বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫৭): যুদ্ধ তুমি কার

– বিজন সাহা

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধ চলছে তার নিজের নিয়মে। রাশিয়াতে কখনই এ নিয়ে তেমন কথাবার্তা ছিল না টিভি আর ইন্টারনেটের বাইরে। জীবন কী তখন, কী এখন এগিয়ে যাচ্ছে নিজের পথে। প্রথম দিকে ডলারের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে লোকজনের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা ও আশংকা দেখা দিলেও ধীরে ধীরে সেটাও উধাও হয়ে যায় ডলারের মূল্য হ্রাসের সাথে সাথে। আর গ্রীষ্ম আসার সাথে সাথে মানুষ বরাবরের মতই ছুটছে সূর্যের পেছনে, যতদূর সম্ভব বেশি করে শরীরে রোদের পরশ ধরে রাখতে। কিন্তু যুদ্ধ যেহেতু থেমে নেই তাই সে কথাই বলব। কথার ফাঁকে ফাঁকে ফিরে যাব কয়েক মাস আগের ঘটনায়।

বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে জ্বলদর্চি পত্রিকা ও আজকের পত্রিকায় লিখেছিলাম। তবে এ নিয়ে শেষ লেখাটা বেরিয়েছিল ৩০ এপ্রিল। এরপর তিন মাস কেটে গেছে। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ছোটখাটো স্ট্যাটাস দিলেও বিভিন্ন কারণে বিস্তারিত লেখা আর প্রকাশ করা হয়নি। এখানে সে চেষ্টাই করব। অনেক কিছুই পুরানো মনে হবে, তবে নিজের মত করে সেসব ঘটনার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করব। উদ্দেশ্য একটাই – এই যুদ্ধের পেছনের কারণ বোঝার চেষ্টা করা। কেন এই যুদ্ধ আর কার এই যুদ্ধ সেটা জানার চেষ্টা করা। তবে এটা একটা ভার্সন, আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার ব্যাখ্যা, কিন্তু সেটাই যে একমাত্র ব্যাখ্যা তা নয়। যেহেতু এর আগে এ ব্যাপারে গোটা দশেক লেখা বেরিয়েছে, তাই সেই লেখাগুলো পড়লে পরবর্তী ঘটনা বুঝতে সুবিধা হবে।

আমেরিকার বরাবরই উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ায় একটা পাপেট সরকার বসানো যেমনটা সে করেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আর এখান থেকেই নাভালনি প্রোজেক্ট। কিন্তু রুশ জনগণ সেটার ফল গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে একবার হাড়েহাড়ে পেয়েছে, তাই তারা যে দ্বিতীয় বার সেটা মেনে নেবে না যারা দীর্ঘ দিন রাশিয়ায় আছে এবং এদেশের মানুষের মানসিকতার সাথে পরিচিত তারা সে কথা বুঝতে পারে। আর জনসমর্থন থাকলে আর্মি যেকোনো আগ্রাসনের হাত থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করতে সক্ষম। এমনিতেই তো আর পিটার দ্য গ্রেট বলেননি যে রাশিয়ার মাত্র দু’ জন বন্ধু – আর্মি আর নৌবাহিনী। এখন এর সাথে যোগ হয়েছে বিমান বাহিনী, কসমিক ফোর্স ইত্যাদি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিকে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বললেও পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন আমলাদের মাধ্যমে যুদ্ধের মাঠেই সমস্যার সুরাহার কথা বলতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। রাশিয়া সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। যখন রেগুলার রোটেশনের জন্য নতুন সৈন্যরা ইউক্রেন যাচ্ছে বিভিন্ন শহরে লোকজন ফুল হাতে তাদের বিদায় দিচ্ছে, জিজ্ঞেস করছে কিছু দরকার কিনা। ভাবার কারণ নেই যে এসব মানুষকে কেউ ধরে নিয়ে এসেছে। আজকাল আর সেই যুগ নেই। যে যায় সে স্বেচ্ছায়ই যায়। সোভিয়েত আমলে যুদ্ধের উপর সিনেমায় এরকম দৃশ্য চোখে পড়ত যখন লোকজন দল বেঁধে সৈন্যদের বিদায় জানাত। সব দেখে মনে হচ্ছে দেশের জনগণ আর্মির সাথে। আর্মি ও জনতা আজ এক অভিন্ন সত্তা। আজ রুশ সেনা সত্যিকার অর্থেই তার হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে। জনতার চোখে সে আজ জাতীয় বীর। অন্তত জনগণের একটা বিরাট অংশের কাছে।

একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপ্লব রপ্তানি করত, এখন আমেরিকা সেই বিপ্লব রঙ বেরঙের মোড়কে ভরে বিভিন্ন দেশের দোরগোড়ায় রেখে আসে। তাদের হয়তো ধারণা যেহেতু আমেরিকা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টদের দেশ তাই আমেরিকার মডেল বিশ্বজনীন অর্থাৎ আমেরিকা একটা বিশ্বজনীন গবেষণাগার। সেখানে কোন কিছু সুফল বয়ে আনলে অন্য যেকোনো দেশে তা হতে বাধ্য। কিন্তু প্রতিটি দেশের যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, আছে নিজ নিজ ইহিহাস – সেটা তারা ভুলে যায়। আর এটাই বার বার ডেকে আনে বিপর্যয়।  আমেরিকান ড্রীম এক বিশাল জিনিস, কিন্তু মানুষ বুঝে গেছে সবাই আমেরিকান হতে পারে না, পারবে না। এই যে আমেরিকান, রুশ, বাঙালি, ভারতীয় – এসব শুধু জাতিগত নয়, মানুষের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। তাই বাংলাদেশে জন্মেও অনেকেই যেমন বাঙালি হতে পারে না, একই ভাবে অন্য যেকোনো দেশে জন্মে বা যেকোনো দেশে গিয়ে সে সেই দেশের একজন হতে পারে না। আমেরিকা মানে শুধু ডলার, উচ্চ বেতন, নিজেকে রিয়ালাইজ করার সুযোগ নয়, আমেরিকা মানে সে দেশের সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি, মানবতাবাদ ও বর্ণবাদ, শিক্ষা ও কুশিক্ষা, অকল্পনীয় ঐশ্বর্য আবার সীমাহীন দারিদ্র্য। সেটা যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। আমেরিকান ড্রীম বলতে আমরা শুধু সুখের স্বপ্নটাই ভাবি তবে সেটা যে দুঃস্বপ্নও হতে পারে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্নের থলে থেকে শেষ পর্যন্ত কি যে বেরুবে সেটা আগে থেকে বলা কষ্ট যদি না মানুষ নিজের দেশের উপযোগী করে সেটা রোপণ না করে।

ছোটবেলায় সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম। সাধারণত বলটা আমিই কিনতাম, খেলতাম সবাই মিলে। তবে সমস্যা একটাই – আমার খেলতে ইচ্ছে না করলে কেউই খেলতে পারত না। তাই পরে চাঁদা তুলে বল কিনলাম। সেখানে এক ছেলে আমাকে অপছন্দ করত, খেলতে এসে প্রায়ই ঝামেলা করত, কি করা ও যেহেতু চাঁদা দিয়েছে তাই বের করে দেওয়াও যায় না। পরে সবাই মিলে বলটা আমার কাছে বেঁচে দিল। সেই ছেলে বাদ পড়ল। অন্যেরা আবার চাঁদা দিয়ে বলের মালিক হল। তখন থেকেই বুঝেছি খেলাধুলা যৌথ ব্যাপার, সেখানে সবার অধিকার রক্ষা না করতে পারলে খেলা আর খেলা থাকে না। আমেরিকাও হয়তো একদিন বুঝবে সব দেশই এক একটি এন্টিটি। তার নাগরিকদের সে যেমন বিভিন্ন অধিকার দেয়, সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, এই বিশ্বে সেও অন্যান্য দেশের মতই একজন নাগরিক মাত্র। এটা চীন, রাশিয়াসহ যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই এদেরকেও অন্যদের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই রাজনীতি করতে হবে।

রাশিয়ায় একটা প্রশ্ন নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয় – রাশিয়া কি ইউরোপ নাকি এশিয়া? পিটার দ্য গ্রেটের ইউরোপের জানালা খোলার আগে এ দেশ বহুদিন তাতার মঙ্গলদের অধীনে অথবা তাদের সাথে মিলে মিশে ছিল। ফলে এশিয়ান মানসিকতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে পরবর্তীতে এরা ইউরোপের দিকে ঝুঁকে পড়ে। রাশিয়া যেমন ইউরোপ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে তেমনি দিয়েছেও কম নয়। সাহিত্য, মিউজিক, নৃত্য, শিল্পকলা – সংস্কৃতির সব ধারাতেই এরা ইউরোপকে ঋদ্ধ করেছে। সোভিয়েত আমলে টেকনোলোজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের অবদান অপরিসীম। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, বায়োলজি – বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৮৩ সালে যখন এদেশে আসি, জানতাম যাচ্ছি একেবারে ভিন্ন এক দেশে, ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায়। তখন এখানে সব কিছুই অন্য রকম লাগত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে ৩২ বছর আগে, দেশ বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ, বদলে গেছে তাদের অনেক কিছুই। কিন্তু যেটা খেয়াল করেছি –  তা হল এরা আসলেই একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। এদের চালচলন, আচার ব্যবহার, জীবনের ব্যাপারে এদের চিন্তা ভাবনা একেবারেই ভিন্ন। তাই এখানে অনেকেই বলেন – এরা ইউরোপিয়ানও নয়, এশিয়ানও নয়। এরা রাশিয়ান। এরা রুশ। যেখানে গড়ে উঠেছে একেবারে ভিন্ন সভ্যতা, ভিন্ন সংস্কৃতি – একান্তই নিজেদের। এটা শুধু দেশ নয়। কী আকারে, কী জাতিগত ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে এরা মহাদেশ। তাই রাশিয়াকে আইসোলেট করতে গেল পৃথিবীকেও আইসোলেট হতে হবে। রাশিয়া ছাড়া পৃথিবী অসম্পূর্ণ।

পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা ইউক্রেনকে অ্যান্টি-রাশিয়ায় পরিণত করেছে। তবে এক্ষেত্রে রাশিয়ার দোষও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু এই পয়সার ন্যুনতম অংশও জনগণের কল্যাণে যায়নি। এই টাকা কী রুশপন্থী, কী আমেরিকাপন্থী – সব ধরণের রাজনীতিবিদদের পকেটে চলে গেছে। আর এটাকেই পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবহার করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই বলে যে রাশিয়া ইউক্রেনের রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্থ করেছে। অথচ মাত্র ৫ -৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আমেরিকা ইউক্রেনের একটা অংশকে অন্ধ রুশ বিরোধী শক্তিতে পরিণত করেছে। রাশিয়া যদি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে যত্নশীল হত আর সেই ১০০ বিলিয়নের একটা অংশ সরাসরি জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করত, যেমন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রুশ ভাষা কেন্দ্র, এনজিও ইত্যাদির মাধ্যমে, তাহলে ইউক্রেন আজ এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হত না। আশা করি ইউক্রেন ঘটনা থেকে রাশিয়া শিক্ষা নেবে, সফট ডিপ্লোম্যাসিতে আরও বেশি মনোযোগী হবে। রাশিয়া প্রায়ই বলে তারা কারও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু  কোন দেশে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা সেদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয়। আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব যেমন তাদের প্রোজেক্ট, তাদের গণতন্ত্র, তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্য দেশে বিক্রি করতে চায়,  রাশিয়াকেও সেটাই করতে হবে। আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ তখনই হয় যখন সেটা করা হয় জবরদস্তির মাধ্যমে – যেমন কোন দেশে সরকার পরিবর্তন, হত্যা বা যুদ্ধের মাধ্যমে। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ১৯৯১ পরবর্তী রাশিয়া অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে, এই সফট ডিপ্লোম্যাসি গ্রহণ করলে ক্ষতি কিছু হবে না। সমস্যা অন্ধভাবে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বকে নকল করলে, আর মাথা খাটিয়ে তাদের সফল প্রোজেক্টগুলো নিজ নিজ দেশের উপযোগী করে প্রয়োগ করলে – সেটা হবে সমস্যার সমাধান।

আমার মনে হয় এটা ঘটছে সোভিয়েত অভিজ্ঞতা থেকে। সোভিয়েত আমলে এরা বিভিন্ন দেশকে, বিভিন্ন দেশের বাম আন্দোলনকে সাহায্য করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে এটার ভূমিকাও কম ছিল না। কারণ এর ফলে একদিকে যেমন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে শত্রুতা বেড়েছে একই সঙ্গে সেটা চাপ ফেলেছে অর্থনীতির উপরে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটাও জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। মনে হয় এ কারণে এক ধরণের অপরাধ বোধ সৃষ্টি হয়েছিল নতুন নেতৃবৃন্দের মনে। ফলে তারা সব সময়ই চেষ্টা করেছে অন্য দেশের ব্যাপারে যতদূর সম্ভব নিউট্রাল থাকতে। এছাড়া তখন তাদের অর্থনীতিও সহায়ক ছিল না। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে প্রায় সমস্ত ব্যবস্থায়ই ধ্বসে পড়ে। এমন কি আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরেও এক ধরণের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল, এখানে কিছুই ছিল না। ছিল পুরানো ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণা, অবিশ্বাস আর ছিল পশ্চিমা বন্ধুদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তারা ধারণা করেছিল আমেরিকা আর ইউরোপ তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু ওরা কখনই শক্তিশালী রাশিয়া চায়নি, চেয়েছে উপনিবেশ যেখান থেকে স্বল্পমূল্যে তেল গ্যাস সহ বিভিন্ন কাঁচামাল পাওয়া যাবে। এটা অবশ্য সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। ওরা উন্নত ইউক্রেন চায়নি, চাইলে সেখানে শিল্প, কৃষি এসব ধ্বংস হতে দিত না। ওদের দরকার ছিল অস্থিতিশীল, সমস্যা জর্জরিত ইউক্রেন যে সব সময় তাদের সব কথা শুনবে, যাকে দিয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করা যাবে।

অনেকের ধারণা যে রশিয়া এই সব পরিবর্তনের পেছনে আছে পুতিনের ম্যাজিক। আসলে আমেরিকা যেমন একটা সিস্টেমের উপর চলে এদেশ তেমন নয়। প্রেসিডেন্ট বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। এরা বলে – আমরা সব পারি, শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধ না সাধলেই হয়। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় চেচনিয়ার যুদ্ধের কথা। সামরিক বাহিনী বার বার বিজয়ের দোরগোড়ায় চলে এসেছে, কিন্তু বেরেজভস্কি সহ অন্যান্য অলিগারখ যারা এ থেকে প্রচুর মুনাফা করেছে আর পশ্চিমা বিশ্ব ইয়েলৎসিনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এটা করলে পশ্চিমা বিশ্ব ক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু পুতিন এসে অল্প দিনের মধ্যেই সেই যুদ্ধের ইতি টানেন। এর মানে বিজয়ের জন্য সব ছিল, ছিল না শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৯৯ সালে যখন রুশ সেনাবাহিনী কসোভার প্রিস্টিনার বিমানবন্দর দখল করে তারা ইয়েলৎসিনকে জানায়নি। পুতিন তখন এদের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি। পুতিনকে এ ব্যাপারে জানালে তিনি নিজে সেই অভিযান চালানোর পক্ষে মত দেন। পরবর্তী ঘটনা আমরা জানি। আসলে এ দেশের অনেক কিছুই, বিশেষ করে সামরিক দিকটা নির্ভর করে গেনস্তাব মানে জেনারেল স্টাবের উপর। এটা পেন্টাগন টাইপের সংগঠন যারা যুদ্ধ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরি করে। অনেকের ধারণা লেনিন জীবিত অবস্থায়ই স্তালিন গেনস্তাবের ফেভারে আসে। গেনস্তাব সাধারণত রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না, তবে দেশে উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। তাই যারা মনে করেন পুতিন না থাকলে সব শেষ তাদের সেই বিশ্বাস সত্য নাও হতে পারে।

যুদ্ধ মানেই অস্ত্রের পরীক্ষা। সেক্ষত্রে ইউক্রেন একটা পলিগন। রাশিয়া তার নতুন অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে টেস্ট করছে। এখন পশ্চিমা বিশ্ব সে পথেই এগুচ্ছে। চার্চিল বলেছিলেন ব্রিটেনের বন্ধু নেই, আছে জাতীয় স্বার্থ। আমেরিকারও তাই। তাই এদের নেতারা যদি জাতীয়তাবাদী না হয় তবে কারা হবে? অথচ আমরা যেকোনো দেশের নেতারা জাতীয় স্বার্থের কথা বললেই তাদের জাতীয়তাবাদী বলি। ভাবখানা এই জাতীয়তাবাদী না হওয়ার একটাই শর্ত – সেটা আমেরিকার স্বার্থ দেখা। তবে সমস্যা হল পশ্চিমা বিশ্বে এখন যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। কেন? শক্তিশালী নেতাকে ম্যানিপুলেট করা কঠিন বলে কি? যারাই একটু মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে চায়, তা সে ট্রাম্প হোক, স্যান্ডারস হোক – তাদের পথ কণ্টকাকীর্ণ করা হয়। সেটা করা হয় আইনি বেআইনি সব পন্থা অবলম্বন করেই। কিন্তু বড় নৌকায় দরকার বিচক্ষণ ও দক্ষ মাঝি। আজ পশ্চিমা বিশ্বে সেই দক্ষ নেতৃত্ব দেখতে পাই কি? বাইডেন, জনসন – এদের নিয়ে শুধু অলসরা হাসাহাসি করে না। অনেক আগে থেকেই জনসনের অবস্থা ছিল টালমাটাল। আর এখন তো তিনি বিদায়ই নিয়েছেন। সাথে নিয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে। অন্য অনেকের অবস্থাও খুব ভালো বলা চলে না। বলা হয় যেমন জনগণ তেমন তার নেতা। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকার দুর্বল নেতৃত্ব কি সেসব দেশের জনগণের দুর্বলতার কথাই বলে না। নাকি প্রচার মাধ্যম জনগণকে জম্বি করে রেখেছে বলেই সে সব গিলছে? এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে এ দেশে মুক্ত ভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয় না। হয়তো অনেকেই স্বীকার করতে চাইবেন না যে পশ্চিমা বিশ্বে এখন সেটা ঘটছে। কিন্তু বাস্তব কি বলে? ইউক্রেন সেনাদের স্কুল কলেজ ও আবাসিক এলাকায় অস্ত্র মোতায়েন করা নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যবহুল প্রতিবেদনের সমালোচনা হচ্ছে সেটা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যায় বলে। সিবিএস বাধ্য হয়েছে ভুল স্বীকার কালোবাজারে অস্ত্র বিক্রি নিয়ে তার প্রতিবেদনের জন্য। অর্থাৎ সত্য আজ আর অবজেক্টিভ নয়, সেটা স্বার্থনির্ভর। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্ব বর্তমান যুদ্ধে কিছুটা লাভবান হলেও সার্বিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, কারণ এর মধ্যে দিয়ে যে নৈতিক সংকটের সৃষ্টি হবে সেটাই একদিন ভেতর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের ভিত ধ্বংস করবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো