শিল্প সাহিত্য

বিদ্বেষ

— শাহীন আখতার হামিদ

প্রাকৃতিক পরিবেশে গান ও অভিনয় দুটোই আনন্দের। শুধু শব্দটা আয়ত্বে রাখতে হয়। মিলন বলেছে এ নিয়ে তুই ভাবিস না পরে আমরা এডিট করে নিব। তুই শুধু আমাদের বল কোন জায়গায় রেকর্ড করব। শুভা বলল রাঙ্গামাটি লেকে একটা জায়গা আমার খুব পছন্দের, চল সেখানে যাই।

গেস্ট হাউজ থেকে নেমে সুন্দর সাজান নৌকায় উঠল শুভা ও তার বন্ধুরা। শুভা গুলইয়ে বসে তাকিয়ে আছে গেস্ট হাউজের দিকে। চারিদিকে কোন কোলাহল নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য্য উঠছে। আজ সকালে সূর্য্য উঠার কালে ওরাপ্রথম গানটি রেকর্ড করবে। হঠাৎ শুভার মনে হল গেস্ট হাউজের বারান্দায় থামের আড়ালে সে কে! তারতো এখানেআসার কথা নয়। সেতো আমাদের গানের দলের কেউ নয়।ট সুন্দর সুরেলা কন্ঠ শুভা খুব কমশুনেছে। ওরা কয়েক বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছেলেটির গানের একটি এলবাম করবে, তাইতো তাকে নিয়ে আসা রাঙ্গামাটিতে। শুভারই সিদ্ধান্ত ওরা এই প্রকৃতি পুত্রের সবগুলো গান প্রাকৃতিক পরিবেশেই ধারণ করবে। এ বালকটি আপন খেয়ালে গান গায়।

দ্বিতীয় গানটি তারা ধারণ করল ফয়’স লেকে। ওরা যখন লেকের পাড়ে হাঁটছিল একটি পছন্দসই জায়গার জন্য, শুভার মনে হল সে গাছের আড়ালে চলে গেল। এটা কি শুভার মনের ভুল নাকি সে তাদের পিছু নিয়েছে, কিন্তু কেন! আজ রাতে সে পুষ্পিতাকে ফোন করবে।

পুষ্পিতার মাথায় আগুন লেগেছে, মগজটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। মিলনের বউকে সে ভয় পায়না। মিলন তার বরের বন্ধু। পুষ্পিতার জন্য মিলন পাগল। বউটা সারাক্ষণ বই ও বাপের বাড়ি নিয়েই ব্যস্ত, সে তার বাবা মা ভাইবোনের ভিতর নিমজ্জিত হয়ে থাকে। মিলন প্রায়ই এটা নালিশ করে পুষ্পিতার কাছে। পুষ্পিতা চারিদিক সামলে চলতে জানে। না পুষ্পিতা সংসার ভাংবে না, তার যেমন দরকার মিলনের টাকা তেমনি দরকার মিজানের নাম।

আজ কদিন ধরে মিলনের দেখা নেই, এখন তেমন আসেনা, বুঝা গেল সে অন্য কিছু নিয়ে ব্যাস্ত। কি সেটা এখনি তারবের করতে হবে। সে চায় না মিলন তার হাত ছাড়া হয়েযাক। পুষ্পিতার বর মিজান কোন কিছুতেই না করেনা। সেনিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তার ছবি আঁকার জগতটাই আলাদা। বউকে সে খুব ভালবাসে। ইদানিং পুষ্পিতা ও ছবি আঁকারদিকে ঝুকেছে। পুষ্পিতা জানে মিজান সুজোগ পেলেই এদিকসেদিক হাত বাড়ায়। আগে তার খুব রাগ হত,  মিজানের সাথে ঝগড়া করত। মিলনের সাথে পুষ্পিতার সম্পর্কহওয়ার পর থেকে এ সুযোগ টুক সে মিজানকে দেয়। মিলনতাকে এতো ভাল রাখে যে মিজানের কোন বিষয়ে সে আরভাবতে চায় না। মিজান তাকে ফেলে কোথাও যাবেনা তা পুষ্পিতা জানে।

মিজান কোন কাজে বা সেমিনারে বাইরে গেলে মিলনই তার ভরসা। গতমাসে মিলন তাকে মিউজিক সিস্টেম কিনে দিয়েছ। এর আগে মিলন ব্যবসার জন্য থাইল্যান্ড গিয়ে খুবসুন্দর একটি মুক্তার মালা ও কানের দুল নিয়ে এসেছে। মিলনের বউ মালাটি দেখে বলেছিল, ইস পুষ্পিতা আপা এরকম একটি মালার আমার অনেক শখ। পুষ্পিতা তখন মনে মনে জয়ের হাসি হেসেছে

ঢাকাতে পুষ্পিতার ছবির প্রদর্শনীর পুরো খরচই করেছে মিলন। মিজান বলেছিল তুই এতো কিছু কেন করিস দোস্ত, পুষ্পিতা খুশি হবে না আমি জানি। পুষ্পিতা মিজানের সামনে রাগ দেখিয়ে বলেছিল মিলন ভাই এটা কিন্তু একদম ঠিক না আপনি যা করছেন আমাদের জন্য। পুষ্পিতা জানেএ ছবির অর্ধেক কিনে নিবে মিলন। তার টাকা ও নাম দুটোইহবে। ঢাকার ফ্লাট পুষ্পিতার সাজান হয়ে গেছে, এখন বাকি চট্টগ্রামের ফ্লাট। এটা ঠিক হয়ে গেলেই সে আর ভাববে না।

মিলন তাকে এতো ভাল রাখে সব সময়। আজ কদিন ধরেতার খবর নেই, তাইতো পিছু নেয়া। মিজান তার চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া গেছে, পুষ্পিতা আগে যেত, এখন আর যায় না কারণ এসময় সে মিলনকে কাছে পায়। মিলনের সাথে ঘনিষ্ট হবার পরে এ প্রথম বারেই মিলন তাকে অবজ্ঞা করছে। এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সে শুভাকে দেখে নিবে।

শুভার ফোন পেয়ে পুষ্পিতা বিরক্ত হয়ে বলল ফোন করেছিস কেন? শুভা বলল এই পুষ্পিতা তোর কি হয়েছে? রাগ করে কথা বলছিস কেন? পুষ্পিতা খট করে ফোন রেখে দিল। শুভা আর কোন কথা না বলে তার কাজ নিয়ে বসল। নিজের কাজের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশ মিলিয়েগানগুলো শুভাকেই লিখতে হচ্ছে। কাল ওদের শেষ গান ধারণ করবে ইনানি বিচে, যেতে হবে খুব সকালে, ফিরবে রাতে। মা বলছিল এতো ছুটোছুটি করলে তোর শরীর খারাপ হয়ে যাবে। শুভা বলল মা-ছেলেটার এটা প্রথম এলবাম, এটা বেরুলে ও কত খুশি হবে তা জান। মা বললজানি ওর একটা রোজগারের পথও হবে। মা কখনো শুভাকে ভুল বুঝেনা। মা জানে শুভা কাউকে কষ্ট দিয়ে কোন কাজ করবে না।

খুব সকালে শুভারা মাইক্রোবাস নিয়ে মিলনের বাড়িরসামনে আসল। এখনো মিলনের দেখা নেই। শুভা আর অপেক্ষা না করে উপরে উঠে আসল। এসেই পরে গেল মিলনের বউয়ের সামনে। বউ একটি ধমক দিয়ে বলল কি আপনাদের অভিসার শেষ হল? শুভা বলল এসব তুমি কিবলছ। মিলন কোথায়? বলল আপনি কি আমার সাথে ফাজলামো করছেন, আপনি জানেন না সে কোথায়। শুভা বলল জানি নাত। মিলনের বউ ছায়া বলল আপনারা কালএকটি হোটেলে রাত কাটান নি! মিলন তো আমাকে ফোনকরে বলল রাগ করো না আমি আজ আসতে পারব না। তখন আমি পুষ্পিতা আপাকে ফোন করেছিলাম, তিনিও বলেছে আপনার সাথে সে হোটেলে আছে, আপনাদের নাকি গানের কাজ চলছে।

শুভার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। পুষ্পিতা তার এতো বন্ধু, সেও কাল ধমক দিল, আজ মিলনের বউ এতো বাজে কথা বলল ঘটনা কি। নিচে নামতে নামতে সে মিলনের বউকে বলল আমরা ইনানি বিচের দিকে যাচ্ছি মিলন যদি যেতে চায় ওকে নিজের গাড়িতেই যেতে হবে। শুভার কানে আসল একটি শব্দ অসভ্য মেয়ে মানুষ।

ইনানি বিচ থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। আজ মিলনকে ছাড়াই ওরা গান রেকর্ড করল। ভাবছে গানের রেকর্ডের কাজ শেষ হলেই সে পুষ্পিতা , মিলন ও ছায়াকে নিয়ে একটি সভা করবে। এ রহস্যের কিনার তাকে করতেইহবে।

আজ বাংলা একাডেমিতে গানের অনুষ্ঠানে সবগুলো ধারণকৃত গানই দেখান হল, ছেলেটা শুধু গানের সাথে ঠোঁট মিলালা। সবগুলো ভিডিও এতো ভাল হয়েছে যে শুভার মন খারাপ ভাল হয়ে গেছে। মিলনকে বলল আমাদের দায়িত্ব শেষ এবার সিডি বের করার দায়িত্ব তোর। মিলনকে আজ খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। শুভা বলল মিলন তোর কি হয়েছে, বলল একদিন সময় করে বলব।

আজ মিলন সব তাকে বলল, বলল বউ বলেছে চলে যাবে। শুভা বলল তুই এসবের মধ্যে গেলি কেন। তোর বউতো খুব ভাল। মিলন বলল জানিস তো ওই অত সাধারণ মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছ। পুষ্পিতাএতো অন্যরকম যে আমি তোকে বুঝাতে পারব না। মাঝেমাঝে আমি মিজানের মৃত্যু কামনা করি।

সকালে শুভা কাজে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে, হঠাৎ মিজানেরফোন। মিজান সাধারণত তাকে ফোন করেনা। বলল জানিস তোর জন্য আজ মিলনের ঘর ভাংছে। বললাম সেকি কথা মিজান, বলল তুই একটা খারাপ মেয়ে , আমি সব শুনেছি পুষ্পিতার কাছ থেকে। শুভা ভাবছে, এসব ঘোরপ্যাচে পড়ে আমার মাথা মনে খারাপ হয়ে যাবে। কাজের জায়গাতে সে অনেক ভুল করল, সহকর্মীদের সাথেঝগড়া করল, যা সে কখনই করেনা। ঘরে ফিরে ঘর বন্ধ করে কাঁদল। মা রাতে শুভার দিকে তাকিয়ে বলল কিরে তোর কি শরীর খারাপ, শুভা বলল না মা, একটু বেশি ঘুমিয়েছি।

শুভা আর ওদের কারো সাথেই কোন যোগাযোগ করেনি। গানের কি হল তাও সে জানেন। মিজান বা মিলন কাউকেই সে আর ফোন করে না, পুষ্পিতাকে তো নয়ই। শুভা নিজেকেঅদৃশ্য করে নিয়েছে ওদের সবার কাছ থেকে।

ছয় বছর পরে শুভার অফিসে একদিন আসল মিলনের বউ, এসেই শুভাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। শুভা বলল কি হয়েছে। বলল আপনি আমায় মাফ করে দেন শুভা আপা। শুভা বলল কেন, বুঝতে পারছিনা। মিলনের বউ ছায়া বলল মিলনের ক্যান্সার হয়েছে, গতরাতে সে আমাকে সব বলেছে। শুভা অবাক হয়ে বলল কি বলেছে, বুঝতে পারছিনা। ছায়া বলল, আপা আমরা আপনাকে সমাজের কাছে, বন্ধুদের কাছে বাজে মহিলা বানিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু আপনি তো কিছুই জা্নেন না। পুষ্পিতা আপা আমার সাথে কত ভাল ছিল, সব কিছু বলতো বন্ধুর মত। এমন কোনদিন ছিলনা যেদিন আমি আর পুষ্পিতা আপা আপনার সম্পর্কে কথা না বলতাম। আপনাকে নিয়ে যা নয় তাই বলত পুষ্পিতা আপা। আমিও সায় দিতাম সব কিছুতে। আমি বলতাম, পুষ্পিতা আপা আপনি না হলে আমার সংসার ভেঙ্গে যেত। আপা বলতেন মিলনকে আমি আর নষ্ট হতে দিবনা। কিন্তু শুভা আপা ঘটনা তো অন্যরকম। আপনি তো একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। শুভা বলল মিলনও কি তাই বলত, হ্যা আপা বলত, তবে মিজান ভাই সবচেয়ে বেশি বলত। মিজান ভাই বলত তুই ডাইনির হাতথেকে বেঁচে গেছিস। মিলনও তাতে সায় দিত। শুভা হেসেহেসে বলল, ছায়া মিলন আর কি বলত? বলল আপা আড্ডায় বসলে সবাই আপনাকে একবার মনে করত, বলত কত খারাপ আপনি তার কোন হিসাব নেই। শুভা আর ছায়া দুজনেই জোরে হেসে উঠল।

ছায়া বলল, মিলন তো পুষ্পিতা আপার পরকীয়া। শুভা ছায়ার দিকে তাকিয়ে না হেসে পারল না, বলল ছায়া পরকীয়া কি? ছায়া হেসে উত্তর দিল আপা যাদের বিয়ে করা বর ও বউ থাকে এবং অন্যের বর ও বউয়ের সাথে সংসার সংসার খেলে, এটাকে বলে পরকীয়া। ওর কথায় শুভা শব্দ করে হেসে দিল।

শুভা আর ছায়া একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে পেট ভরে বিরাণী খেয়ে জর্দা দিয়ে পান খেতে খেতে যে যার বাড়ি গেল।