চলমান সংবাদ

সরকারের খরচ কমানোর নির্দেশে কমছে না ‘বিলাসিতা’

দেশের অর্থনীতিকে চাপ থেকে উদ্ধারের জন্য সরকার খরচ কমানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছে৷ সর্বশেষ আরো আট ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ কিন্ত এই নির্দেশনা কতটা কাজে আসছে?

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যা করা হচ্ছে তা  আর্থিক ভিত্তিতে৷ তাই কিছুটা ফল আসলেও খুব বেশি কাজে আসবে না৷ কারণ যথাযথ মনিটরিং পদ্ধতি নেই৷

অন্যদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে সরকার আমদানি ব্যয়ও কমাতে চাচ্ছে৷ এর ফলে চাপ পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এখন সারাদেশে শিডিউল করে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে৷ একইভাবে গ্যাসেরও রেশনিংয়ের চিন্তাভাবনা হচ্ছে৷

এর আগে সরকার গত ১২ মে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরতে খুব প্রয়োজন না হলে বিদেশ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ ২০ জুলাই সরকার আরো যে আটটি সিদ্ধান্ত নেয় তার মধ্যে রয়েছে সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, জ্বালানি খাতে সরকারের বাজেটের ২০ শতাংশ কম ব্যবহার, অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ সফর পরিহার করা, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, ভ্রাম্যমাণ আদলেতের মাধ্যমে মজুতদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি৷

বিদেশসফর

 সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের লাগাম টানা যাচ্ছে না৷ চর দেখতে, মশলার চাষ শিখতে, মেডিকেল যান্ত্রপাতির প্রশিক্ষণ নিতে,পড়াশুনা করানো শিখতে বিদেশ সফর অব্যাহত রেখেছেন তারা৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৮ জন কর্মকর্তা মশলার চাষ শিখতে বিদেশে যাচ্ছেন৷ তারা ভারত, শ্রীলঙ্কা অথবা থাইল্যান্ডে যাবেন৷ এতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৯০ লাখ৷ তবে যাওয়ার কথা ছিলো ৬৫ জনের৷ পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে সংখ্যা কমানো হয়েছে৷

এদিকে বাংলাদেশের চরের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা যায় তা দেখতে যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০ জন সরকারি কর্মকর্তা৷ নয়জন এরইমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন৷ বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন৷ তাদের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি আদেশ জারি হয়েছে৷

২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার বিদেশ সফরের একটি প্রকল্প এখন চলমান আছে৷ তারা শিশুদের পড়ানো শিখতে বিদেশ যাচ্ছেন৷ এই বিদেশ সফরে মোট খরচ হচ্ছে ৫৯০ কোটি টাকা৷ ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়৷ করোনার আগে ৮২০ শিক্ষক-কর্মকর্তা বিদেশ ঘুরে এসেছেন৷ বাকিরা এখন পর্যায়ক্রমে যাবেন৷ আর সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করতে প্রশিক্ষণ নিতে ৪২ জন, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে৷ এতে খরচ ধরা হয়েছে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা৷

সরকারি কর্মকর্তাদের  গাড়ি

 সরকারি কর্মকর্তাদের গড়ি বিলাস কমেনি৷ সরকারি একেকটি গাড়ির পিছনে সরকারের মাসে জ্বালানি তেলসহ ব্যয় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা৷ উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণে নিয়ে গাড়ি কেনার পর তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা নেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়িও ব্যবহার করছেন৷ এতে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে৷

এসিবিলাস

সচিবালয়ে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকার পরও আরো দুই হাজার ৭০০ এসি আছে বিভিন্ন রুমে রুমে৷ এসি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নাই এরকম ৮০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর রুমেও এসি আছে৷ মোট সাড়ে ছয় হজার টন এসি আছে সচিবালয়ে৷ ঢাকায় একক সরকারি ভবন হিসেবে কমপক্ষে ১৩টি ভবন এসি বিলাসের জন্য এরইমধ্যে আলোচনায় এসেছে৷ তারমধ্যে রাজস্ব ভবনে দুই হাজার ৫০০ টন, পানি ভবনে দুই হাজার ৪০০ টন, অর্থ ভবনে এক হাজার ৫০০ টন, পুলিশ ভবনে এক হাজার ২০০ টন৷ প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তাদের এসির ব্যবহার কমিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এই গরমে স্যুট-কোট না পরার আহ্বান জানিয়েছেন৷ কিন্তু মন্ত্রীদের বৈঠকগুলোতে মন্ত্রী এবং কর্মকর্তাদের স্যুট-টাই পরা অবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে৷ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতখেকো এসির ব্যবহার একটুও কমেনি৷

আর এই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের দৈনিক ভ্রমণ ভাতা ও বদলি ভাতা বাড়ানো হয়েছে৷ আর সরকারি কর্মকর্তারা নানা বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্যও যে ভাতা পান তা অব্যহত আছে৷ এদিকে উপজেলা পর্যায়ে সরকারি অফিসেও বিদ্যুৎ ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে৷ কিন্তু তার কোনো নীতিমালা জারি করা হয়নি৷ ফলে ব্যয় কমানো কোনো উদ্যোগ এখনো স্পষ্ট নয়৷

উন্নয়ন প্রকল্পে লাগাম

তবে সরকার বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের লাগাম টেনে ধরেছে৷ এরমধ্যে রয়েছে সব উপজেলায় এলইডি স্ক্রিন বসানো, নদী খনন, নতুন সরকারি ভবন নির্মাণ, গ্রামীণ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রভৃতি৷ এছাড়া কমপক্ষে ৬৩৬ টি প্রকল্পে বরাদ্দ কাটছাঁট করা হচ্ছে৷

বিশ্লেষকরা যা বলেন

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা যায়নি:ড. ইফতেখারুজ্জামান

 টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে৷ যখন যেটা মনে হচ্ছে তখন সেই নির্দেশ দেয়া হচ্ছে৷ সবকিছু করা হচ্ছে অ্যাডহক ভিত্তিতে৷ এটার ফল পেতে হলে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া দরকার৷ তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘সিদ্ধান্তগুলো যখন নেয়া হচ্ছে তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাজ হলো তা মনিটরিং করা৷ কিন্তু আসলে কে মনিটর করছে আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা৷ একেকটি বিষয় একেক রকম৷ তাই একটার সাথে আরেকটা মেলানো যায় না৷ সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা যায়নি৷ খুব জরুরি হলে ঠিক আছে৷ কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিদেশ সফর হচ্ছে তা আসলে ভ্রমণ ছাড়া আর কিছুইনা৷ তারা সরকারের আদেশ অমান্য করছেন৷ বিদ্যুতের কথাই বলেন৷ সেটা এখন ব্যবহারের নীতিমালা কী?”

দুর্নীতি বন্ধে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখছি না:মইনুল ইসলাম

অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘সরকার যে উদ্যোগ গুলো নিচ্ছে তাতে কিছুটা উপকার পাওয়া যাবে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিলে ব্যবহার তো কমবেই৷ মানুষ চাইলেই তো উৎপাদনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ পাবে না৷ আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সরকার চাইলেই বন্ধ করতে পারবে না৷ কারণ এর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত৷ এখানে ভ্রমণ ছাড়াও আরো অনেক সুবিধার বিষয় আছে৷”

তার মতে, সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমাচ্ছে কিন্তু রাজস্ব বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই৷ প্রত্যক্ষ কর বাড়ছে না৷ ‘‘সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে দেশের সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যেত৷ কিন্তু সেটা বন্ধে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখছি না৷ সরকার চায়ও না,” বলেন মইনুল ইসলাম।

সূত্রঃ ডয়চে ভেলে