মতামত

প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান – মহিউদ্দিন আহমদ

-লেখক ও বইয়ের বইয়ের রাজনৈতিক পর্যালোচনা

– অপু সারোয়ার

জাসদ নানা কারণে আলোচনার উৎস মুখ।  জাসদ রাজনীতির প্রথম প্রজন্মের গড় বয়স ৭০ বছর ছুঁই ছুঁই। জাসদ রাজনীতি কোন সফলতার মুখ দেখে নাই। প্রধানত ভাঙ্গনের কারণে জাসদ রাজনীতির নেতা কর্মীরা রাজনৈতিক ভাবে নিষ্ক্রিয়। অতি  অল্প সংখ্যক জাসদীয় ধারার নেতা -কর্মীরা জাসদের সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। বা জাসদ নামের দলের সাথে যুক্ত। জীবন যৌবন বাজী রেখে যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য সরব ছিলেন আজ তাঁদের অধিকাংশই নীরব , বিছিন্ন -বিভক্ত এবং রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক। রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে জাসদের হারিয়ে যাওয়া অপমানজনক রাজনৈতিক  পরাজয়। বিধ্বস্থ – পরাজিত মানুষদের কাছে অতীত স্মৃতি বেঁচে থাকার অবলম্বন।   জাসদের প্রথম কাতারের নেতারা কোন কিছুই লেখেন নাই। যাঁরা মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন তাঁদের না লেখার বিষয়টি হতাশার বিষয়। অন্যদিকে নিজেদের ইতিহাস লেখার অসমর্থতা চিন্তার দৈন্যতাকে সামনে নিয়ে আসে। জাসদ রাজনীতি নিয়ে কিছু কিছু লেখা হচ্ছে। জাসদ রাজনীতি নিয়ে বই পুস্তক – আলোচনার প্রধান -বাহক হচ্ছে রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক নিষ্ক্রিয় জাসদীয় ধারার নেতা কর্মীরা।

জাসদ নিয়ে লেখালেখির ধারায় জাসদ রাজনীতি নিয়ে লিখে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন  মহিউদ্দিন আহমদ। মহিউদ্দিন আহমদ মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক , লেখক ও গবেষক।  বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও আন্দোলন নিয়ে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। মহিউদ্দিন আহমদের বেশ কিছু বই  পুনর্মুদ্রিত ও আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে । জাসদ রাজনীতি নিয়ে লেখা জাসদের উত্থান : অস্থির সময়ের রাজনীতি ও  প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান বই দুইটি জাসদ ঘরনার পাঠকদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহিউদ্দিন আহমদ এর জাসদ রাজনীতির ইতিহাস বর্ণনা নিয়ে বেশ  কিছু মন্তব্য – বক্তব্য চোখে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনাগুলি  আবেগী , খুব বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক নয়।  তথ্য উপাত্তের জন্য  মহিউদ্দিন আহমেদের বই টিকে থাকার সম্ভবনা বেশী। মহিউদ্দিন আহমদের বইগুলি তথ্য উপাত্তের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার প্রধান কারণ জাসদ রাজনীতি নিয়ে বাজারে তেমন কোন বই নেই। লেখক – গবেষক জাসদ রাজনীতি সহ রাজনৈতিক সিরিজের বইগুলো লেখার পিছনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন  ” আদতে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, যিনি প্রথমারও কর্ণধার, আমাকে বইগুলো লিখতে উৎসাহিত করেন তিনি বললেন, বাংলাদেশে প্রধান প্রধান দলের ইতিহাস থাকা দরকার আপনি জাসদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাসদের একটা ইতিহাস লিখুন আমি লেখা শুরু করলাম বইটি পাঠকও লুফে নিলেন এরপর বললেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির ইতিহাসও লিখুন আমি আওয়ামী লীগ নিয়ে লেখা শুরু করলাম অনেক দূর এগোলামও একদিন তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ এখন থাক বিএনপির বইটিই আগে লিখুন এভাবে রাজনৈতিক সিরিজের বইগুলো লেখা হলো()  প্রথম আলো সম্পাদক ১৯৯০ পর্যন্ত সিপিবি -কমিউনিস্ট পার্টির উপর পর্যায়ের নেতা ছিলেন। একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টি পত্রিকা সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ ছিল ধূমকেতু। মস্কো- চীন পন্থী বামপন্থী দল গুলি ১৯৭২-১৯৮০ সাল পর্যন্ত জাসদের উত্থানকে মোকাবেলা করে রাজনীতি করতে হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কয়েক দশক পিছনের পরিচয় জানা থাকলে মহিউদ্দিন আহমদকে অনুপ্রাণিত করার কারণ কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। মহিউদ্দিন আহমদের লেখা থেকেই জানা যায় উৎসাহ দাতা মতিউর রহমান অতি অল্প  সময়ের মধ্যেই উৎসাহ দাতার ভূমিকা পরিবর্তন করে ফরমায়েশ – নির্দেশ দাতা হিসেবে দৃশ্যপটে হাজির হয়ে পড়েন। মতিউর রহমানের নির্দেশ দাতার ভূমিকাটা মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষায় জোরালো ভাবে ফুটে উঠেছে ” এরপর বললেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির ইতিহাসও লিখুন আমি আওয়ামী লীগ নিয়ে লেখা শুরু করলাম অনেক দূর এগোলামও একদিন তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ এখন থাক বিএনপির বইটিই আগে লিখুনবিএনপির বইটির লেখার সময় কাল আওয়ামীলীগের শাসনামল।

বই লেখা ও প্রকাশনা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। এই কাজের জন্য লেখক ও প্রকাশক উভয়ই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। নিজ উদ্দ্যোগে বই লেখা ও প্রকাশক বা অন্য কারো  ইচ্ছায় বইয়ের মধ্যে মৌলিক ও গুনগত পার্থক্য রয়েছে। “মজুরী দাস” শব্দটি প্রায়শই কার্ল মার্কস ব্যবহার করেছেন পুঁজি [ দাস ক্যাপিটাল ] বইয়ে। মার্ক্সের ভাষায় দাস [ slave – ক্রীতদাস ] বিক্রি হয় চিরতরে। শ্রমিক শ্রেণী [ কর্মজীবী মানুষ ] প্রতিদিন এবং ঘন্টায় নিজেকে বিক্রি করে । কবি সুকান্তের ভাষায় ” জীবনের সব রাত্রিকে ওরা [ মালিক শ্রেণী ] কিনেছে অল্প দামে” । আপাতঃ ভাবে ইচ্ছেমত চাকুরী বদলানোর পুঁজিবাদী প্রচার প্রোপাগান্ডা  কর্মজীবী মানুষের জীবনে পঙ্গুর গিরিলঙ্ঘনের শামিল। গার্মেন্টস শ্রমিক, শিক্ষক , সাংবাদিক জীবনের প্রয়োজনেই চাকুরী ছাড়ার স্বাধীনতা থাকলেও চাকুরী ধরে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বাধীন কিন্তু কাজে আটকে থাকার নামই   মজুরী দাস দাস। চাকুরী ছাড়া মানেই শুকিয়ে মরা। সমাজ ও রাষ্ট্র অনেক এগিয়েছে চাকুরী পরিবর্তনের স্বাধীনতা থাকার পরেও অধিকাংশ মানুষই মুজরী দাস।

একজন গার্মেন্টস শ্রমিক বা একজন সাংবাদিক বা এনজিও কর্মী বিভিন্ন মাত্রায় মুজরী দাস। একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের কাছে মজুরী দাসত্বের বিষয়টি বাঁচার প্রশ্ন। একজন সাংবাদিক -লেখকের জন্য মুজুরী দাসত্ব হচ্ছে ‘ প্রয়োজন ‘ মেটানোর সাথে জড়িয়ে আছে। মহিউদ্দিন আহমদ লেখা শুরু করেছিলেন আওয়ামীলীগ নিয়ে। প্রথমা প্রকাশনীর মালিক মতিউর রহমানের ‘ পরামর্শে’  লিখতে শুরু করলেন বিএনপি নিয়ে। অপছন্দ কিন্ত প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থ পাওয়া, কাজে আটকে থাকাই হচ্ছে  মজুরী দাসত্ব। ক্রীতদাসের মালিকেরা শক্তি প্রয়োগ করে দাসদেরকে বাধ্য করত কাজ করতে। পুঁজিবাদী সমাজে মুজুরী দাস মালিকেরা শক্তি প্রয়োগের পথে হাঁটেন না , তাঁরা পরাপর্শের  ফুলেল ডালা নিয়ে হাজির হয়ে কাজ করিয়ে নেন। মহিউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। কার্ল মার্ক্সের মজুরী দাসত্ব এর ধারণার সাথে অপরিচিত থাকার কথা নয়।

প্রথম আলোর কর্ণধার- মালিক মতিউর রহমান ও জাসদ ও প্রতি নায়ক এর লেখক -গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ দুই জনই দলত্যাগী বামপন্থী। লেখক মহিউদ্দিন আহমদের সাংবাদিকতা ও লেখক জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শুরু যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে। তবে জাসদ ও বিএনপি নিয়ে বই গুলি লেখা ১/১১ পরবর্তী আওয়ামীলীগের শাসনামলে। () প্রথম আলো পত্রিকা ১/১১ সরকারের সমর্থক ছিল। ১/১১ পরবর্তী সরকার হচ্ছে আওয়ামীলীগ সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রথম আলো পত্রিকার মধ্যে এক ধরণের শীতল যুদ্ধ বিরাজমান। এই স্নায়ু  যুদ্ধে প্রথমা প্রকাশনীর প্রাণবন্ত উপহার ছিল মহিউদ্দিন আহমদ এর জাসদ ও বিএনপি নিয়ে লেখা বই দুইটি। জাসদ ও বিএনপি নিয়ে আলোচনা সংকট থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে  আওয়ামীলীগকে সহায়তা করে থাকবে।

কোন মানুষই ভুলের উর্দ্ধে নয়। মহিউদ্দিন আহমদ ও ব্যাতিক্রম নয়। তবে তাঁর ভুল স্বীকার ও সংশোধণের প্রক্রিয়াটি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। মহিউদ্দিন আহমদ নিজের ভুল সম্পর্কে বক্তব্য হচ্ছে ” জাসদের বইয়ে যা হয়েছে, সিরাজুল আলম খানের প্রসঙ্গগুলো সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি তখনো সব কিছু আমার জানা ছিল না অনেক প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে গেছেন পরে আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে, অনুসন্ধান করে নতুন তথ্য পেয়েছি, যা আমি প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান বইয়ে যুক্ত করেছি () মহিউদ্দিন আহমদ একদিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন জাসদের উথান অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে কিছু ভুল বা অসঙ্গতি রয়েছে। তবে তিনি এই ভুল বা অসঙ্গতি গুলি যে বইয়ে ভুল আছে সেই বইয়ে সংশোধন না করে প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান বইয়ে যুক্ত করেছেন। জাসদের উত্থান পতন বইটি  প্রথম প্রকাশ ২০১৪ সালে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাত বার পুনমুদ্রিত হয়েছে।  ভবিষ্যতে পুনমুদ্রিত  হবার সম্ভবনা ব্যাপক। সংশোধনের প্রয়োজন জাসদের উত্থান বইটি। প্রতিনায়ক বইয়ে নতুন তথ্য সংযোজন বা অধিকতর নির্মোহ সমালোচনা সমস্যার সমাধান নয়। মহিউদ্দিন আহমদের সংশোধনীর স্টাইল নতুন করে গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করবে। একই সাথে বাজারে অসঙ্গতিপূর্ন জাসদের উত্থান পতন এবং লেখকের ভাষায় পরিশীলিত প্রতিনায়ক বইয়ে বিপণন বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তুলবে। শুধুমাত্র প্রতিনায়ক বই পড়ে বোঝার কোন উপায় নেই প্রতিনায়ক বইয়ের নতুন সংযোজনগুলি কি কি !

`প্রতিনায়ক` বইয়ের মুখ্য চরিত্র  সিরাজুল আলম খান। সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করেই লেখা। মহিউদ্দিন আহমদ সিরাজুল আলম খানের বিশ্বাসযোগ্যতার একমাত্র সূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছেন। মহিউদ্দিন আহমেদ লিখছেন “সিরাজুল আলম খান নিজে যেটুকু বলবেন বা অন্যকোনো চাক্ষুষ সাক্ষীর বয়ান থেকে যা জানা যাবে, সেটুকুই ইতিহাসের উপাদান হতে পারে। ”  ()  মহিউদ্দিন আহমেদের এই জাতীয় উপসংহার  প্রথাগত গবেষণা রীতি বিরুদ্ধ। শুধুমাত্র কেন সিরাজুল আলম খানকে একমাত্র নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হলো ? এই প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমেদ নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিহাসের  উপাদানের খোঁজে লেখক সিরাজুল আলম খান সহ বেশ কিছু  মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক । মোটামুটি সবাই নিজেকে বাঁচিয়ে নিজের সুবিধা মতো কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার ভিত্তিক আলোচানর নির্বাচিত অংশ বিভিন্ন বইয়ে স্থান পেয়েছে।  এই সব  ছেড়া – ছেড়া তথ্য থেকে  পাঠকের পক্ষে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারা দুরুহ। লেখক নিজেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেননি। লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বইটি সিরাজুল আলম খানের কথা বলার মঞ্চ। জাসদ রাজনীতির ভুল ভ্ৰান্তি থেকে জনাব খানকে দায়মুক্তি দেওয়ার কাজে লেখক ও সিরাজুল আলম খান যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

মুখ্য নায়কের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তি প্রতিনায়ক।  রামায়ণে রামের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব  দিয়েছিলেন রাবণ। প্রতিনায়ক হলেন  রাবণ । শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য সিরাজুল আলম খান প্রতিনায়ক হিসেবে দেখতে আগ্রহী মহিউদ্দিন আহমদ । তবে মহিউদ্দিন আহমদের লেখা থেকে জানা যায় সিরাজুল আলম খান প্রকাশ্যে জাসদ – বিদ্রোহীদের বুদ্ধিদাতা হলেও গোপনে শেখ মুজিবের সাথে সমঝোতা করতেন। প্রকাশ্য রাজনৈতিক সমঝোতা কোন অন্যায় নয়। গোপন রাজনৈতিক সমঝোতা বিশ্বাস ঘাতকতা । মহিউদ্দিন আহমদ প্রতিনায়ক বইয়ে একাধিকবার রামায়ণ পৌরাণিক কাহিনীর কথা উল্লেখ করেছেন। রামায়ণ থেকেই প্রতিনায়ক শব্দ চয়ন করে সিরাজুল আলম খানকে মহিমান্বিত করেছেন। রামায়নের রাবনের কোন গোপন আঁতাতের নজির নেই। রামায়ণে গোপন আঁতাতকারী হচ্ছে বিভীষণ। সেই হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদের বইটির যথার্থ নামকরণ হওয়া উচিত বিভীষণসিরাজুল আলম খান। রামায়ণ কাহিনীর বাংলাদেশীয় রাজনীতির সংস্করণ হচ্ছে বিভীষণ  – সিরাজুল আলম খান। যিনি জাসদের কর্মীদের সংঘাতের মধ্যে ঠেলে দিয়ে গোপনে শেখ মুজিবের সাথে আঁতাত করেছেন। একই সময়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। আর হাওয়া পরিবর্তনের জন্য ভারতে নিরুদ্দেশ হয়েছেন সিরাজুল আলম খান ।

মহিউদ্দিন আহমদ জাসদের জন্ম লগ্ন থেকেই জাসদের সাথে যুক্ত ছিলেন। জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার মাধ্যম ছিল জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠের সাংবাদিকতা। ১৯৭৬ সালে তিনি জাসদ রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার দাবী করেছেন বিবিসি – বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে। () ১৯৭৬ সালের কোন সময়ে তিনি জাসদ রাজনীতি থেকে খসে পড়েন সেই সময় কালের উল্লেখ মহিউদ্দিন আহমদের বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকার উল্লেখ নেই। তবে ১৯৭৬ সালে জাসদ রাজনীতির জন্য চরম ক্রান্তি কাল। গোপন সামরিক আদালতে কর্ণেল আবু তাহেরের ফাঁসি এবং ১৭ জন জাসদ নেতাদের  বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড জেল দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই।  রায়ের মাত্র চার দিন পরই ২১শে জুলাই কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। সারাদেশে বেশ কয়েক হাজার জাসদ নেতা কর্মী কারারুদ্ধ ছিল । ঠিক সেই বছরেই মহিউদ্দিন আহমদ জাসদ ছাড়লেন। জাসদের যৌবন জোয়ারের সময় ১৯৭২-১৯৭৫ জাসদের সাথে যুক্ত ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠ দিয়েই সাংবাদিকতার হাতে খড়ি ও বিকাশ। সেই জাসদের সবচেয়ে ক্রান্তিকালে দল ছেড়ে ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। জাসদের চরম ক্রান্তিকালে দলের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা পুরানো প্রবাদ কে মনে করিয়ে দেয় ” সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়। ”

বিবিসি – বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৭৬ সালে জাসদ রাজনীতির সাথে ছেদ ঘটানোর কথা উল্ল্যেখ করেছেন। তবে কথাটি দুমড়ানো সত্য। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মহিউদ্দিন আহমদ জাসদের গণকণ্ঠে কর্মরত ছিলেন এমন তথ্য নিজেই প্রতিনায়ক বইয়ে গর্বভরে উল্লেখ করেছেন। ()  মহিউদ্দিন আহমদের জাসদের রাজনীতির অংশ হিসেবেই গণকণ্ঠে কাজ করতেন। ১৯৮০ সালের ৮ সেপ্টম্বর গণকণ্ঠে মহিউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের মূল্যায়ণ প্রসঙ্গে উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদ এই উপসম্পাদকীয়কে জাসদের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীত হিসেবে উল্লেখ করেছেন । ()  গণকণ্ঠে শুরু থেকেই সম্পাদক ও উপর পর্যায়ে খ্যাতিমানদের মাথার উপর বসিয়ে পত্রিকা প্ৰকাশ করার প্রবণতা ছিল। শুরুতে আল মাহমুদ সম্পাদক ছিল। ১৯৭৪ সালে আল মাহমুদ গ্রেফতার হয়েছিল গণকণ্ঠের সাথে যুক্ত থাকার কারণে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সরকারের সাথে আপোষ  রফায় কারামুক্তি ও পুরস্কার স্বরূপ শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন । ১৯৮০ সালে  গণকণ্ঠ পুনঃপ্রকাশের সময় প্ৰাক্তন আমলা বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও ওয়াহিদুল হকের মত ২/৩ জন বাইরের লোক বসানো হলেও জাসদের সাংবাদিকরাই গণকণ্ঠের হাল ধরেছিল। মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি – বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার একপর্যায়ে বলেছেন  বিষয়টা যদি আমি ১৯৭৫, ৭৬ বা ৮০ সালে লিখতাম তাহলে হয়তো অন্যভাবে লিখতাম কারণ তখনো আমার গায়ে দলের গন্ধ ছিল()  মহিউদ্দিন আহমেদ যদি ১৯৭৬ সালে জাসদ কিংবা রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন তবে কিভাবে ১৯৮০ সালে ‘ গায়ে দলের গন্ধ ‘ থাকে ।১৯৭৬ কিংবা ১৯৮০ অবদি জাসদের সাথে মহিউদ্দিন আহমেদের যুক্ত থাকা বা না থাকা খুব বড় বিষয় নয়। তবে লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে লুকোচুরি বিবিসি- বাংলাকে সাক্ষাৎকারের মধ্যেই ফুটে উঠেছে। । আত্ম পরিচয়ের সংকট বৈকি। যিনি এত অতি সামান্য বিষয় নিয়ে সত্যকে দুমড়ানোর পথে পা বাড়িয়েছেন , তিনি পুরো বইয়ের ক্ষেত্রে কি করেছেন তা পর্যবেক্ষণের বিষয়।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখার জন্য অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেই সব সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ বইয়ে জুড়ে দিয়েছেন। কোন নীতিমালার ভিত্তিতে সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত বা অনির্বাচিত হলেন তার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা নীতিমালা মহিউদ্দিন আহমদের লেখায় নাই। মহিউদ্দিন আহমদ বা তাঁর অনুগামীরা লেখকের স্বাধীনতা দোহাই দিয়ে একপক্ষের মতামত ভিত্তিতে বই লেখার পক্ষে  দাঁড়াবেন। তবে মহিউদ্দিন আহমদের একচোখা নীতি প্রথম আলোর দৃষ্টি এড়ায় নাই।  প্রথম আলোর সাথে মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠছে। ” প্রথম আলো প্রশ্ন: এই সিরিজে আপনার প্রথম বই জাসদের উত্থানপতন নিয়ে বেশ আলোচনাসমালোচনা হয়েছে অনেকের অভিযোগআপনি সিরাজুল আলম খানের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন এবং কর্নেল তাহের তাঁদের অনুসারীদের (যাঁরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন) অবিচার করেছেন তাঁদের জাসদেবহিরাগত বলেছেন কী বলবেন?() গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোর প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেন নাই। মহিউদ্দিন আহমেদের উত্তরে যা বলেছেন তা অপ্রাসঙ্গিক ও প্রসঙ্গান্তর । গ্রাম বাংলার প্রবাদে যা ধান বানাতে শিবের গীত।  তবে মহিউদ্দিন আহমদ স্বীকার করেছেন ” সবকিছু আমার [ মহিউদ্দিন আহমদ ] জানা ছিল না।” (১০)

 

তথ্য সূত্র :

 

((১) মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকার : আমি পাঠককে ইতিহাসের গল্প বলেছি।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান, ২৯ অক্টোবর ২০২১।  প্রথম আলো।

(২) প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০২১। জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি – প্রথম প্রকাশ ২০১৪। প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান – প্রথম প্রকাশ ২০২১।

(৩) প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০২১।

(৪) বিবিসি -বাংলা – ৩০ অগাস্ট ২০১৭।  মহিউদ্দিন আহমদ সাক্ষাৎকার ‘আমার তথ্যগুলো তাদের বর্তমান নষ্ট করে দিচ্ছে’

(৫) প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান, পৃ.৩৩৭

৬) প্রতিনায়ক – পৃষ্ঠা ৩৯৬

(৭) প্রতিনায়ক – পৃষ্ঠা ৩৯৭-৩৯৮

(৮) বিবিসি -বাংলা – ৩০ অগাস্ট ২০১৭।  মহিউদ্দিন আহমদ সাক্ষাৎকার ‘আমার তথ্যগুলো তাদের বর্তমান নষ্ট করে দিচ্ছে’

(৯) মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকার -আমি পাঠককে ইতিহাসের গল্প বলেছি। ২৯ অক্টোবর ২০২১। প্রথম আলো

(১০) পূর্বোক্ত