মতামত

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

-রবীন গুহ

এম আর আখতার মুকুল এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু যখন দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচার দেয়া শুরু করলেন তখন একদিন রাজশাহীর এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবার আগে দেখি তাজউদ্দীন আহমদ তার হাতে ছোট একটি কাগজ গুঁজে দিলেন। ওই কাগজ দেখে আমার কৌতুহল হলো। আর এই কৌতুহল থেকে বগুড়ার জনসভায় যাবার পরে জানতে পারলাম প্রতিটি জনসভার আগে তাজউদ্দীন আহমদ যে ছোট কাগজটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গুজে দেন সেটা আর কিছু নয়, ওই এলাকায় কী কী প্রয়োজন তার একটি লিস্ট। বাংলাদেশের কোথায় কী দরকার, সেটা বঙ্গবন্ধুর নখদপর্নে ছিল। তারপরেও দলের সেক্রেটারি হিসেবে যে প্রতিটি জনসভার জন্যে এভাবে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে যথাসময়ে নেতার হাতে দেওয়া একটা দায়িত্ব তা ওই প্রথম বুঝতে পারলাম।”

প্রয়াত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাজউদ্দীনের সম্পর্কে বলেন,”তার শিক্ষা বুদ্ধি,সংগঠন-শক্তির সাথে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, সাহস ও জনপ্রিয়তার মিশ্রণে আওয়ামী লীগ এদেশের একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। আমি তাজউদ্দীনকে ঠাট্টা করে ডাকতাম চৌ অব বেঙ্গল। অর্থাৎ চৌ এন লাই।”

সত্যিই তাই। চীনের চৌ এন লাই যেভাবে মাও সেতুংকে আজীবন ছায়ার মত পাশে থেকে রাজনৈতিক লক্ষ সাধনে  সাহায্য করেছিলেন ঠিক তাজউদ্দীনও বঙ্গবন্ধুর সবসময়ের রাজনৈতিক সহযোগী  হিসেবে থেকে আওয়ামীলীগের জন্মলগ্ন থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠার পিছনে নেপথ্যের কারিগর হিসেবে তাজউদ্দীনের ভুমিকা অনস্বীকার্য। কখনো কখনো দূরের আকাশের নিস্প্রভ তারার মত মনে হলেও ইতিহাসের নির্মোহ পাঠ করলে দেখা যায় তাজউদ্দীন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য ও অপরিহার্য চরিত্র।

১৯৭১ সালের ২০শে মার্চ বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশকে নিয়ে এক প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা করে। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে লেখা হয়…

“Tajuddin Ahmad, 46, Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is consider one of the partys leading intellectuals.”

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই  বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর তাজউদ্দীন এদেশের কান্ডারী ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী  সরকারের প্রধানমন্ত্রীরূপে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব  দেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শীতা, প্রজ্ঞা ও একাগ্রতা দিয়ে নয় মাসের মুক্তি সংগ্রামের বহুমাত্রিক লড়াইকে সংহত ও লক্ষ্যভেদী করে এক অসামান্য অর্জন তিনি সম্ভব করেছিলেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সৎ, নিষ্ঠাবান ও আপোষহীন রাজনীতিবিদ।

চতুর রাজনীতিবিদ  ভুট্টো ঠিকই লক্ষ্য করেছিলেন তাজউদ্দীনের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। তাই একাত্তরের মার্চ মাসে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন, একদিন তাজউদ্দীন হবে তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার বক্তব্যগুলো  বিশ্লেষণ করলে তার রাস্ট্রনায়কোচিত , সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার পরিচয় মেলে।

“আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস। কারণ, প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।…যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক ‘জয় বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’।”

(১০ ও ১১ এপ্রিল ১৯৭১)

নেতার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ও  অগাধ আস্হা রামায়নের ভরত চরিত্রের সাথে তুলনা করা যায়। ভরত যেমন বড়ভাই রামের অবর্তমানে সিংহাসনে পাদুকা রেখে নিষ্ঠার সাথে রাজ্য পরিচালনার কাজ চালিয়ে যান, তেমনি তাজউদ্দীনও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্হিতিতে জাতির চূড়ান্ত ক্রান্তিলগ্নে নিজের কাঁধে তুলে নেয়া দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারু ও দক্ষতার সাথেই পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিকে যেমন ছিলেন সরকার ও যুদ্ধ পরিচালনায় একাগ্রচিত্ত, আবার কারারুদ্ধ নেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়েও ছিলেন সোচ্চার। তিনি বলেন,

“বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা মেখে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন, দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দিজীবন যাপন করছেন। তাঁর বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করেছে বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের ওপর এর তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের ওপর যেসব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তিসাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।“

(৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের কল্যাণ সাধন করা তবে তাজউদ্দীন ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের উৎকৃস্ট উদাহরণ।  মেধা, শ্রম, প্রজ্ঞা সবকিছুই ঢেলে দিয়েছেন মানুষকে ভালবেসে। নিজের জন্য কোন প্রতিদানের আশা না করেই এদেশের  মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। ‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।’ তা না হলে এমনভাবে বলা যায়!

আজ ২৩ জুলাই ক্ষনজন্মা প্রবাদপ্রতীম এই নেতার জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

তথ্যসূত্রঃ

(তাজউদ্দীন আহমদের একাত্তরের বক্তৃতামালা, প্রথম আলো/ ১৬ডিসেম্বর২০২১)