স্বাস্থ্য

বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্বে ‘বড় বাধা’ সিজারিয়ান পদ্ধতি

বাংলাদেশের হাসপাতালে এখন শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি শিশু অস্ত্রোপচার অর্থাৎ সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে যা বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসার হাতিয়ারে পরণত হয়েছে৷

Deutschland Erlangen - Kaiserschnitt

প্রতীকী ছবি৷

অনেক নারীর জন্য এমন পদ্ধতি ফ্যাশনেও পরিণত হয়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা৷

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান পদ্ধতি নিরাপদ মাতৃত্বের পথে প্রধান বাধা৷

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসেবে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৫১ ভাগ শিশু সিজারের মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে৷ এরমধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারের হার ৮৩ শতাংশ, সরকারি হাসপাতালে ৩৫ শতাংশ আর এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে এ সংখ্যা ৩৯ শতাংশ৷

স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাতৃত্বকালীন নানা জটিলতার কারণে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিশুর জন্ম সিজারিয়ান পদ্ধতিতে হতে পারে৷ এই সংখ্যা এর বেশি হওয়া উচিত নয়৷

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আছমা খাতুন অরোরা বলেন, ‘‘বাস্তবে ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি সিজারিয়ান পদ্ধতির দরকার নেই৷ কিন্তু এখন ঢাকার বাইরেও সিজারের প্রবণতা বাড়ছে৷”

এর কারণ হিসেবে তিনি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে দায়ী করেন৷ ‘‘এটা করলে হাসপাতালগুলোর আয় বেশি হয়৷ এটাই আয়ের প্রধান খাতে পরিণত হচ্ছে৷’’

সেই সাথে অনেক পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক৷ তিনি বলেন, ‘‘গর্ভবতী মা ও পরিবারের মধ্যে এক ধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছে যে সিজারিয়ান পদ্ধতি নিরাপদ৷ কিন্তু অপ্রয়োজনে সিজার মায়ের মৃত্যুঝুঁকি এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়৷’’

অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার মায়ের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়: ডা. আছমা খাতুন অরোরা

কীভাবে সিজারিয়ান পদ্ধতি শারীরিক জটিলতার আশঙ্কা বাড়ায় সে বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘এটি শুধু একটি অপারেশন নয়৷ রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়৷ ফলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়৷ একবার সিজার করলে পরবর্তীতেও সিজার করতে হয়৷ অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়৷ প্রস্রাবের থলিও ফেটে যায়৷ অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে মাকে আর রক্ষা করা যায় না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘সিজার কমাতে  হলে সবাইকে সচেতন করতে হবে৷ আর এই সচেতনতা রোগী ও চিকৎসক সবার মাঝেই তৈরি হতে হবে৷

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে ৯০ শতাংশ শিশুরই জন্ম হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে৷ কিছু কিছু ক্লিনিকের মূল ব্যবসাই এটি৷ তাদের আয়ের ৯৫ শতাংশই আসে সন্তান জন্মদনের জন্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে৷

এদিকে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধ করতে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিল হাইকোর্ট৷ কিন্তু বাস্তবে তার কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না৷

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিজার বাড়ার পিছনে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছাড়াও এটা এখন অনেকের কাছে একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে৷ তারা মনে করছে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সিজার মায়ের শরীর এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্য ভালো৷ এই ভুল ধারণা দূর করতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘নিরাপদ মাতৃত্ব শুধু সন্তান প্রসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়৷ মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা- এই সবকিছুই এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত৷ মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতের ওপরই নির্ভর করে নবজাতকের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি৷’’

বাংলাদেশে এখনো শতকরা ৪৬.৪ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে৷ এদের বড় একটি অংশ চিকিৎসকের পরামর্শ নেন না৷ এই প্রবণতা গ্রামে বেশি৷ আর এখনো শতকরা ২০ শতাংশ প্রসব হয় অদক্ষদের হাতে৷ এটা নিরাপদ মাতৃত্বকে বাধাগ্রস্ত করে৷

ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘বিশেষ করে গ্রামে আর্থিক সংকট এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পর্যাপ্ত না থাকায় এটা হচ্ছে৷ ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও অনেকে অসচেতনতার অভাবে এটাকে গুরুত্ব দেন না৷ আর প্রশিক্ষিত ধাত্রীরও সংকট আছে বাংলাদেশে৷’’

সিজারিয়ান পদ্ধতি এখন অনেকের কাছে ফ্যাশন: ডা. কামরুল ইসলাম

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবকে সবচেয়ে নিরাপদ বিবেচনা করা হয়৷ তাই এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হবে যেতে’৷

ডা. কামরুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে সেবাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে৷ আর সেবাকেন্দ্রে মায়েরা যাতে যান তার জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে৷’’

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখন শতকরা ১.৬৩ ভাগ৷  গ্রামে এই হার বেশি, শতকরা ১.৭৮ ভাগ৷ আর শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ১৫টি৷

ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কিন্তু আরো উন্নতি করতে হলে মানসিকতা ও স্বাস্থ্যসুবিধা আরো সহজলভ্য করতে হবে৷ কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করতে হবে৷ আর মায়ের খাদ্য, পুষ্টি, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এগুলোর ওপর জোর দিতে হবে৷’’

আর ডা. আছমা খাতুন আরো বলেন, ‘‘অপ্রয়োজনীয় সিজার কমাতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আমরা প্রচার চালাচ্ছি৷ সচেতনতাও কিছুটা বাড়ছে৷ কিন্তু এরপরও রোগী ও তার পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে আমাদের যাওয়ার তো সুযোগ নেই৷ আমরা বুঝাতে পারি কিন্তু বাধ্য করতে পারি না৷’’

সূত্রঃ ডয়চে ভেলে