বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৯)

-বিজন সাহা

অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে ১৯৯১ সালে ইউক্রেনের জনগণ ভোট দিয়েই তো স্বাধীন হয়েছে। তাহলে? কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়। শুধু তাই নয় ৮৪% ইউক্রেনের জনগণ এতে অংশ নেয় আর তার ৯০% স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। শুধুমাত্র ক্রিমিয়া আর সেভাস্তোপোলে যথাক্রমে ৬৭.৫% ও ৬৩% ভোট দান করে আর ৫৪% ও ৫৭% স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। এখন কথা হল মানুষ ভোট দেয় এক উদ্দেশ্যে আর ক্ষমতাসীনরা সেটাকে কার্যকরী করে অন্য ভাবে। মনে আছে ভারত বিভাগের কথা? বাংলার মানুষই ভোট দিয়ে পাকিস্তানের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে আর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বাধ্য হয় পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরোধিতা করতে। যদি আমাদের অধিকার থাকে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ করার তাহলে ক্রিমিয়া বা দনবাসের কেন সেই অধিকার থাকবে না? সমস্যা হল রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে প্রায়ই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, রঙিন স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু ভোট শেষে মানুষের কথা ভুলে যায়। আমার মনে পড়ে ভোটের পরবর্তী সময়ের কথা। শুধু টিভি দেখে নয়, কিছুদিন পরে আমরা অনেকে মিলে ক্রিমিয়ায় যাই। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে না আর সব আগের মতই থাকবে। জিন্নাহ যেমন বলেছিলেন ভারত আর পাকিস্তান হবে সবচেয়ে ভ্রাতৃসুলভ দুই দেশ। এখানেও তাই ছিল। সোভিয়েত আমলে যখন ধর্ম সমাজে বলতে গেলে ছিলই না আর অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করত আন্তর্জাতিকতাবাদে তখন কত যে মিশ্র পরিবার গড়ে উঠেছে তার হিসাব কে রাখে। শুধু একটা জিনিস সোভিয়েত ইউনিয়ন করেনি, তা হল পাসপোর্টে জাতীয়তা উঠিয়ে সোভিয়েত লেখা যেটা সমস্ত বিশ্বেই গৃহীত। ভারতে সবাই ইন্ডিয়ান লেখে, আমেরিকায় আমেরিকান। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে কেউ রুশ, কেউ ইউক্রেন, কেউ বেলারুশ, তাতার, উজবেক, কাজাখ ইত্যাদি। ফলে সবাই বা অধিকাংশ মানুষ নিজেদের সোভিয়েত নাগরিক মনে করলেও কাগজে কলমে তারা ছিল ভিন্ন আর এটা প্রায়ই তারা করত যতটা না জাতীয় চরিত্র থেকে তারচেয়ে বেশি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতে। এই ব্যবস্থা একদিকে যেমন ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে অন্যদিকে সত্যিকারের সোভিয়েত জাতি গঠনে বাধার সৃষ্টি করেছে। আমি বলব না যে সোভিয়েত ইউনিয়নে সোভিয়েত লিখলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হত, কারণ ভারতীয় লিখেও তামিল, বাঙালি, অহমীয়া, মারাঠি বা আমেরিকান লিখেও ইউরোপিয়ান, আফ্রো আমেরিকান, এশিয়ান, ল্যাটিনো এদের মধ্যে পার্থক্য একেবারে ঘুচিয়ে দেওয়া যায়নি। আচ্ছা ভারত ভাগ হয়েছে কতদিন হল? যারা এই রাজনৈতিক বিভক্তিতে গৃহহারা হয়েছে অথবা যাদের আত্মীয় স্বজন দুই দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা কি খুব সহজে এই বিভক্তি মেনে নিতে পেরেছে? মেনে নিয়েই মনে নিতে পেরেছে কি? কেন পারেনি? পারেনি এসব দেশের পরস্পরের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে। যদি দেশভাগের মধ্য দিয়েই ভাগটা শেষ হয়ে যেত মানুষ হয়তো আজ আর সেই দুঃখ বয়ে বেড়াতো না। কারণ সে চাইলেই প্রায় আগের মতই তাদের একক ইতিহাসের ঐতিহ্য উপভোগ করতে পারত। কিন্তু সেটা হয়নি রাজনৈতিক কারণে। বরং পারস্পরিক ঘৃণা তাদের আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আর তাই তো আজও আমরা দেখি উপমহাদেশের সব দেশেই সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন রকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, নিজ দেশেও তারা পরবাসীর মত জীবন যাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভাঙ্গে তখন কেউই ভারত বিভাগের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে হাজার হাজার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ততটা ক্ষতি করেনি যতটা করেছে বিভিন্ন দেশের রুশ বিরোধিতা। কারণ এতে রাতারাতি দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশ নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। বাল্টিকের দেশগুলোয় সেটা ব্যাপক আকার ধারণ করলেও ঠিক বিদ্রোহ যাকে বলে সেটা ঘটেনি, কিন্তু ইউক্রেনে ঘটেছে, কারণ আধুনিক ইউক্রেনের প্রায় অর্ধেক যাকে বলে আদি রুশ ভূমি আর সেখানকার মানুষ নিজেদের রুশ সংস্কৃতির বাইরে কল্পনা করতে পারে না, করে না। দেশ তো শুধু ভূমি নয়, দেশ সবার উপরে মানুষ, মানুষের ইতিহাস, মানুষের সংস্কৃতি। যে কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ পাকিস্তান হতে পারেনি, ঠিক একই কারণে দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেন সেই ইউক্রেন হতে পারেনি যেটা হতে চেয়েছে উত্তর পশ্চিম ইউক্রেন – মানে অ্যান্টিরুশ বা প্রোওয়েস্ট। যখনই সরকার জোর করে সেটা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে হয়েছে প্রতিবাদ, অস্ত্র হাতে মানুষ রাস্তায় নেমেছে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য। তাই মানুষের আবেগ, তাদের ঐতিহ্য, তাদের ইতিহাস বাদ দিয়ে শুধু ১৯৯১ সালের ভোটের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয়েছিল বলা মিথ্যা না হলেও আসল সত্যের বরখেলাপ। আর তাই বর্তমান ইউক্রেন সমস্যার উৎস রাশিয়ায় না খুঁজে কিয়েভে আর আরও সঠিক ভাবে বললে ওয়াশিংটনে খোঁজাই শ্রেয়। কেননা ওয়াশিংটনের জিওপলিটিক্সের শিকার হয়ে ইউক্রেন পরস্পর বিরোধী জনগণের দুই অংশের ভেতর সমঝোতা না খুঁজে দ্বন্দ্বের পথে গেছে আর এর ফলেই দেশের উপর নেমে এসেছে এই দুর্ভাগ্য। বাইরে থেকে গণতন্ত্র, মানবতা, স্বাধিকারের কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু নিজেরা ভুক্তভোগী না হলে এসব স্লোগানের মধ্যে কতটা সোনা আর কতটা খাঁদ সেটা বোঝা কঠিন।

আমরা প্রায়ই স্বাধীনতার কথা বলে গলা ফাটাই কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখি নিজেরা কতটুকু স্বাধীন?  স্বাধীনতা তো শুধু যা খুশি বা যেমন খুশি বলার অধিকার নয়, স্বাধীনতা – এটা জনগণের সত্য জানার অধিকারও বটে। একটা সময় ছিল পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থানকারী লোকজন তো বটেই আমি নিজেও রাশিয়ার তোলা অনেক অভিযোগ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতাম। সেটা বায়োলজিক্যাল ল্যাবই হোক অথবা অন্য কিছু। কিন্তু এখন তো সব বেরিয়ে আসছে। পশ্চিমা বিশ্ব নিজেরাই স্বীকার করছে ইউক্রেনে তাদের ৪৪ টা বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি থাকার কথা, ২০১৭ সাল থেকে ইউক্রেনে বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহের কথা। কিন্তু এতদিন তারা নিজ নিজ দেশের জনগণ তো বটেই সারা বিশ্বের মানুষকে মিথ্যা বলে এসেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য। এটা তারা করেছিল ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সময়ও। সেই মিথ্যা বলার অপরাধে কেউ কি শাস্তি পেয়েছে? এই যে লাখ লাখ নিরাপরাধ মানুষ প্রাণ হারাল ইরাক, আফগানিস্তানে এ জন্যে কি কেউ জবাবদিহি করেছে? নাকি জবাবদিহিতা শুধু তৃতীয় বিশ্ব বা আমেরিকান বলয়ের বাইরের দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য। দনবাসের মানুষদের হত্যার জন্য সে দেশের (মানি আর নাই মানি) আদালত যখন তিনজন ভাড়াটে সেনার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চারিদিকে মাবনতা গেল মানবতা গেল বলে চিৎকার শুরু হয়েছে, কিন্তু আমেরিকায় যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বা বিনা বিচারে বেন লাদেন, সাদ্দাম বা গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয় তখন তো কেউ মানবতার ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল মিটিং করে না। সমস্যা হল মানবতা, গণতন্ত্র এসব এখন দেবতা বা মহাপুরুষদের মত যারা নিজেরা আর নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। একদল মানুষের অধিকার আদায় বা রক্ষার জন্য আরেক দল মানুষের অধিকার হরণ করাই এখন মানবতাবাদীদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তুমি যদি সঠিক দলে নিজের নাম লেখাতে পার তাহলে সব কিছুতেই তোমার অধিকার আছে, কিন্তু সঠিক দলে না থাকলে তুমি তো মানবই নও। তখন মানবতার জন্য আবেদন তোমার সাজে না। আর তাই তো দেখি যখন মারিওপোলের ম্যাটারনিটি হাসপাতালে অসমর্থিত রুশ আক্রমণের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের আহাজারি দনেৎস্কের ম্যাটারনিটি হাসপাতালে ইউক্রেন সৈন্যদের আক্রমণের সংবাদ প্রকাশে তাদের অনীহা। কেন? কারণ এটা মানবতার কথা হলেও সেই মানবতা তাদের সমর্থন করে না, সাহায্য করে না তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে। বিচারের মূল কথা হল সবকিছু সমান দৃষ্টিতে দেখা। পক্ষাপাতিত্ব এড়ানোর জন্যই ন্যায় বিচারের দেবী থেমিস চোখ বেঁধে রাখে। কিন্তু আমরা কি সেটা পারি? পারি না। আর এর ফলেই জন্ম নেয় ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর সেখান থেকেই আসে যত রাজ্যের অসাম্য, আসে অনাচার। আর আমরা বার বার ক্ষমতাসীনদের মানবতার ডাকের ফাঁদে পা দিয়ে সুযোগ করে দিই আমাদের আরও আরও বেশি বোকা বানানোর, আমাদের আরও আরও বেশি করে শোষণের যাতা কলে পিষে মারার। কে দায়ী? আমরা। কারণ আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। আজ ওরা আমাদের কাছে ঈশ্বরের মতই সব প্রশ্নের, সব বিতর্কের অতীত। যেমন আমরা জনগণ, তেমনি আমাদের শাসক শ্রেণি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া