শিল্প সাহিত্য

স্বপ্নের জন্ম

– তামান্না হোসেন

আমাদের মায়ের বাড়ি দক্ষিন বংগে।
আমাদের বাবার বাড়ি পূর্ববংগে।
সেই বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ দশকে দক্ষিন পূর্বের এই মিলন কি করে ঘটে ছিল তা এক ইতিহাসই বটে। প্রমত্ত পদ্মা পাড়ি দিয়ে যেতে হয় আম্মার বাড়ি। আর বাবার বাড়ি যেতে হয় ঝিক ঝিক করে ট্রেনে। ছোট বেলায় আব্বার সাথে কমলাপুর স্টেশন থেকে ঈশা খাঁ, এগারসিন্ধুতে করে বাড়িতে যেতাম। ট্রেনে চড়ে বসার সাথে সাথেই আব্বা জুতা খুলে দিতো যেনো লম্বা বেঞ্চের মত সিটগুলোতে আরাম করে পা তুলে  বসে  জানালা দিয়ে বাইরের সব দৃশ্য যেন অবলোকন করতে পারি। ঢাকা থেকে ভৈরব জংশনে ঈসা খাঁ, এগারসিন্ধুর  প্রবেশ পর্যন্ত আমাদের শান্ত ভ্রমনে  দুর্দান্ত চাঞ্চল্যের  ঢেউ  আছড়ে পরতো। দূর থেকে যখন মেঘনা ব্রিজটা আমাদের দৃষ্টি গোচর হত। আমাদের ছোট্ট মনের অনুভবে  অদ্ভুত  শিহরণ। আব্বা দেখাতেন আর বলতেন  ঐ ব্রীজ মেঘনা নদীর উপরে। এর ভিতর দিয়ে ট্রেন যায় চট্টগ্রামে। আমার ভাই তখন চট্টগ্রামে পোস্টেড। আমার মনে হত ঐ ব্রীজ আমাদের কত আপন।
ঝটিকা  দেখা তবু্ও মননে আলোড়িত।
একটা নদীর সাথে, একটা ব্রীজের সাথে এতটুকুই আমার পরিচয়। উত্তাল নদী,নদীর পাড়ে অপেক্ষা, ভোগান্তি তা আমাদেরকে করতে হয়নি বটে কিন্তু বঞ্চিত হতে হয়েছে আমাদের নানার বাড়ির মধুর বেড়ানো থেকে আম্মা সহ আমাদেরকেও। ফরিদপুরের, গোপালপুর যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে মেঘনা,পাড়ি দিতে হবে প্রমত্ত পদ্মা। আমাদের পূর্ব বংগে যাতায়াত পানি পথের নয় ফলে আব্বা  এত সব  ভয়ংকর নদী পেড়িয়ে  নানা বাড়ি বেড়ানোকে  ভীতিকর যাত্রার ভিতরে আবদ্ধ করেছিলেন। যাওয়া হয়ে উঠেনি তেমন। প্রথম গিয়েছিলাম যখন আমি অস্টম শ্রেনীতে। আমাদের নানু এসেছিলেন বেড়াতে আমাদের বাসায়। বেশ কিছুদিন থাকার পরে উনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। সাথে আমিও যেতে চাই। কিন্তু আব্বা তো আমাকে এই পানি পথে যেতে দিতে একদম রাজী নন। নানুই অনেক বলে কয়ে আব্বাকে রাজী করালেন। নানুকে নিয়ে রওনা দিলাম চলনদার দাদাভাই আর মামাতো ভাই কামাল ভাই। সদর ঘাট থেকে স্টিমারযোগে যেতে হবে মাদারিপুরের টরকী বন্দর। সেখান থেকে গোপালপুরের কাজি বাড়ি। রাতের বেলায় স্টিমার ছেড়ে যাবে সদর ঘাট। ভোরে নামাবে টরকী বন্দরে। রাতের কালো আধাঁরে নদীর  কোন রূপই আমি দেখতে পাইনি কিন্তু নদীর যে  ঢেউ , তার সাথে স্টিমারের দুলুনী, আশে পাশে মানুষের গুঞ্জন সব মিলিয়ে আমি অন্য এক ঘোরে, অন্য এক ভীতিকর অনুভুতিতে জড়িয়ে  থাকলাম নানুর সাথে। নদীর রূপ আর দেখা হয়নি।কিন্তু অনুভব অভাবনীয়।
প্রবাস থেকে দেশে গেলাম। ভাইদের বললাম  গোপালপুর যাবো। ওহাইওর কলম্বাসে গোপালপুরের খোকন ভাই যখন অকালেই ইন্তেকাল  করলেন তখনও মামা জীবিত।  ভাবী ওহাইও  থেকে বাক্সবন্দি খোকন ভাইকে নিয়ে গোপালপুরে গেলেন। সেখানেই চির নিদ্রায় শায়িত।  সাথে আছেন নানা, নানু, মামী আরও দুই মামা। মন চাইলো খুব গোপালপুর যেতে। আমার তিন ভাই মহা উৎসাহে আমাকে নিয়ে রওনা দিল আবারও স্টিমার যোগে। এবার গন্তব্য ঢাকা টু বরিশাল। সেখান থেকে গোপালপুর হয়ে সড়ক পথে ঢাকায় ফিরবো। এবার আমি পরিনত। পদ্মা,মেঘনা,কীর্ত্তনখোলার রূপ দেখার জন্য প্রস্তুত। সদরঘাট থেকে স্টীমার রওনা হল। স্টীমার চলার শুরু আর শুরু হল আমাদের ভাইদের কেবিনের ভিতরে টেবিল জোরা দিয়ে একটার পর একটা খাবারের অর্ডার।সারারাত ধরেই হল উৎসব মুখর নৌভ্রমণ। বাল্যকালের ভয়ের  বালখিল্যতা আমার ভিতর আর ছিল না। ছিল প্রবাসে থাকা বুভুক্ষু হৃদয়ের অনেক আহাজারি। আমার গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নিশুতি রাতের প্রমত্ত পদ্মার জলের শীতল বাতাস। যে বাতাস আমার অন্তর কে স্পর্শ  করছে। আমাকে ধারন করছে। পরবাসের ইস্ট , হাডসন, পটোমেক, মিসিসিপি,  কলারেডো রিভাভের বাতাস আমাকে স্পর্শ করেছে কিন্তু ধারন করেনি। আমার নিদহীন আখিঁ আর  স্মৃতির ঝাঁপি থেকে ঝাপিয়ে পরা  আমার সেই কিশোরী কালের প্রথম পদ্মা পাড়ি দেয়ার  সব  অনুভুতি গুলো  লাল নীল নানান বর্নিল রঙের বাবল  হয়ে আমার চারিদিকে ঘুরছে।আমি   বর্তমানে নেই -চলে গেছিলাম সেই সময়ে। আব্বা, নানুর সাথে মাখানো সেই ফেলে আসা দিনে।
ভাইদের সাথে বরিশাল নেমে মাইক্রোবাসে আমরা গেলাম -বরিশালের সাথেই লাগোয়া বুরঘাটা, পার হয়েই গোপাল পুরে।আমাদের মায়ের প্রিয় গোপালপুর। মায়ের স্মৃতিতে চির অম্লান  এই  মাটিতে অনেক  ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমাদের ফেরত আসতে হচ্ছে সড়ক পথে এবং পাড়ি দিতে হবে আবারও প্রমত্ত পদ্মা বড় কোন ফেরিতে নয় লঞ্চে। ঘাটের নাম মাওয়া ঘাট।পড়ন্ত বিকেলে আমরা ঘাটে এসে পৌছুলাম। মনে হল  নুতন করে আবার নদীকে দেখলাম। হায়রে কি বিশাল নদী। সেকি তার রাগী চেহারা। ফোস ফোস করছে। ভেবেই আমি আতংকিত ছোট্ট  লঞ্চে অতিক্রম করতে হবে এই নদী। এক সময় খেয়া পাতার মত
ভাসতে ভাসতে আমরা এই পারে এসে  ডিজনী ল্যান্ডের পাগলা রাইড গুলোর মত বাস জার্নি করে ঢাকায় এসে পৌছুলাম। আর ভাবলাম,দক্ষিন বংগের মানুষের নদীর সাথে বশ করে চলা কি কঠিন এই চলাচল।  কত আপন জনের  ভেসে যাওয়া, অসুস্থ জনের উন্নত চিকিৎসায় আসতে না পারা,  সময় মত ফেরি না পেয়ে নদীর পারে অপেক্ষা, আবহাওয়ার জরুরি সংকেত আরও আরও  কত প্রতিবন্ধকতা। কত স্বপ্নের মৃত্যু।
পদ্মার উপর সেতু হচ্ছে, নিজেদের অর্থায়নে এই বিরাট কর্মযজ্ঞের খবর রাখা হত নিয়মিত। কখন কত নাম্বার স্প্যান বসানো হচ্ছে দেখতাম খবরে। রাজনীতির নানান চমক আর অপেক্ষার পালা শেষ করে অবশেষে ঐতিহাসিক উদ্বোধন হল। সেদিনেই ফুর্তিতে ভরপুর এই জাতি সেতুর বল্টু খুলে  নিয়ে নিল। কেউ পানি বিয়োগ করলো। জাতীয় খবরে এলো এবং দুই জনের মৃত্যু হল। হল পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন।
পদ্মা সেতু মুনশিগঞ্জের লোহজং, শরিয়তপুর আর বৃহত্তর ফরিদপুর ভেংগে মাদারিপুরও জেলা হল ( আমাদের নানাবাড়ি এখন মাদারিপুর) সেই এলাকার কোঠি মানুষের যোগাযোগ এর দুর্দান্ত এক জয়। অত্র এলাকার মানুষের স্বপ্নেরা ডানা মেলে দিল।স্বপ্ন হল সত্যি।  তাঁরা এখন বাড়ি থেকেই নাকি রাজধানিতে যাতায়াত করবে। পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে লাগবে ৬ মিনিট কিন্তু রাজধানীর যানজটে থাকতে হবে কয় ঘন্টা? পদ্মা সেতুর মত করে নয়, যদি সামান্যই একটা কর্মযজ্ঞ হত রামপুরা থেকে মৌচাকের জ্যামটা ছুটিয়ে দেয়ার তা হলে কত লাখে লাখে মানুষ উপকৃত হত।
ভাতিজা মুখর জানালো, তারা এই প্রজন্ম অচিরেই যাবে আমাদের নানাবাড়ি ভ্রমন করতে। জয়তু পদ্মা সেতু।
আমার চাবির গোছাটা খুজে পাচ্ছিলাম না। রবিবার বাইরে গেলাম, গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরলাম,দরজা খুলে বাসায় প্রবেশ করলাম কিন্তু তারপর থেকেই চাবির ঝোপা লাপাত্তা।  বাসার ভিতরে নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপরে হল রাত। চাবির খোঁজ নেই।এর মাঝে অফিসে যে মেয়েটা আমারও আগে আসে সে জানালো এক ঘন্টা তার দেরী হবে। আমার অফিসের চাবিও সেই গোছাতেই। হায় হায় কি ঝামেলায় পরা হল। রাতে চিন্তা করতে থাকলাম বাসায় এসে প্রথম কি করেছিলাম। রাতে শুয়েই মনে হল বাসায় প্রবেশ করেই চলে গেছিলাম বাগানে। ভোরে ঘুম ভাংতেই দোয়া পড়ে একটু ছুটে গেলাম বাগানে। আলহামদুলিল্লাহ, ঘাসের ভিতরে পেলাম চাবির গোছা।  প্যান্টের পকেট থেকে পরে গিয়েছিল কখন যে ঠাহর করতে পারিনি।
যে হারে মাথার ভিতরে পদ্মা সেতুর খুঁটিনাটি ঘুরপাক খাচ্ছিলো ভাবলাম আমার চাবির গোছা না জানি টুস করে কোথায় পরে গেছে।
আমাদের পদ্মা সেতুর জন্মে আমরা উচ্ছ্বসিত।