মতামত

রক্তের অক্ষরে লেখা শহীদ শাহাদাত দিবস

-আলেক্স আলীম

১৯৮৪ সালের ২৮ মে স্মৃতির পাতায় রক্তের অক্ষরে লেখা একটি বেদনাবিধুর দিন। এইদিনে চট্টগ্রাম কলেজের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসের ১৫ নং কক্ষে রাতের অন্ধকারে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহাদাত হোসেনকে ঘুমন্ত অবস্থায় জবাই করে হত্যা করে ছাত্র শিবিরের ঘাতকেরা।
সেদিন সকালেই ছিলো মেধাবী ছাত্র শাহাদাতের এইচ এস সি পদার্থ বিদ্যার ব্যবহারিক শেষ পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষার ক্ষণ আসার আগেই শাহাদাত লাশ হয়ে গেলো। শাহাদাত হোসেন এর অপরাধ ছিলো শাহাদাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতো। শাহাদাত বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজের কথা বলতো। সেই অপরাধের দায়ে খুনী ছাত্র শিবির ফজরের আযানের সময় গলায় ছুরি চালিয়ে শাহাদাত এর “মৃত্যুদণ্ড” কার্যকর করে।
এইচ এস সি পরীক্ষা শেষে ছাত্র ইউনিয়ন এর পক্ষ থেকে একদিন পর এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনার আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। আমি ২৭ তারিখ বিকেলে শাহাদাত এর কক্ষে গিয়েছিলাম সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে। ওকে না পেয়ে আমন্ত্রণ পত্র ওর টেবিলে রেখে এসেছিলাম।
শাহাদাতকে হত্যার পর চট্টগ্রামে ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠে।
উল্লেখ্য এর পূর্বে প্রকাশ্য দিবালোকে সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা তোবারককে নৃশংস ভাবে খুন করে। তখন আমি নিজে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত। আমাদের চোখের সামনেই তোবারককে হত্যা করা হয়। তোবারক মাটিতে শোয়ানো অবস্থায় তৃষ্ণাকাতর হয়ে পানি চাইলে তাকে পেশাব করে খাওয়ানো হয়। আমরা ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখছিলাম বোটানি বিল্ডিংয়ের তিন তলা থেকে দেখছিলাম শিবির নেতা জাহাঙ্গীর কাশেম রক্তমাখা হাত উঁচিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। সেই রক্ত ছিলো শহীদ তোবারকের।
কয়েক বছর পরে একইভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের সামনে ইসলামী ছাত্রসেনার নেতা লিয়াকতকে জবাই করে হত্যা করা হয়। আমি তৎকালীন সময়ে শিবিরের নৃশংসতা নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলাম সেটি প্রচ্ছদ কাহিনী আকারে ছাপা হয়। এক সময় আমার গলাতেও শিবিরের ছুরি লেগেছিলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছিলাম হামিদের হাত কেটে, কাটা হাত নিয়ে ছাত্র শিবিরের উল্লাস। হামিদ ছিলো এরশাদ সমর্থিত ছাত্র সমাজের নেতা। সেও বাদ যায় নি শিবিরের নৃশংসতা থেকে। অথচ এরশাদ স্বৈরাচার এর আমলে শাহাদাত হত্যার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি হারুণের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছিলেন। কাজটি করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান নূরুদ্দীন।
আজকের দিনটি শহীদ শাহাদাত দিবস হিসাবেই আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। আমার কাছে এই দিবসটি একটি অনুভূতির নাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধের মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে জাগরণের নাম। এই দিনে বিশেষ করে মনে পড়ছে তিনজনের নাম যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আর আন্তরিক প্রচেষ্টায় শাহাদাত হত্যা মামলার রায় আমরা কঠিন সময়ে পেয়েছিলাম। তাঁরা হচ্ছেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা(প্রয়াত) সাইফুদ্দিন খান, এডভোকেট আবু সালেহ এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সমীর দেব। আমি আর ছাত্রনেতা আবদেল মাননান ছিলাম নানাবিধ সহযোগিতায়।
শাহাদাতের মৃত্যুর পর ওর বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। খালাম্মা আর খালু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। খালাম্মা বলতেন আমাকে দেখে উনার শাহাদাত মতই মনে হয়। অর্থাৎ আমার চেহারার সাথে শাহাদাতের চেহারার মিল খুঁজে পেতেন।
আজ শাহাদাতের ভাই সমীর ফোন করলে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। শুনলাম কঠিন পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নোয়াখালীতে শাহাদাতের কবরে ফুল দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন ও সিপিবি শাহাদাতের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
কিছুক্ষণ আগে ছাত্র ইউনিয়ন এর কেন্দ্রীয় সভাপতি জানিয়েছে সন্ধ্যা ৭ টায় শাহাদাত স্মরণে সন্ধ্যায় অনলাইনের সভা হবে।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানবমুক্তির সংগ্রামে শাহাদাত একটি আইকন।
নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার গোসকামতা গ্রামে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে শহীদ শাহাদাত হোসেন।
ছবিগুলো সিপিবি, নোয়াখালী জেলা শাখার সম্পাদক ডাঃ আবু তাহের ভূঁঞার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
জননীর কাছে জানা হলো
এসে গেছে দুর্বিনীত কাল
শাহাদাত আনতে গেছে
বাঁচবার সূর্য সকাল।
জীবনটা কেড়ে ছিলো
হায়েনার দল
বুঝি না কেমনে তারা
আজও পায় বল!
ধূলায় মিশায় যারা
রোজ মানবতা
কত জন তার সাথে
করে সমঝোতা।
শাহাদাত স্বপ্ন মোর
দিয়ে গেছে বুকে
সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে
যাবো সম্মুখে।
(১৯৮৪ সালের ২৮ মে চট্টগ্রাম কলেজে একাত্তরের চেতনা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত শাহাদাত হোসেন স্মরণে)
লেখকঃ সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম মহা নগর
২৮/০৫/২১