বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫৩): উৎসব ও যাতায়াত ব্যবস্থা

– বিজন সাহা

গত সপ্তাহে পৃথিবীর দেশে দেশে কোরবানির ঈদ পালিত হল। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ। লেগেছে কেনাকাটির ধূম। কেনাকাটির সাথে সাথে আসে বাড়ি ফেরার চিন্তা। যদিও বাংলাদেশ আর সেই গ্রাম বাংলা নেই এবং বাংলাদেশ মানেও আর ছেষট্টি হাজার গ্রাম নয়, তারপরেও গ্রামের সাথে এদেশের মানুষের নাড়ীর টান। ভাগ্যের সন্ধানে নতুন শহরে আসা মানুষ তো বটেই, যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে শহরে বাস করছে তারাও এই সুযোগে ফিরে যায় বাংলার গ্রামে, বাংলার শ্যামলিমায়। ঈদের ছুটিকে তাই ঘরে ফেরার ছুটি বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিভিন্ন টিভি নিউজ দেখাচ্ছে মানুষের ঘরে ফেরার ছবি। ট্রেন, বাস, লঞ্চ – কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। সমস্ত বাংলাদেশ ছুটছে, ছুটছে মাটির টানে, ছুটছে গ্রামের পানে।

উত্তর গোলার্ধে এখন গ্রীষ্ম কাল। এখানে হাতে গোনা যে কটা উষ্ণ দিন তা এই গ্রীষ্ম কালকে ঘিরেই। প্রায় সারা বছর বরফ ঢাকা শুভ্র শীতল রাশিয়ার মানুষ তাই এ সময়ে যায় উষ্ণতার খোঁজে দখিন সাগরে। যায় সারা বছরের জন্য রোদের উত্তাপ গায়ে লাগাতে। যায় আলোর জন্য, তাপের জন্য, যায় শীত কালে গরমের রেশটুকু ধরে রাখার জন্য।

আগে যখন বিদেশ যাত্রা ছিল অমাবস্যার চাঁদের মত তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ বেড়াতে  যেত কৃষ্ণ সাগরে, কেউ কেউ ককেসাস পর্বতমালায়। আবার অনেকেই মধ্য এশিয়ায়। এখন আর সেই যুগ নেই। সারা বিশ্বের দুয়ার খুলে গেছে রুশদের সামনে। তারা আজ যায় মিশর, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, ডোমিনিকান রিপাবলিক আর ইউরোপের দেশে দেশে। করোনা কালে অবশ্য এতে ছেদ পড়েছিল। এখন যুদ্ধের কারণে বাইরে যাবার হিড়িক আর নেই আগের মত। মানুষ যাচ্ছে কৃষ্ণ সাগরে। যাচ্ছে কামচাতকা, উড়াল পর্বত, আলতাই, কারেলিয়াসহ রুশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশে বাচ্চাদের রেস্ট নেবার জন্য বিশেষ তহবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি মস্কো অঞ্চলে গড়ে উঠছে বিভিন্ন রেস্ট হাউজ। এক কথায় এ দেশের মানুষ যাতে ছুটিটা ঠিক মত উপভোগ করতে পারে সে জন্যে সরকার চেষ্টা করছে বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা নিতে।

এই সময় শুধু বাইরেই নয়, বড় বড় শহরের মানুষ যায় গ্রামের বাড়িতে। সেই জারের আমল থেকেই এটা প্রচলিত। দস্তইয়েফস্কি সহ অনেক রুশ লেখকের অমর রচনায় শহরের উপকণ্ঠে এসব গ্রীষ্ম নিবাস সম্পর্কে লেখা আছে। তবে সোভিয়েত আমলে সেটা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। রুশ ভাষায় এসব গ্রীষ্ম নিবাসকে বলে দাচা। অনেকেই পুরা সামারটা দাচায় কাটিয়ে দেয়। সোভিয়েত আমলে সেটা ছিল ৬ শতকের একটা প্লট, যাতে ছিল ছোট্ট একটা ঘর। সেখানে মানুষ রেস্ট নেবার পাশাপাশি আলু, টম্যাটো, শসা, গাজর, শালগম আর বিভিন্ন রকম বেরি চাষ করত। শীতের দেশে এটাই একমাত্র সময় বাগান বাড়িতে কিছু ফলানোর। সোভিয়েত আমলের কমবেশি ভদ্রস্থ আয়ের পাশে এটা ছিল এক্সট্রা আয়। এটা শুধু রেস্ট ছিল না, ছিল যাকে বলে আক্টিভ রেস্ট মানে বিশ্রামের সাথে সাথে কায়িক পরিশ্রম। এখন অবশ্য যুগ বদলে গেছে। অনেকেই এসব সামার হাউজে মনোরম কটেজ তুলছে। করোনা কালে অন লাইনে কাজের হিড়িক লাগার পরে অনেকে সেখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। এটা মানুষকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই গ্রীষ্ম কাটাতে না হলেও সেখানে যায় উইকএন্ড কাটাতে। বিশেষ করে মে আর সেপ্টেম্বরে – যখন কাজে ফিরতে হয় অথচ আবহাওয়া বাগান করার উপযোগী। এ সময় রাস্তাঘাট ভরে যায় গাড়িতে। ট্র্যাফিক জ্যাম শুরু হয় রুটিন মাফিক। বিশেষ করে শুক্রবার রাতে আর রবিবার বিকেলে। শুক্রবার মানুষ বড় শহর থেকে গ্রামের দিকে যায়, রবিবার শহরে ফেরে।

নিজেদের গাড়ি ছাড়াও প্রচুর মানুষ দাচায় যায় পাবলিক ট্র্যান্সপোরটে। তাই মোটামুটি মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত এরা ট্রেনের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেয়। একই ঘটনা ঘটে দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলোর ক্ষেত্রেও। সোচি, সিম্ফেরাপোল এসব লাইনে শুধু মস্কো বা পিতের থেকেই ট্রেনের আর প্লেনের সংখ্যা বাড়ে না, রাশিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে অতিরিক্ত ট্রেন, প্লেন, বাস চালু করা হয় যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই এসব এলাকায় যেতে পারে, সেসব জায়গার গিয়ে রেস্ট নিতে পারে। এটা শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উপার্জন বৃদ্ধিতেই সাহায্য করে না, সাধারণ মানুষও তাদের ছুটিগুলো অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত মনে কাটাতে পারে।

একই কথা বলা চলে বাইরের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে নববর্ষের ছুটির সময় রাশিয়া থেকে প্রচুর লোকজন তুরস্ক, মিশর, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড এসব দেশে যায়। তখন চার্টার্ড বিমানের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য একটাই – মানুষ যেন তাদের ছুটি কাটাতে ঝামেলায় না পড়ে। এরপরও যে ঝামেলা হয় না তা কিন্তু নয়। অনেক প্রাইভেট কোম্পানি বেশি মুনাফার লোভে মানুষ ঠকায়। সরকার চেষ্টা করে আইনের মধ্যে থেকে ব্যবস্থা নিতে। তবে প্রায়ই এসব কোম্পানিগুলো চুক্তিতে এমন সব পয়েন্ট ঢুকিয়ে দেয় যা সাধারণত খুব ছোট অক্ষরে লেখা থাকে বলে মানুষ পড়ে না। এর ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে না।

আমাদের দেশে প্রতি বছরই ঈদ, পূজা এসব আসে। এদের হাত ধরে আসে সরকারি ছুটি। পড়ে বাড়ি ফেরার হিড়িক। এটা আমি যেমন দেখছি তেমনি দেখেছে আমার পূর্বসূরিরা। মানুষ কল্পনীয় ও অকল্পনীয় সব রকমের কষ্ট সহ্য করে, সব ধরণের আইন অমান্য করে, সব ধরণের রিস্ক নিয়ে বাড়ি ফেরে। এতে করে তারা শুধু কয়েকগুন বেশি দামে টিকেট ক্রয়ই করে না, জীবনের রিস্ক পর্যন্ত নেয়। ট্রেন বাসের ভেতর তো বটেই ছাদেও তিল ধারনের জায়গা থাকে না। লঞ্চগুলো অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ডুবতে ডুবতে ভেসে থাকে। ইন্টারনেট ছেয়ে যায় এসব এক্সট্রিম জার্নির ছবি দিয়ে। যেহেতু ছবি তুলি, তাই হাত নিশপিশ করে এ ধরণের ছবি তোলার। কিন্তু ছবি তোলার জন্য মানুষের দুরাবস্থা নিয়ে না ভাবলে চলবে কীভাবে? প্রশ্ন হল যদি প্রতি বছরই নিয়ম করে এ সমস্যা দেখা দেয় তাহলে কেন সরকার উৎসবের সময়ে অতিরিক্ত ট্রেন, বাস, স্টিমার এসবের ব্যবস্থা করে না। আমার তো মনে হয় গ্রামে গ্রামে মন্দির মসজিদ বানানোর চেয়ে উৎসব উপলক্ষ্যে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অর্থনৈতিক ভাবে যতই উন্নত হই না কেন মানসিক ভাবে এখনও সেই গ্রাম বাংলার মানুষই রয়ে গেছি। তাই বছরে কয়েক বার দেশে না গেলে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা না করলে, পাড়ার চায়ের দোকানে বসে সবাই মিলে চা না খেলে জীবনটা আমাদের ষোল কলায় পূর্ণ হয় না। খবরে দেখলাম অমুসলিম কর্মচারীর  অভাবে অনেক জায়গায় ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। সেটা কেন? প্রথমত এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে আগে থেকেই সেটা খেয়াল করতে হবে। তাছাড়া এই সময়ে যারা ডিউটি করে তাদের জন্য অতিরিক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সমস্ত পৃথিবীতেই সেটা হয়। মস্কোয় পাবলিক ট্র্যান্সপোরট চলে রাত ১ টা পর্যন্ত। কিন্তু নববর্ষ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সময়টা বাড়িয়ে দেয় যাতে মানুষ ঘোরাফেরা শেষ করে ঘরে ফিরতে পারে। এক কথায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত সার্ভিস চালু করে। আসলে যখনই দেশ এ রকম সমস্যা, তা সে যুদ্ধ হোক, বন্যা হোক, বিভিন্ন উৎসব হোক – এসবের মুখোমুখি হয়, সরকারের দরকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেটা সুষ্ঠু ভাবে পালন করার পরিবেশ তৈরি করা। যেখানে নববর্ষ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোকজন যাতে নির্বিঘ্নে সারাদিন আনন্দ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা দরকার সেখানে আমরা অনুষ্ঠানের সময় সীমা বেঁধে দিই, বিভিন্ন উৎসবের আগে সারা দেশের মানুষ যখন ঘরে ফিরতে চায় আমরা জনগণকে তখন নিজের হাতে ছেড়ে দিই। প্রায়ই দেখি দেশ থেকে বিভিন্ন ডেলিগেশন যাচ্ছে বিদেশে পুকুর কাঁটা, সাঁতার শেখা এসবের প্রশিক্ষণ নিতে। অথচ উৎসবের সময় যাতে ট্র্যান্সপোরট কলাপ্স না করে সেটা জানার বা শেখার জন্য কেউ কোথাও যায় না। এই যে বিভিন্ন সময়ে দেশে নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি তৈরি করা হয়, ঈদ, পূজা এসব উৎসবে যদি জনগণ সেই সুবিধা ভোগ করে দেশেই যেতে না পারে তাহলে এ উন্নয়নে কী লাভ? নাকি এসব শুধুই সেলফি তোলার জন্য? আসলে উৎসবের সময় ট্র্যান্সপোরট কলাপ্স বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা। বাড়ি ফেরা – এটাও মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। কাজ করার সাথে সাথে মানুষের আনন্দ করার স্বাধীনতা থাকা দরকার আর সেই স্বাধীনতা হওয়া দরকার সামর্থ্যের মধ্যে এবং নিরাপদ। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথাবার্তা বলে অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। জানি এক সঙ্গে কয়েক কোটি লোকের সুলভ ও নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা চাট্টিখানি কথা নয়, তবে এ নিয়ে ভাবতে শুরু করতে হবে, বলতে হবে। যেকোনো সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত সেই সমস্যা নিয়ে কথা বলা, সেটা সামনে নিয়ে আসা। করোনাকালীন সময়ে গার্মেন্টস কর্মীদের চলাফেরায়ও এই ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই বর্তমান বাস্তবতায় শুধু উৎসব নয়, দৈনন্দিন জীবনেও এ ধরণের সমস্যা দেখা দিতেই পারে। ফলে সংশ্লিষ্ট সবার এখন থেকেই এ সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করি।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া