বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫৮):  শোকের শক্তি

– বিজন সাহা

১৫ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় শোক দিবস পালন করল। ১৯৭৫ সালে এই দিনে একটি স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছিল – মৃত্যু হয়েছিল সোনার বাংলার, মৃত্যু হয়েছিল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালীদের জন্য একটি সোনার দেশ গড়ে তোলার স্বপ্নের। ৭৫ এ যদি স্বপ্নের মৃত্যু হয়ে থাকে তবে আজকে মৃত্যু হচ্ছে আমাদের স্বত্বার – ভোট আর ক্ষমতার লোভে আমরা একটার পর একটা স্বাধীনতার স্তম্ভ উপরে ফেলছি – লাল-সবুজের বাংলাদেশ কখন যে চাঁদ-তারায় ভরে গেছে সেটা আমরা টেরই পাইনি। বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য অনেক কিছুই করেছিলেন – তবে সব থেকে বড় যে কাজটি তিনি করেছিলেন – তা হলো বাঙালি জাতিকে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এখনও বঙ্গবন্ধুর দেশ আছে, দল আছে – কিন্তু স্বপ্ন দেখানোর লোক নেই। স্বপ্ন দেখে রোমান্টিক মানুষ, যে রিস্ক নিতে ভয় পায় না, যে হাসতে হাসতে যেমন বাঁচতে পারে, মরতেও পারে তেমনি হাসতে হাসতে। আপোষ করে স্বপ্ন দেখা যায় না – আপোষ করে স্বপ্ন দেখানোও যায় না। ১৯৭১ এ আপোষ করলে বঙ্গবন্ধু আজ হয়ত বেঁচে থাকতেন – কিন্তু তাহলে বাংলাদেশ হত না। তেমনি স্বাধীনতা ও একাত্তরের চেতনার বিরোধীদের সাথে আপোষ করলে হয়তো আরও দু এক টার্ম ক্ষমতায় থাকা যায় – কিন্তু তাতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া যায় না।

স্পষ্ট মনে পড়ছে ১৯৭৫ সালের এই দিনটির কথা। বরাবরের মতই ঘুম থেকে উঠে প্রাইভেট পড়তে গেছি মাখন মাস্টারমশাইয়ের ওখানে। অনেক দিন থেকেই তিনি অসুস্থ্য। তবুও যাই যতটা না পড়তে তার চেয়ে বেশি তাঁর মনে সাহস যোগাতে যে তিনি এখনও আমাদের প্রয়োজন। অন্তত বাবা এটাই বলতেন, “তুমি পড়তে না গেলে উনি কষ্ট পাবেন। জানই তো এটাই এখন  তাঁর একমাত্র উপার্জন। ইতিমধ্যে অনেকে পড়া বাদ দেওয়ায় তিনি এমনিতেই মুষড়ে পড়েছেন।”

মাখন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে, বাজার আর প্রাইমারী স্কুলের পরে। এইতো কিছুদিন আগেও আমি এই প্রাইমারী স্কুলেই পড়াশুনা করতাম। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছি। ওখানে অনেক বন্ধুদের দোকান। হাতে সময় থাকলে একটু বসি, গল্প করি। তারপর বাড়ি গিয়ে স্নান খাওয়া দাওয়া করে স্কুলে যাই। বানিয়াজুরী ইউনিয়ন হাই স্কুলে। আজও বাজারে এসে যখন নিখিলকে হেসে কি একটা জিজ্ঞেস করলাম, ও কোন উত্তর দিল না। একটু অবাক হলাম আর খেয়াল করলাম সবাই কেমন যেন গম্ভীর মুখে বসে আছে। এক অজানা আশঙ্কা সবার চোখে মুখে। ওদের মুখেই শুনলাম শেখ মুজিবের হত্যার কথা। মনে হয় বাড়ির কেউ মারা গেলেও মানুষ এতটা ভেঙ্গে পড়ে না।

আমাদের গ্রাম বেশ বড়। প্রায় সমান সমান হিন্দু মুসলমানের বাস এখানে। সবাই মিলেমিশেই থাকত, একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসত।  হিন্দুরা ছিল মূলত ব্যবসায়ী আর মুসলমানরা কৃষিজীবী। এর মধ্যে এল যুদ্ধ। হিন্দুরা পালাল গ্রাম ছেড়ে। কেউ ইন্ডিয়া, কেউ পাশের গ্রামে। আমাদের গ্রাম ঢাকা আরিচা রোডের পাশে, তাই মিলিটারি আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। বস্তুত সেটাই হয়েছিল। ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হল। সবাই ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরল। বাড়ি নয়, শুধুই ভিটা। ঘরদোর, আসবাবপত্র সব লুট হয়ে গেছে। নিয়েছিল মূলত গ্রামের লোকেরাই। ফেরতও দিয়েছে যুদ্ধ শেষে। তবে ইতিমধ্যে যে অবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়েছে মনের গভীরে সেটা তো আর এই সাড়ে তিন বছরে কেউ ভুলে যেতে পারে না। এদের অনেকেই একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ভরসা করে ফিরে এসেছিল গ্রামে আর নতুন করে জীবন শুরু করেছিল। নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছিল ব্যবসা বানিজ্য আর তাঁতের কাজ। সত্যি বলতে কি যুদ্ধের পর গ্রাম যেন নতুন প্রাণ পেয়েছিল, সমবায় সমিতি থেকে শুরু করে কত কিছুই যে গড়ে উঠছিল। সবার মনে এখন  এক প্রশ্ন –  নতুন পরিস্থিতিতে আবার কি সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে? নাকি এবার চিরতরে বিদায় জানাতে হবে প্রিয় জন্মভূমিকে? এ রকম হাজার প্রশ্ন সবার চোখে মুখে। অবিশ্বাসের সাথে সাথে অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে সবার ভাবনাকে।

আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারিনি যে বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যি মারা গেছেন। তাই ছুটে বাড়ি চলে গেলাম আকাশবাণী আর বিবিসি কি বলে সেটা শোনার জন্য। তখন বিবিসির খবর আমাদের কাছে ছিল বেদ বাক্যের মত। পাকিস্তান আমলে, যুদ্ধের সময় আর যুদ্ধের পরেও আমরা বিবিসির খবর শুনতাম খবরের সত্যতা যাচাই করার জন্য।

বাড়িতে এসে দেখি সবাই আকাশবাণী আর বিবিসি ধরতে ব্যস্ত। ওরাই শেষ ভরসা সত্য জানার জন্য। বাংলাদেশ বেতার ইতিমধ্যে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে, জয় বাংলা হয়েছে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। যদিও শেখ মুজিবের হত্যার খবরে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত, হতবাক তবে ঢাকার এলিট শ্রেণীর একটা বিরাট অংশ মনে হয় এতে খুশিই হয়েছে। রেডিও বাংলাদেশ থেকে খুশির খবর প্রচার করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় নাকি মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া দাদারা ও তাদের বন্ধুরা নতুন নতুন খবর নিয়ে আসছে।  জেনারেল ওসমানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা একে একে শপথ গ্রহণ করছে। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট সেজেছে। শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার প্রায় সবাই ক্ষমতা দখলকারী সেনাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নতুন মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছে। আজ ২০২২ সালেও এসব ঘটনা যেন ছায়াছবির মত ভেসে উঠছে মনের কোণে। এসব ভেবে এখন মনে হয় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির এক বিরাট অংশের জন্য শোকের হলেও অনেকের জন্য সুখেরও হয়েছিল।

২০০৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও স্বপ্ন দেখার বা দেখানোর মানুষের আগমন ঘটছে না। আজকাল প্রায়ই বলতে শুনি “বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোন আপোষ করার সুযোগ নেই।” কথাটা অনেকেই মন্ত্রের মত জপছেন আজকাল। আর সেখানেই বিপদ। কেননা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ না করেও জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানের স্রোতের টানে অনেক স্বাধীনতা বিরোধী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিরোধী লোকেরা ধরছেন নৌকার হাল। আমাদের বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে পারেন শুধু তাঁর আদর্শের মধ্য দিয়ে, তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। আর সেটা করা সম্ভব শুধু মাত্র তাঁর আদর্শের সাথে কম্প্রমাইজ না করে। মানুষকে ভক্তি করা খুব সোজা, আমাদের দেশে ভক্তি আজকাল চামচাগিরির পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেটা অধিকাংশ মানুষ করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে। কিন্তু কারো আদর্শের সৈনিক হতে হলে, কারো সত্যিকারের অনুসারী হতে হলে তাঁর আদর্শকে ধারণ করতে হয়, ক্ষমতাই বলি আর রাজনৈতিক কৌশলই বলি কোন অজুহাতেই যা কিনা পণ্যে পরিণত করা যায় না। ১৫ আগস্টের প্রতিজ্ঞা হোক বঙ্গবন্ধুর চার স্তম্ভের প্রতি বিশ্বস্থ থাকার।

ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। আবার খুনীদের অনেকেই যেসব দেশ গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, মানবতা ইত্যাদির ওয়াজ করে বেড়ায় আর এসব বিষয়ে সময়ে অসময়ে ফতোয়া জারি করে সেখানে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছে। অপরাধীদের বিচার বা শাস্তি হলেও আমি নিশ্চিত নই কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল, কারা এর নেপথ্য নায়ক ছিল, বিদেশীদের কতটুকু যোগসাজশ ছিল এর পেছনে আর এর পেছনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের কী ভূমিকা ছিল এসব বিষয়ে নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হয়েছিল কি না? আমাদের মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর মত মানুষ শুধু ব্যক্তি মানুষ নন, তিনি দেশের সম্পদ। তাই বিভিন্ন দেশ থেকে সতর্ক করার পরেও বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস কতটা যুক্তিযুক্ত সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আগেই বলেছি সেদিন শুধু ব্যক্তি মুজিব বা তাঁর পরিবারের মৃত্যু হয়নি, মৃত্যু হয়েছে একটা জাতির, একটা স্বপ্নের। হ্যাঁ, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি পরিণত হয়েছে বাংলাদেশী জাতিতে। এর মধ্যে দিয়ে শুধু দেশ নামক গাড়িটার চালকই বদল হয়নি , বদলে গেছে চলার দিক, বদলে গেছে গন্তব্য। এরপরে বিভিন্ন সময়ে চালক বদল হলেও, এমনকি শেখ মুজিবের নিজের দল দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকলেও চলার দিক আর বদল হয়নি, বদল হয়নি স্বাধীনতার শত্রুদের ঠিক করে দেওয়া গন্তব্য। আর এটা আমাদের মূল গন্তব্য থেকে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লক্ষ্য থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সঠিক গন্তব্যে পৌঁছুতে হলে আমাদের তাই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পূর্ববর্তী বাংলাদেশের ইহিতাস পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।

আজ আমরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার অবনতি দেখে প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি বর্তমান আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নেই। আর সব দোষ দেই আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে, তার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশকে, তার ভোটের রাজনীতিকে। এটা ঠিক ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণ পুরুষ। পঁচাত্তরের ঘটনা প্রমাণ করে এই আওয়ামী লীগই জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে সাবোটাজ করেছে আর পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তাঁকে হত্যাও করেছে এই আওয়ামী লীগ – অন্তত আওয়ামী লীগের একটা অংশ। তাই সমস্যা বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে নয়, সমস্যা আওয়ামী লীগে, আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্রে। এ ব্যাপারে অবশ্য বঙ্গবন্ধু নিজেই বলে গেছেন তাঁর এক যুগান্তকারী বক্তৃতায়। যতক্ষণ না আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃবৃন্দ আর দেশের মানুষ সেটা বুঝবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের হাহুতাশ করেই দিন কাটাতে হবেঃ

কথা ছিল যুদ্ধ শেষে শান্তি আসবে ফিরে

কথা ছিল সোনার ধান উঠবে কৃষকের ঘরে

কথা ছিল শ্রমিকের শ্রমের মূল্য হবে হক

কথা ছিল সরকার হবে জনগণের সেবক

কথা ছিল মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা

সবই হবে ঈশ্বরের নিরাপদ আবাস

কথা ছিল হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান

সবাই বাঙ্গালী হয়ে শান্তিতে করবে বাস

বন্দুকের গুলিতে একদিন কথা হল লাশ

স্বপ্নেরা সব পালিয়ে গেল ছেড়ে দীর্ঘ শ্বাস

হারিয়ে গেল শ্রমিক কৃষক রইল দলদাস

চারিদিকে শুধু প্রতারণা আর মিথ্যা আশ্বাস

তোমার রক্তে শপথ নিয়ে রক্তহোলিতে মাতে

তুমি আজ শুধুই ঢাল অত্যাচারীর হাতে

আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ফিরিয়ে এনে তিনি যে জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেই এই শোককে শক্তিতে পরিণত করা যাবে আর এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জানানো যাবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো