানে। দোকানে যাবে। জিজ্ঞেস করল
– কয় দিন থাকবে?
– দেখি, সেভার সাথে কথা বলার দরকার। যদি ও রাজী হয় তাহলে হয়তো বুধবার যাব।
– মিশার বন্ধু যুদ্ধে মারা গেছে। (মিশা মনিকার বন্ধু)
– যুদ্ধে তো মানুষ মারা যাবেই। আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের বেঁচে থাকার জন্য হলেও কাউকে না কাউকে মরতে হবে।
– তাই বলে কি সেভাকেও যুদ্ধে যেতে হবে, মরতে হবে?

হ্যাঁ, ভাইয়ের জন্য বোনের প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। কোন আদর্শের কথা এখানে কাজ করে না। এরকম প্রচুর মা, প্রচুর বোন আছে যারা তাদের ভাই, সন্তান, স্বামী, বন্ধুকে আগলে রাখতে চাইবে।

অনেকেই এটাকে পুতিনের যুদ্ধ বলে চালাতে চাইছে। আর সেটা পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই চালু হয়েছে। সেখানে প্রায় প্রত্যেক নেতাই তাদের সমস্ত ব্যর্থতার জন্য পুতিনকে দায়ী করেন, শুধু তাই নয় ইউক্রেনের যুদ্ধকে পুতিনের যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন। আগে তেমন বুঝতাম না, এখন বুঝি – হ্যাঁ মানুষ যাতে নিজেকে এই যুদ্ধের অংশ মনে না করে, নিজেদের এই যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখে এটা তার একটা কৌশল, একটা সাইকোলজিক্যাল অস্ত্র। সমাজেও সে রকম লোকের অভাব নেই যারা এই যুদ্ধকে পুতিনের যুদ্ধ বলে নিজেদের যুদ্ধ থেকে দূরে রাখতে চায়। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে এই যুদ্ধে পরাজিত হলে পুতিনের সমর্থক আর পুতিন বিরোধী কেউই রেহাই পাবে না। একাত্তরের উপর অনেক গল্প লেখা হয়েছে। এরকম ঘটনা কোথায় যেন পড়েছি যে যখন রাজাকার বা শান্তি বাহিনীর লোকজন হানাদারদের নারী সরবরাহ করতে পারত না তখন তারা বাধ্য হত নিজেদের মা বোনদের পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে। কারণ পাকবাহিনীর দোসররা পাকবাহিনীর কাছে সবার আগে ছিল বাঙালি। হয়তো ওরা এসব মানুষকে ঘৃণাও করত, শুধু সেই মুহূর্তে এদের সাহায্য নিত নিজেদের কাজ হাসিল করার জন্য। বিশ্বাসঘাতকদের কেউই পছন্দ করে না কারণ যারা নিজেদের লোকদের সাথে  বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তারা ভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্য যেকোনো মানুষের সাথেই সেটা করবে। এদের কোন আদর্শ নেই, আছে শুধুই স্বার্থ। তাই যারা যুদ্ধ থেকে পালাচ্ছে অনেকেই তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করছে। এবং এরা সবাই যে বর্তমান সরকারের সমর্থক তা কিন্তু নয়। তবে এটাও ঠিক সবাইকে যে যুদ্ধ করতেই হবে বা সবাই যে যুদ্ধ করবে তাও কিন্তু নয়। আর যুদ্ধে না গেলেই যে সে দেশদ্রোহী তাও নয়। একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে আর অনেকেই শুধুই পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাই বলে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী বা দেশদ্রোহী বলা যাবে না।

যাহোক ফিরে আসি মবিলাইজেশনের কথায়। স্বনামধন্য সিনেমা সমালোচক ইরিনা পাভলভা একটা ইন্টারভিউতে খুব সুন্দর কিছু কথা বলেছেন। তিনি বললেন “ইসরাইলে কেউ মবিলাইজেশন এড়াতে পারে না, এড়ায় না, কারণ সেটা করলে সে সমাজে অচ্ছ্যুত হবে।” তিনি আরও বললেন, “কোন মা বা কোন স্ত্রী নিশ্চয়ই চাইবে যেকোনো মূল্যে তার সন্তান বা স্বামীকে যুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে কিন্তু আমরা শুধু এভাবে ভাবলেই তো হবে না। গত দু বছরে করোনায় রাশিয়ায় ৬ থেকে ৮ লাখ মানুষ মারা গেছে আর সে মৃত্যু মোটেই গৌরবের মৃত্যু ছিল না। এখন মাত্র ৩ লাখ লোককে ডাকা হচ্ছে জন্মভূমির সেবায়, সেখানে তাহলে বিরোধিতা কেন? দেশ কি আমাদের কিছুই দেয় না? এই যে অসুস্থ হলে আমরা হাসপাতালে যাই বা ইমারজেন্সি কল করি, আমাদের উপর আক্রমণ হলে পুলিশের শরণাপন্ন হই, বাচ্চাকে স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াই – সে সবই তো হয় রাষ্ট্রীয় খরচে। হ্যাঁ সেটা আমাদের ট্যাক্সের পয়সা। রাষ্ট্র যেমন আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে আমাদেরও তেমনি দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রের বিপদে তার পাশে দাঁড়ানোর।” রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কোন সরকার বা সরকার প্রধানকে রক্ষা করি না, আমরা রক্ষা করি আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস – জাতি হিসেবে, মানুষ হিসেবে যা কিছু আমাদের জন্য অতি মূল্যবান সেসব। তিনি বললেন, “যে মা, যে বোন আমাদের পুরুষদের বড় করেছে, সুখে দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে সেই পুরুষ যদি আজ এই মা বোনদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধে না যায় তাহলে সেই পুরুষ দিয়ে আমরা কি করব?” কত লোক দেশত্যাগ করেছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “কতজন মানুষ প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যেতে পারবে। খুব বেশি নয়।” তাহলে কি এটাই দাঁড়ায় না যারা অর্থাভাবে দেশ থেকে যেতে পারছে না, মানে যারা সমাজের সেই অর্থে পিছিয়ে পড়া মানুষ তারাই বারবার শত্রুর হাত থেকে দেশকে, দেশের অপেক্ষাকৃত প্রিভিলাইজড শ্রেণিকে রক্ষা করছে। এখানে আবার একাত্তরের কথা উল্লেখ করতে হয়। দেশটা কিন্তু মূলত স্বাধীন হয়েছিল তথাকথিত চাষাভুষাদের রক্তের বিনিময়ে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, “যে রুশ কৃষক ছিল ভুমিদাস, সব রকম অধিকারহীন, তারাই কিন্তু নেপলিয়েনের বিরুদ্ধে যা হাতের কাছে ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধ করেছে। এই নেপোলিয়ন কিন্তু তাদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রুশ কৃষকরা স্বাধীনতার চেয়ে নিজেদের শাসন, তা সে যত খারাপই হোক না কেন – সেটাকেই সেদিন বেঁছে নিয়েছে।   অক্টোবর  বিপ্লব, তিরিশের দশকে স্তালিনের অত্যচার এসবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যে মানুষ তাদের নৈতিক অধিকার ছিল ১৯৪১ সালে স্তালিনের হয়ে যুদ্ধ না করার, কিন্তু রুশ জাতি একেবারেই ভিন্ন, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে তাদের বোঝা যায় না। এত অত্যাচার, এত দুর্দশা সহ্য করার পরেও তারা দেশের জন্য, পিতৃভূমির জন্য লড়াই করেছে। গত তিরিশ বছর যাবত এ দেশে পশ্চিমা ধাঁচে মানুষ গড়ার চেষ্টা করা হয়েছে যখন মানুষ নিজের সুখ দুঃখ নিয়ে ব্যস্ত, যখন সে মনে করে দেশ শুধু তাকে দিয়েই যাবে, দেশের প্রতি তার কোনই দায়িত্ব নেই। এত কিছুর পরেও যখন দেখি এখানে এখনও সেই সব মানুষ আছে যারা সব ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করতে যাচ্ছে তখন বুঝি এখনও সব কিছু হারিয়ে যায়নি। তাদের কাছে নিজের সুখ শান্তির চেয়ে মাতৃভুমি অনেক বড়। আর এটাই আমার মনে আশা জাগায়।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইরিনা পাভলভা রুশ সরকারের একজন কঠোর সমালোচক হিসেবেই বেশি পরিচিত।

মবিলাইজেশন জনমনে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একটা কারণ সবাই যুদ্ধে জয় চাইলেও অনেকেই চায় সেটা অন্যেরা করুক। এ ধরণের মানুষ সব দেশেই আছে। তবে যে কারণে এটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তা হল বিভিন্ন ধরণের অরাজকতা। এখানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্বলতার কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল সেই সেক্টর যথেষ্ট কৃতিত্বের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন স্যাঙ্কশনের মোকাবেলা করছে। চেচনিয়া যুদ্ধের সময় এদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দুর্বলতা ধরা পড়ে। এর পরে শুরু হয় বিভিন্ন ধরণের এক্সপেরিমেন্ট। পূর্ববর্তী প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরদুকভের আমলে আর্মি ঢেলে সাজান হয়। জর্জিয়ার যুদ্ধের সময় সেই দুর্বলতা ভালো ভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধে বোঝা যায় এর পরে খুব অল্প সময়ে আর্মি নিজেকে ঢেলে সাজাতে পেরেছে আর সেরদুকভের আমলের দুর্বলতা কাটিয়ে সত্যিকার ডাইন্যামিক ফোর্স গঠিত হয়েছে। ফলে এদের কাছে মানুষের আশা ছিল অনেক বেশি। তবে রাশিয়া তার সৈন্যের কমবেশি এক পঞ্চমাংশ এই যুদ্ধে ব্যবহার করে। কিন্তু যখন মবিলাইজেশন শুরু হয় তখন আর্মির দুর্বলতা ধরা পড়তে থাকে। দেখা যায় আর্মির ভেতর ব্যুরোক্র্যাসি কোন অংশেই কম নয়। ফলে যাদের যুদ্ধের ডাকার কথা ছিল না তাদের অনেককেই ডাকা হয়েছে আবার অনেকেই যারা স্বেচ্ছায় এসেছে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভইনকমাত মানে সেই সব অরগানাইজেশন যারা সৈন্য রিক্রুট করে তারা ব্যাপারটাকে অনেকটা ফর্মাল ভাবে নিয়েছে। সেটা একদিকে যেমন বিভিন্ন রকম গুজবের জন্ম দিয়েছে, অন্য দিকে জনমনে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। অনেককেই ট্রেনিং সেন্টার থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে আমলাদের ভুলের কারণে। একজন ডেপুটি মিনিস্টারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। আসলে যুদ্ধের শুরু থেকেই অনেকে চাইছিল মবিলাইজেশন হোক আর সেটা শুধু আর্মিতে নয়, সর্বক্ষেত্রে। তাই যুদ্ধের সাত মাস পরে যখন সেটা শুরু হল আর দেখা গেল এর সাথে জড়িত আর্মির আমলারা প্রস্তুত নয় সেটাকে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করতে তখন এ ধরণের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। অন্য দিকে এটাও ঠিক যে এ নিয়ে এখানে সংবাদ মাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে আর সেই সমালোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

এ থেকে বোঝা যায় যুদ্ধ চললেও মানুষের মুখ বন্ধ নেই। যখন লোকজন বাইরে যাওয়ার জন্য ভিড় করেছে এরা তাতে বাধা দেয়নি। তবে ইতিমধ্যে এসব ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সরকারকে আহ্বান জানানো হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। যেকোনো আর্মির সাফল্যের মূল চাবিকাঠি লৌহ কঠিন শৃঙ্খলা। হুকুম পালন করা, এমনকি যদি সেটা ভুলও হয়। মার্শাল ঝুকভকে অনেকেই সমালোচনা করে এই বলে যে মাইন পোতা মাঠের মধ্য দিয়ে তিনি সেনাদের যেতে বলেন, ফলে অনেকেই মারা যায়। তাঁর উত্তর ছিল, “আমরা যদি মাইন সরাতে শুরু করতাম, জার্মান বাহিনী তাতে সতর্ক হত আর এর ফলে আরও বেশি মানুষ মারা যেত।” আসলে যুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই প্রচণ্ড গতিশীল ঘটনা যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত জরুরি আর সেজন্যে অনেক সময় অনেক সৈন্যদের বাঁচাতে কিছু সৈন্য স্যাক্রিফাইস করতে হয়। এর কোন বিকল্প নেই। তাই মবিলাইজেশনের প্রথমেই যেটা শেখানো হয়, সেটা আদেশ পালন করা। যেসব লোক অনেক দিন সামরিক বাহিনীতে নেই তারা আদেশ পালন করতে ভুলে গেছে, তারা সব কিছুতেই ঠিক না ভুল সেই প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত। কিন্তু যুদ্ধে সেই সময় নেই। আদেশ পালন না করা মানে নির্ঘাত মৃত্যু। তাই প্রথম দিকে যখন কাউকে অস্ত্র দেয়া হয়নি, অনেকেই বাড়িতে ফোন করে বলছে অস্ত্র নেই, এটা নেই, সেটা নেই। কিন্তু তারা ভুলে গেছে তারা ওখানে আর বয়স্ক মানুষ নয়, তারা একেবারে নতুন আসা শিক্ষানবিস, তাদের নতুন করে সব কিছু শিখতে হবে, ফলে সব কিছু আসবে যাকে বলে স্টেপ বাই স্টেপ। কে যেন বলেছিল, কুতুজভের আমলে ফেসবুক থাকলে তিনি যুদ্ধে জিততে পারতেন না, কারণ মস্কো ছেড়ে তিনি কেন সৈন্যদের নিয়ে চলে গেলেন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই জীবন শেষ হয়ে যেত। এখন হয়তো স্মার্টফোন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে মবিলাইজেশন চলছে। তবে অনেকের ধারণা তিন লাখ সৈন্য খুবই কম, সরকারের উচিৎ সংখ্যা কম করে হলেও দ্বিগুণ করা। আর শুধু রণক্ষেত্র নয়, সমস্ত দেশটা মবিলাইজেশন করা। তবে সেটাও সহজ নয়, কারণ বাজার তাতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো