বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫০)

– বিজন সাহা

জুনের তৃতীয় রবিবার মহা উদ্দীপনার সাথে আন্তর্জাতিক বাবা দিবস পালিত হল। ফেসবুক ছেয়ে গেল স্মৃতি রোমন্থনে। চারিদিকে বাবাদের প্রতি উপচে পড়া ভালবাসার গল্প। কিন্তু এত ভালবাসার মধ্যেও দেখা যায় দুঃখের কাহিনী। কেন? আসলে একজনের জয় মানেই তো কারও না কারও পরাজয়। তাই আপনার রাস্তায় যখন বিজয় মিছিল কোন না কোন রাস্তায় তখন কান্নার রোল। এটা তো নতুন কিছু নয়। সেদিক থেকে সার্বজনীন উৎসব বলে কিছু নেই। আমরা যখন বলি ধর্ম যার যার উৎসব সবার – এটাও একটা ভুল ধারণা। কারণ কোন উপাসনালয় থেকে বেরিয়ে যখন কেউ বা কারা অন্য ধর্মের কাউকে আক্রমণ করে, তার ঘর বাড়ি পোড়ায় বা হত্যা করে, তখন সেই ধর্মের কোন উৎসবই এই ভুক্তভোগীর জন্য উৎসব হতে পারে না। তাই বাবা দিবসের উৎসব অনেকের জন্য কষ্টের স্মৃতি নিয়ে আসবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

আমাদের ছোটবেলায় বাবা দিবস বলে কিছু ছিল না, ছিল না মা দিবস। তার মানে এই নয় তখন আমরা বাবা মাকে কম ভালবাসতাম বা তাঁরা আমাদের জন্য কম কিছু করতেন। তবে যুগের সাথে সব কিছুই বদলায়। বদলায় আমাদের ভালবাসা প্রকাশের ভাষা বা রীতি। আসলে এটা আর কিছুই নয়, এটা স্রেফ মার্কেটিং। আমাদের ছোটবেলায় ঈদ আর পূজার বাইরে নতুন জামাকাপড় উপহার দেবার চল ছিল না বললেই চলে। একুশ আমরা পালন করতাম খালি পায়ে কালো ব্যাজ লাগিয়ে। নববর্ষে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে বাড়ি বাড়ি যেতাম কুশল বিনিময় করতে। কিন্তু আজকাল একুশ আর নববর্ষেও নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে বাজারে আসে হরেক রকম জামাকাপড়। ব্যাপারটা ভালো বা মন্দের প্রশ্ন নয়। এসব একুশ বা নববর্ষকে কেন্দ্র করে হলেও পিওর বাণিজ্যিক চাল। এটা বলতে পারেন ভোগবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অপরিহার্য উপকরণ ঠিক যেমনটা বাবা দিবস সহ বিভিন্ন দিবস।

কয়েক বছর আগে যখন ফেসবুকে বাবা দিবসের হিড়িক লাগে তখন একটু বিরক্ত লাগত। কারণ আমার মনে হত বাবামাকে প্রতিদিনই ভালবাসতে হয়, ঘটা করে একটা দিন ধার্য করে ভালবাসা প্রকাশের কিছুই নেই। তারপর মনে হল এ রকম একটা দিন থাকলে অসুবিধা কোথায়? আমরা অনেকেই তো মুখ খুলে ভালবাসার কথা বলতে পারি না। যদি এই উপলক্ষ্যে দুটো কথা বলতে পারি নিজেরদের প্রিয়জনদের তবে সমস্যার কি আছে? যদিও আমার ধারণা আমরা সবাই এটা অন্তর থেকে করি না। আমাদের দেশে যেমন কিছু কিছু মানুষ এক কেজি চাল দান করতে যায় দশ জনে মিলে আর সে জন্যে সাথে নিয়ে যায় বিশ জন ফটোগ্রাফার একই রকম অনেকের জন্যে এসব যত না বাবা মাকে শ্রদ্ধা জানানো তার চেয়ে বেশি এই উপলক্ষ্যে অন্যের চোখে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এসব দিবস অনেকের জন্য পিআর অ্যাক্ট। তবে যে যে জন্যেই করুক না কেন তারপরেও যদি একজন ক্ষুধার্ত মানুষ দিনের শেষে হাতে এক কেজি চাল পায় সেটা আমাদের কাছে যতটাই দৃষ্টিকটু মনে হোক না কেন সেই লোকটার জন্য অনেক কিছু। একই কথা বলা চলে এসব দিবস সম্পর্কে।

কিন্তু বাবাকে ভালোবাসা জানানোর এই দিন সবার জন্য যে আনন্দ নিয়ে আসে তা তো নয়। এক বন্ধু যার বাবা একাত্তরে নিখোঁজ হয়ে গেছেন লিখেছে ছোটবেলায় সে হাতটা এমন ভাবে মুঠো করে হাঁটত যেন সে তার বাবার হাত ধরে যাচ্ছে, কিন্তু সেই অশরীরী বাবার দেখা সে আর কোনদিন পায়নি। সে সময় বাবা দিবস বলে কিছু ছিল না, থাকলে হয়তো অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে এই দিন হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য তার মন আরও বেশি খারাপ হত। এই পথ চলায় সে একা নয়। আমার বন্ধুদের মাঝে এমন অনেকেই আছে যারা ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। হয়তো এরা সবাই একই রকম অনুভব করে। আবার অনেকেই আছে যারা নিজেরা বাবাকে হারিয়ে আজীবন বাবার অপেক্ষায় বসে ছিল, বসে আছে অথচ তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্য বাবার অভাব পূর্ণ করতে পারেনি। কাউকে কাউকে বলতে শুনি তারা জানেনা তাদের সন্তানরা বাবা দিবসে বাবাকে স্মরণ করে কিনা। নিশ্চয়ই করে। রুশ দেশে অসম্পূর্ণ পরিবার বলে একটা ধারণা আছে। যদি পরিবারে বাবা বা মা না থাকে তাদের এমন বলা হয়। আবার সিঙ্গেল মাদার ও সিঙ্গেল ফাদার বলেও একটা ধারণা আছে। এ দেশে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর সন্তানদের সাধারণত মায়ের সাথেই রাখে। আমার বন্ধুদের মধ্যে এরকম লোকের সংখ্যা অনেক যারা মায়ের সাথে বড় হয়েছে। খেয়াল করেছি যেসব পরিবারে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পরেও সন্তানদের বাবা বা মায়ের সাথে অবাধে মেলামেশা করতে দেয়, ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে দু’ পক্ষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার কারণে মানসিক আঘাতটা অপেক্ষাকৃত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যখন বাবা বা মা  ছেলেমেয়েদের মা বা বাবা সম্পর্কে খারাপ কথা বলে তখন সন্তানরা মানসিক কষ্টে ভুগে। সারত্রে বলেছেন বাবা মা আর ভাইবোনদের আমরা বেঁছে নিতে পারি না, এর উপর আমাদের হাত নেই। ভালো লাগুক আর নাই লাগুক বাবা মা আর ভাইবোনরা সেটাই থেকে যাবে। দ্বিজেন কাকু বলতেন পৃথিবীতে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। কেউ কাউকে চেনে না, জানে না – তারপরেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে, একে অন্যের সবচেয়ে আপন মানুষ হয়। তবে সব সময় যে হয় তা কিন্তু নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যদিও বাবা মা আর ভাইবোন আমরা বেঁছে নিতে পারি না, স্বামী, স্ত্রী বা বন্ধু আমরা নিজেরা বেঁছে নেই, সেটা করি সচেতন ভাবে। আর সেটা করতে গিয়ে আমরা যদি ভুল করি তার দায়িত্ব আমাদের। সেজন্যে সন্তান কেন কষ্ট পাবে? তবে যেটা খেয়াল করেছি তা হল যদি বাবা বা মা যার সাথে সন্তান থাকে সে যদি অন্য পক্ষের সাথে ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় বাধা সৃষ্টি করে জীবনের এক পর্যায়ে এসে সন্তানরা যারা এই বাধা সৃষ্টি করে তাদেরই দোষারোপ করে। এটা আমি জানি যেমন অনেক বন্ধুদের, যারা নিজেরা মায়ের সাথে বা মায়ের নতুন পরিবারে বড় হয়েছে, তেমনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।

বেশ কয়েক বছর আগে এরকম এক সন্তানের বাবা দিবসের পোস্ট চোখে পড়েছিল। সেখানে দেখেছি বাবার জন্য তার আকুতি। যদিও আজকাল আমরা অনেকেই ভালো ভালো টেক্সট কপি পেস্ট করি, তা সে বাবা দিবসে হোক, কারও জন্মদিনে হোক আর বিবাহ বার্ষিকীতে হোক (এটা মনে হয় দেশে বর্ষাকাল বা অন্যান্য রচনা মুখস্ত করে লিখতে লিখতে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে – তাই কোন কিছুই আর নিজের ভাষায় লিখতে পারি না, ভালো লেখা কপি করি) তবে সেটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল এটা তার নিজেরই কথা। সে এমন এক মায়ের সন্তান যে নিজেও সারাজীবন বাবার অভাব সাথে করেই ঘুরে বেড়িয়েছে, বাবা না থাকার বেদনা সে ভালোভাবেই জানে। তারপরেও সে কিন্তু নিজের সন্তানদের জন্য বাবার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি, সে নিজে যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে নিজের সন্তানদের সেই কষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আর একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে এটা নিশ্চয়ই এক রকমের ব্যর্থতা।

অনেককেই বলতে শুনি সবার বাবাই যদি এত ভালো মানুষ তাহলে ঘুষ খায় কার বাবা, দুর্নীতি করেই কার বাবা। বাবা মা ভাই-বোন আমরা বেছে নিতে পারিনা, জন্ম সূত্রে পাই। ব্যক্তি জীবনে যাই হোক না কেন সন্তানের কাছে সে বাবাই থেকে যায়। সন্তান বাবাকে ভালোবাসে বাবা ভালো মানুষ, বড় অফিসার, বড় নেতা বা অন্য কোন কারণে নয়, সে বাবা বলে। কয়েক দিন আগে রুশ টিভিতে ভ্লাদিমির ঝিরিনভস্কির উপর একটা ডকুমেন্টারি দেখাল। এটা ছিল তার সন্তানদের জবানবন্দী। ঝিরিনভস্কি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনীতি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলে প্রথম রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সেই সময় থেকে গত এপ্রিলে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। এক সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা থেকে সরে যান। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ। যাহোক তিনি তার বাবাকে কখনই দেখেননি। ৩৭ বছর বয়সে  জানতে পারেন কে তার বাবা আর ৬২ বছর বয়সে প্রথম তার সমাধিতে ফুল দেন ইসরাইলে। যে বাবা তার জন্য কিছুই করেননি তার জন্যও তার কত হাহাকার। কীভাবে তিনি দিনের পর দিন বাবার অপেক্ষা করতেন সেটা বলতে গিয়ে একজন ঝানু রাজনীতিবিদ হয়েও চোখের জল সামলাতে পারলেন না। তাই বাবা ভাল না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর যদিও দায়িত্বহীন নিষ্ঠুর বাবাও বিরল নয়। একই কথা মা বা অন্যান্য রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের ক্ষেত্রেও। ভাল হোক মন্দ হোক এরা আছেন এবং এই সম্পর্ক কোন ভাবেই ছিন্ন করা যাবে না। তাই একজন বাইরের লোক হিসেবে আমরা কাউকে যেভাবে বিচার করব সন্তান ঠিক একই মাপকাঠিতে সেই লোককে বিচার করবে এটা আশা করা যায় না। সম্পর্ক মানেই আবেগ। বিভিন্ন সিরিয়াল খুনীদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তারা প্রায় সবাই খুব ভাল স্বামী ও বাবা। যে আমেরিকা বিশ্বের যেকোনো স্থানে তার নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সদা ব্যস্ত সেই আমেরিকাই অনায়াসে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়ার লাখ লাখ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।

বাবা দিবস আর মা দিবসের পাশাপাশি অনেকেই সিঙ্গল মাদার দিবসের ডাক দিচ্ছে। হতেই পারে। তবে দিনের শেষ এ সবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আসল সমস্যা থেকে ভুলিয়ে রাখার চাল। এক সময় আমরা ভাত কাপড় জমি কাজের জন্য চায়ের দোকানে বিপ্লব করতাম, কখনও কখনও মিটিং মিছিল করতাম। আজ আমরাই বাবা দিবস, মা দিবস, এই দিবস, সেই দিবস নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখি। বিভিন্ন ধরণের মাইনোরিটি ও নারীর অধিকার বঞ্চনার পেছনে আছে শোষণ। কৃষক, শ্রমিক যারা নিজেরাও কারও না কারও বাবা বা মা, তাদের দুর্দশার প্রছনেও আছে শোষণ। সমাজে সমস্ত রকমের অসাম্য, তা সে ধর্মীয় হোক, অর্থনৈতিক হোক, জাতিগত হোক – এসবের পেছনেও আছে ওই শোষণ। একমাত্র শোষণ মুক্ত সমাজই সার্বিক ভাবে সব ধরণের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর এসব খণ্ড খণ্ড আন্দোলন তা সে মীটু হোক, পরিবেশ আন্দোলন আর যাই হোক – এ সবই আসলে আসল লড়াই থেকে সরিয়ে আনার এক ধরণের পুঁজিবাদী ফন্দি। বিশেষ করে এসব আন্দোলনের স্পন্সরদের দিকে তাকালে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া