বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৮)

– বিজন সাহা

পদার্থবিজ্ঞানে কার্য কারণ বলে একটা কথা আছে যার অর্থ হল যেকোনো কিছুর পেছনেই কোন না কোন কারণ থাকে। অন্য ভাবে বললে আগে কর্ম তারপর ফল। সেই কারণ হতে পারে তাৎক্ষণিক কোন কিছু আবার হতে পারে সুদূর অতীতে কোথাও। যেমন ধরুন রোনালদো বা মেসি গোলে কিক করল, গোল হল। এখানে কিক কারণ, গোল ফল। এটা তাৎক্ষণিক। আবার এই যে রোনালদো বা মেসি এটা করতে পারল সেজন্যে তাদের সাধনা শুরু হয়েছে অনেক অনেক বছর আগে। এই পারদর্শিতার কারণ অনেক গভীরে প্রোথিত। এর আগে কোন এক সময় একটা গল্প বলেছিলাম। ১৯৯১ সালেই হবে হয়তো, পোল্যান্ড এমব্যাসিতে গেছি ভিসা ফর্ম জমা দিতে। খুব ভোর। লোকজন নেই। এরপর এল এক ছেলে। পাকিস্তানি। কথা হল। আরও কিছুক্ষণ পরে এক শিখের দেখা মিলল একটু দূরে আর পাকিস্তানি ছেলেটা হঠাৎ করে ওকে মারতে শুরু করল। আপাত দৃষ্টিতে কোনই কারণ নেই, কারণ এরা এক অন্যকে চেনে না। অন্তত ওদের কথাবার্তায় সেটাই বোঝা গেল। তাহলে? শিখ ছেলেটার দোষ ও ভারতীয়। এখন যদি কারণ খুঁজতে যাই ঠিক পেয়ে যাব। দ্বিজাতি তত্ত্ব, দেশভাগ, বিগত প্রায় ৪৫ বছর ধরে দু দেশের রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি যে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে তার ফল এই খণ্ড যুদ্ধ। কোন ঘটনাকে বুঝতে হলে তাই ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে, দেখতে হবে কী কী ঘটনা ঘটেছিল এসব দেশ বা জাতির মধ্যে নিকট ও সুদূর অতীতে।

আজকাল অনেকেই যখন ইউক্রেন ও রাশিয়া নিয়ে লেখে তারা ভুলে যায় অতীত কাহিনী, ভুলে যায় এই দুই দেশের বা দুই জাতির একদিকে ভ্রাতৃত্বের, অন্যদিকে বৈরিতার সম্পর্ক। প্রতিটি দেশ নিজ নিজ স্বার্থে এদের বন্ধুত্ব ও শত্রুতাকে কাজে লাগায়। ইংরেজ হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব ভারতীয়কেই অপছন্দ করত, তবে কখনও হিন্দুদের কখনও মুসলমানদের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু নিজের স্বার্থটাই তারা আদায় করেছে। এখনও সেই খেলার কোন পরিবর্তন হয়নি। তাই যারা পশ্চিমা ন্যারেটিভ শুনে কোন সিদ্ধান্তে আসতে চান তাদের ভুল করার সম্ভাবনাটা বেশি থাকে। এই যুদ্ধে যে রাশিয়া, ইউক্রেন আর ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এটা খোলা চোখেই বোঝা যায়। আপাত দৃষ্টিতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার জনগণও ইনফ্ল্যাশন, মূল্যবৃদ্ধি এসবের শিকার। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলেই এই দুটো দেশই তাদের অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়েছে, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সাময়িক ভাবে হলেও দূরে ঠেলে দিতে পেরেছে। কোন ঘটনা থেকে কে লাভবান হচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বুঝবেন ঘটনার হোতা কে?

আজ যখন বিশেষ করে ইউরোপের মানুষ ইউক্রেনের কথা বলে তখন তারা ১৯৯১ সালের সীমানায় গঠিত ইউক্রেনের কথাই বলে। ভুলে যায় পূর্ব ইতিহাস, ভুলে যায় জন্মের পর থেকেই এই দেশের দুই অংশের দ্বন্দ্ব। এরকম সমস্যা তো ইউক্রেনের একার নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ রকম সমস্যা ছিল বা আছে। পাকিস্তানের কথাই দেখুন। সেখানেও তো ভাষা নিয়ে শুরু হল পাকিস্তানের দুই অংশের লড়াই আর যার ফলে জন্ম নিল বাংলাদেশ। আর সেজন্যে প্রধানত দায়ী করা যায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। এই সমস্যা ক্যানাডায় ছিল ইংলিশ আর ফ্রেঞ্চ স্পিকিং কমিউনিটির মধ্যে। তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কম্প্রোমাইজে আসতে পেরেছে। সেটা ঘটেছে বেলজিয়ামে। তাহলে কেন ইউক্রেন সেটা পারল না, কেন রুশ ভাষাভাষীদের মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় মাতৃভাষার মর্যাদা দিল না? কেন গণতন্ত্রে আর মানব অধিকারে বিশ্বাসী ইউরোপ আমেরিকা নিজেরা যে পথে এই সমস্যার সমাধান করেছে সে পথে না গিয়ে দুই কমিউনিটিকে পরস্পরের মুখোমুখি দাড় করাল। কেন আজও বাল্টিক স্টেটগুলোর রুশ ভাষাভাষীরা মাতৃ ভাষায় পড়াশুনা করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়? যতদিন না আপনারা এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজবেন ততদিন পর্যন্ত মানবতার জন্য আপনাদের কান্না হবে কুম্ভীরাশ্রু।

অনেকেই বলতে চান যে রুশ তো কিয়েভ থেকেই শুরু হয়েছে। তাহলে কেন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অক্টোবর বিপ্লবের সময় থেকে ধরতে হবে? আমরা যদি ইতিহাস ঘাটি তাহলে দেখব কিয়েভের আগেই রিউরিক বংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল নভগোরাদে যা এখন ভেলিকি নভগোরাদ নামে পরিচিত। সেখান থেকেই বাণিজ্যিক ও সামরিক কারণে তারা কিয়েভ দখল করে আর সেখানেই রাজধানী স্থানান্তরিত করে। এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। দিল্লি অপেক্ষাকৃত বিপদজনক বলে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে দিল্লি থেকে রাজধানী দক্ষিণ পূর্বে সরিয়ে নিয়েছেন। সে সময় রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল জনমানবহীন। সেই কিয়েভেই এ দেশ খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়, পরে তাদের বংশধরেরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মস্কো সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান ইউক্রেনের এক বিস্তীর্ণ এলাকা মস্কোর দখলে আসে, গড়ে ওঠে নতুন নতুন জনপদ আর এসবে নেতৃত্ব দেয় কসাক বাহিনী। এরা আসলে রুশ যারা জারের অধীনে থাকতে চাইত না। এরাই  জারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করত। একসময় দু পক্ষই এক চুক্তিতে আসে যার ফলে কসাকরা বলতে গেলে স্বাধীনভাবে বাস করত আর প্রতিটি পরিবার এক বা একাধিক ছেলেকে জারের সৈন্য বাহিনীতে চাকরি করতে পাঠাত। পরবর্তীতে এরাই রুশ সাম্রাজ্য বিস্তারে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। খারকভ, ওদেসা,  জাপারঝিয়ে, নিকোলায়েভ, মারিওপলসহ দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেনের সমস্ত জনপদ আসলে রুশদের হাতেই গড়ে উঠেছে। কথা প্রসঙ্গে বলা যায় যে আলমা আতা যার প্রাচীন নাম ভেরনি, সেমিপালাতেনস্ক, নুর সুলতান এসব শহরও রুশদের গড়া। বিভিন্ন সময়ে যখন ছোট ছোট দেশ বিদেশী শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছে তারা রুশ জারের কাছে আশ্রয় ও নিরাপত্তা চেয়েছে ঠিক এখন যেমন অনেক দেশ ন্যাটোর কাছে নিরাপত্তা চায়। কাজাখস্তান, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এভাবেই যোগ দিয়েছে রুশ সাম্রাজ্যে। একই ঘটনা ঘটেছে বাল্টিকের দেশগুলোয়। তাই আজ যখন কাউকে কাউকে বলতে শুনি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রুশ ভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে তখন এদের ইতিহাস জ্ঞান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগে। যুদ্ধ কারও কাম্য নয় বিশেষ করে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। কিন্তু কখনও কখনও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করতে হয় যেমন করেছিল বাংলাদেশের মানুষ। দুঃখজনক হলেও সত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আগের মত কোন দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে শোষণ না করলেও শোষণের আদর্শ থেকে সরে দাঁড়ায় নাই। তারা এখন বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দেশের জনগণকে উস্কে দেয় পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করতে আর সেই সুযোগে নিজেরা আগের চেয়ে আরও নগ্ন ভাবে সেসব দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের উপর ইংল্যান্ড ও আমেরিকার হালচালের দিকে খেয়াল রাখলেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর ইউক্রেনের কথা তো বলাই বাহুল্য, কেন না সে দেশ অনেক বছর হয় বিদেশিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে রুশ দেশের জনসংখ্যা নিয়ে কটাক্ষ করে। এত বড় দেশ সেখানে মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন লোকের বাস। তাদের কিন্তু বলতে শুনি না আয়তনে রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র ৩৯ মিলিয়ন বা প্রায় কানাডার সমান দেশ অস্ট্রেলিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২৬.৫ মিলিয়ন? যদি রাশিয়াও এসব দেশের মত আমেরিকার অনুগত ভৃত্যের ভূমিকা পালন করত তাহলে হয়তো এরকম প্রশ্ন আসত না। পাড়ার সবচেয়ে বিজ্ঞ মানুষ যে তার কথা শোনে না বা অবাধ্য তাকে শাস্তি দিতে উদ্যোগী হন না, কারণ তিনি জানেন সবাইকে যে তার সাথে এক মত হতে হবে এমন কোন কথা নেই, কিন্তু পাড়ার মাস্তান সেটা জানে না বা মানে না। যে কেউ অবাধ্য বা স্বাধীনচেতা হলে তার গায়ে আগুন লাগে। সে তখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে ওঠে। অন্যদের বদলানোর আগে নিজেকে বদলান, নিজেদের আগ্রাসী মনোভাব বদলান। পৃথিবী আর আগের মত নেই। পৃথিবী বদলে গেছে।

যখন ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে চেয়েছিল তাদের ধারণা ছিল একদিনে জীবন বদলে যাবে, বাড়বে মানুষের বেতন, উন্নত হবে জীবনযাত্রার মান। দুর্নীতি, জাতীয়তাবাদ এসব নিয়ে কি ভেবেছিল সেটা জানা নেই। আর তাই হয়তো ইউরোপ বার বার বলেছে প্রবেশপত্র পাবার আগেই তাদের নিজের থেকেই দুর্নীতি দূর করতে হবে, দূর করতে হবে জাতিগত সমস্যা কেননা ইউরোপ মানবতাবাদে বিশ্বাস করে, মানুষকে সবার উপরে স্থান দেয়। ইউক্রেনকে লিগ্যাল ভিসা দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাই সে এসেছে শরণার্থীর বেশে। এখন তারাই দেশে দেশে তাদের নিয়ম চালু করছে, তারাই বলছে ইউরোপে কোন মিউজিক বাজবে, কোন বই পড়া হবে। ইউরোপে এখন চলছে রুশ বয়কটের প্রবল হাওয়া। ইউক্রেনকে ইউরোপের অংশ করতে পারেনি তারা, কিন্তু নিজেরাই পরিণত হয়েছে ইউক্রেনের কালচারাল কলোনিতে। ক্রোধ শুনেছি মানুষকে অন্ধ করে। ইউরোপ, আমেরিকা তাহলে কি অন্ধ? রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গিয়ে তারা শুধু নিজ নিজ দেশের জনগণকে অর্থনৈতিকভাবেই বেকায়দায় ফেলেনি, যে মানবিক মূল্যবোধগুলো তারা এত দিন লালন করত সেসবই একে একে বিসর্জন দিচ্ছে। গতকাল বন্ধু সুরার সাথে দেখা। আলেক্সান্দর মোতাভিলভ – নামকরা পদার্থবিদ।

প্রিভিয়েত সুরা, কেমন আছ?
এই তো চলছে।
যাচ্ছ কোথাও এ গ্রীষ্মে?
পোল্যান্ডে একটা কনফারেন্সে আবেদন করেছিলাম। লিখল আমি যেহেতু রাশিয়ায় কাজ করি তাই আমাকে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না। এতদিন জানতাম পদার্থবিদ্যা স্থান-কালের গন্ডী মানে না। এখন দেখছি রাজনীতি এখানেও বিভেদের দেয়াল তুলেছে – নতুন বার্লিন ওয়াল। যাক। যুদ্ধে জয়ী হই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

যুদ্ধে কে জয়ী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে তবে তবে ইউরোপ, আমেরিকা যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে ইতিমধ্যেই হেরে গেছে তাতে কি সন্দেহ আছে?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া