মতামত

স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন বাস্তবতা

– রবীন গুহ

পক্ষে ও বিপক্ষের রাজনীতি অসংখ্য জল্পনা-কল্পনা আর বাধা-বিপত্তির অবসান ঘটিয়ে গত ২৫জুন দেশের দীর্ঘতম পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা। স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন আর নিছক স্বপ্ন নয়, অথবা কেবলই উচ্চাভিলাষী কোন প্রকল্পও নয়, পদ্মাসেতু এখন বাস্তবতা। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক, জাপানী সরকারী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা  জাইকাসহ সব বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এই প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন তখন এদেশের বড় বড় রথী-মহারথীদের অনেকেই বললেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা একেবারেই অসম্ভব। ‘নিজের টাকায় নিজের সেতু’ নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার ব্যক্তিগত দৃঢ়তা আর সাহসিক সিদ্ধান্তের ফলে নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মাসেতু সফলভাবে  নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। খোদ সরকারের সমালোচক মহলেও অনেকেই বিষয়টা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই সেতু চালু হওয়ার ফলে ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে। সহজ ও দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের কারণে এই সেতু অত্র এলাকার ভাগ্যনিপীড়িত মানুষের জীবনযাত্রার মানের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, পদ্মা সেতুর ফলে দেশে ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। তাই অবকাঠামোগত অনন্যতা ও আধুনিক নির্মানকৌশলকে ছাপিয়ে ব্যয়বহুল পদ্মাসেতুর সফল বাস্তবায়নকে আজকে দেশে-বিদেশে অনেকেই নতুন বাংলাদেশের সক্ষমতা ও বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাড়ানের প্রয়াস হিসেবেই দেখছেন। তবে এতটা সহজ ছিলনা পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ। প্রমত্ত পদ্মানদীর বুকে সেতু নির্মাণ যেমন কারিগরী দিক থেকে একটা বড়রকমের চ্যালেন্জ ছিল, তেমনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনার জায়গা থেকেও ছিল ব্যাপক বাধা। এদেশে সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ ও বিরোধী দলগুলোও পদ্মাসেতুর ব্যাপারে কোন সহায়তা তো করেইনি উপরন্তু নানা রকমের দুর্নীতির অভিযোগ, এমনকি হাসি-হাট্টা, টিপ্পনী কেটে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়ার পরে এদেশে সমালোচনা, নানা মহলের সংশয়, বাধা-বিপত্তি ইত্যাদিকে উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে যে সেতু নির্মাণ শুরু করেছিল শেখ হাসিনার সরকার, তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলো গত শনিবার সেতুটির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।

দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু উদ্বোধন শেষে তা পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে এসে পূর্ব নির্ধারিত এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পদ্মা সেতু নির্মাণে যারা বাধা দিয়েছিল,তাদেরকে একটা উপযৃক্ত জবাব আমরা পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে দিতে পারলাম যে, বাংলাদেশও পারে”।  তিনি আরো বলেন, “তখন তারা কী বলেছিল? বলেছিল, আওয়ামী লীগ কোনোদিন নাকি পদ্মা সেতু করতে পারবে না। খালেদা জিয়াকে আজকে জিজ্ঞেস করি- আসুন, দেখে যান, পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না।” পদ্মাসেতুর সফল নির্মাণ সরকার যেমন নিজেদের বড় রকমের সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছে, বিরোধী পক্ষ এখানে দেখছে বড় রকমের দুর্নীতি! তাদের মতে, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অযথা সময়ক্ষেপণের অভিযোগ শুধু মাত্র মুল ব্রিজের নয়, মুল ব্রিজের সাথে সংযুক্ত প্রকল্প গুলোরও। তারা ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্মিত সেতুগুলোর সাথে পদ্মাসেতুর নির্মাণ ব্যয়ের যে তুলনামূলক ফারাক দেখিয়েছেন তা তুঘলকি কর্মকান্ড বলেই মনে হয়। এছাড়াও তাদের অনেকেই পদ্মাসেতুর নির্মাণ ও উদ্বোধন নিয়ে নানা কর্মকান্ড ও প্রচারণাকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবেই দেখছেন। আশা করা যেতে পারে, সমালোচকদের এই অভিযোগগুলির নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গতঃ জবাব দেবেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। আমাদের দেশে যে কোন সরকারী প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ যেন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হযেছে। উন্নয়ন আর দুর্নীতি দুটোই যেন হাত ধরে চলছে। অন্ততঃ দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের এমনটাই ধারণা। সরকারের উপরের মহল যতই বলুক দুর্ণীতি হয়নি, মানুষ সেটা বিশ্বাস করে বলে মনে হয়না। পদ্মাসেতু আমাদের স্বাধীনতা উত্তর সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা আর সক্ষমতা অর্জন হলো, তা কাজে লাগিয়ে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে এরকম আরো অনেক প্রকল্প নির্মিত হবে। তবে ভবিষ্যতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা রক্ষা করা না যায়, সরকার যতই বাগাড়ম্বর করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করুক না কেন, ‘দুর্জন’রা কিন্তু অভিযোগের তীর ছুড়তেই থাকবে। আর সাধারণ মানুষও কোন রকম প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগগুলো সত্য বলেই জানবে।

পরিশেষে বলতে চাই, পদ্মা সেতু আমাদের বিশ্বাস আর আস্থার প্রতীক। এ সফলতার উপর ভর করে বাংলাদেশ আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। এমন সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জানাই সমগ্র দেশবাসীর পক্ষ থেকে জানাই অভিনন্দন।