মতামত

শিশুশ্রম নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ চাই

আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সের ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিবর্গকে শিশু হিসাবে গণ্য করা হয়। আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুযায়ী ১৫ বছরের নিচে মানব সন্তানকে শিশু বলা হয় তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ১৮ বছরের নিচের বয়সের ছেলে মেয়েদেরকেও শিশু বলা হয়। বাংলাদেশের শিশু আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইনে শিশুর বয়স সর্বোচ্চ ১২ বছর ধরা হয়েছে। আবার বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২(৬৩) ধারায় উল্লেখ আছে, চৌদ্দ বছর পূর্ণ করে নাই এমন ব্যক্তিই হচ্ছে শিশু। তাই শিশুর বয়স নির্ধারনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গড়মিল পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে শিশুর সংজ্ঞা নির্ধারনে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সীর মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৫ লক্ষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশী শিশু। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের উপর ভর করে তৈরি হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের  এক গবেষণার তথ্য মতে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ এখনও দরিদ্র। যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। এই সকল দারিদ্র পীড়িত পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুরা জন্মের পর থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায় বাংলাদেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশু শ্রমের আওতায় পড়েছে। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। এসব শিশুদের মাত্র ৬ দশমিক ৭ ভাগ শিশু প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এবং ৯৩ দশমিক ৩ ভাগ শিশু অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শ্রম দিচ্ছে।  শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। চরম অর্থনৈতিক দূর অবস্থার শিকার দারিদ্র পীড়িত গরীব দূখী পরিবারের সন্তানেরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের অন্ন সংস্থানের জন্য কাজের সন্ধানে নামতে বাধ্য হয়। যে বয়সে সহপাঠীদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় আর বিদ্যালয়ে বই নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করার কথা সে বয়সে তাকে চিন্তা করতে হয় জীবন জীবিকার। শিশু শ্রমিকেরা কেবল তাদের আনন্দময় শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কর্মক্ষেত্রে অমানবিক আচরন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশ প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক দূরাবস্থা, দেশের শ্রম বাজারে শিশু শ্রম যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারন হলেও একমাত্র কারন নয়। আমাদের পোশাক শিল্প সেক্টর তার বলিষ্ট উদাহরন। কেননা এই সেক্টরে ১৫/১৬ বছর পূর্বেও ব্যাপকভাবে শিশু শ্রমিক দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমানে এই সেক্টরে শিশু শ্রমিক নাই বললেই চলে।(অবশ্য কিছু সাব কন্ট্রাক্ট কারখানা বাদে) তাহলে প্রশ্ন জাগে দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার উপর দাঁড়িয়ে পোশাক শিল্প খাত কিভাবে শিশুশ্রম মুক্ত হল।

এর কারন উদঘাটন করতে গেলে আমাদের প্রথমে শিল্প সম্পর্ক এবং শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ও ক্রিয়াশীল পক্ষ সমূহের ভূমিকা কি তা অনুধাবন করা জরুরি। আমরা সবাই জানি যে, এদেশের পোশাক শিল্প খাত বৈশ্বিক ক্রেতা নিয়ন্ত্রিত শিল্প হওয়ায় এবং শিশু শ্রমের ব্যাপারে তাদের অনমনীয় মনোভাবের কারনেই আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের মালিকেরা তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিশু শ্রমিক বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)এর এক তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪৭ ধরনের কর্মকান্ডে শিশু শ্রমিক যুক্ত রয়েছে। যার মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজ ঝুকিপূর্ণ এবং ১৩ ধরণের কাজ মারাত্মক বা খারাপ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ। আইএলও কনভশন ১৮২তে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই কনভেশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র শিশুশ্রম নিরসনের ব্যাপারে এক মত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা লক্ষ করি জাতি সংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)তে শিশু শ্রম নিরসনের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ এসডিজি এর সাথে সংগতি রেখে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সকল ধরণের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ নির্ধারন করেছিল। তবে করোনা মহামারির কারনে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। আমরা প্রত্যাশা করবো, সরকার তার লক্ষ্য পূরনে নতুন করে পরিকল্পনা সাজিয়ে তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

শিশু শ্রম দূর করার লক্ষে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান করে ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি, বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে প্রত্যেক বিভাগে বিভাগীয় চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি, জেলা প্রশাসককে প্রধান করে প্রত্যেক জেলায় জেলা শিশু অধিকার  ফোরাম এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রধান করে প্রত্যেক উপজেলায় উপজেলা চাইল্ড লেবার মনিটরিং কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু এখানে প্রত্যেক কমিটির প্রধানগণ আরো একাধিক কমিটির প্রধান হওয়ায় তাদের পক্ষে শিশু শ্রমের ব্যাপারে আলাদা করে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা বলেই মনে হয়। যার ফলশ্রুতিতে কমিটিগুলো অনেকটা কাগুজে কমিটিতে পরিণত হয়েছে। তাই এখনো পর্যন্ত শিশু শ্রম নিরসনের ব্যাপারে তেমন কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। এখানে বিশেষভাবে লক্ষনীয় ব্যাপার হচ্ছে, উপরোক্ত কোন কমিটিতে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি রাখা হয়নি। যার ফলে কমিটিগুলো প্রতিনিধিত্বমূলক হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে।

আমাদের দেশে সরকার অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই বিতরন এবং বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষা চালু রেখে শিক্ষার হার বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন হয় শিশুর দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা, তাহলেই কেবল দেশের শিক্ষার হার বাড়লে শিশু শ্রম কমবে অন্যথায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। ফলে উপরোক্ত কর্মসূচীসমূহ চালু রাখার পাশাপাশি শ্রমবাজারে শিশু শ্রম যুক্ত হওয়ার অন্যান্য কারনগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাস্তব সম্মত ও যুগোপযোগি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিতি শিশু যেন শোষনহীন-বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। প্রত্যেক শিশুকে গড়ে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব তার পরিবারের। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় কোন পরিবার যদি শিশুর দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিশুর প্রতি রাষ্ট্রের এমনই দায়িত্ববোধ থাকা বাঞ্চনীয়।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি