মতামত

বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়তে যাচ্ছে?

– দেব প্রসাদ দেবু

আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, বিশ্লেষকও নই, সেই অর্থে পর্যবেক্ষকও নই। ফলে আমার মৌলিক কোনো বিশ্লেষণ এটি নয়। বরং বলা যেতে পারে আমার সাধারণ দৃষ্টির কিছু পর্যবেক্ষণ।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিপদ কিংবা ঝুঁকি নিয়ে একধরণের আলোচনা সবারই নজরে আসছে। একটা পক্ষ এটিকে আশু বিপদ হিসেবে দেখছেন, আরেক পক্ষ এটিকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
শ্রীলংকার আজকের পরিস্থিতির অনেকগুলো অনুঘটক ছিলো। যেমন অর্থনৈতিক ভুল পদক্ষেপ, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ, অতিমাত্রায় পর্যটন নির্ভরতার কারণে কোভিডের প্রভাব, ভূ-রাজনীতির সূক্ষ্ম প্রভাব ইত্যাদি অন্যতম। শ্রীলঙ্কার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জিডিপি’র ইনডেক্স বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিলো, কিন্তু তাও তারা এই মহাসংকটে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশের আশু পরিস্থিতি একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, এখনো বৈদেশিক ঋণ, জিডিপি গ্রোথ, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার নিকট অতীতের পরিস্থিতি থেকে অনেকগুণ ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু মস্তকে চিন্তার বলিরেখার কারণ নেই- এটি বলার অবকাশ নেই।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ড. মইনুল ইসলাম তাঁর একাধিক লেখা এবং আলোচনায় ইঙ্গিত দিয়েছেন কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে সম্ভাব্য দূরতম বিপদ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে সে বিষয়ে। তাঁর আলোচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন এক লাখ তেরো হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার ঋণ নির্ভর রূপপুর পারমানবিক প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ছিলো। যুক্তি হিসেবে বলেছেন এর চেয়ে কম ব্যয়ে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পের কথা। ড. মইনুল আরো দুইটি প্রকল্পের কথা বলেছেন, যেগুলো অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় এবং আত্মঘাতী। এর মধ্যে আছে পদ্মা সেতু দিয়ে চীনের ঋণে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন টেনে নেয়া। তিনি দেখিয়েছেন স্থলপথের সাথে পাল্লা দিয়ে এই রেল লাইন প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কোনোদিনই লাভবান প্রকল্প হিসেবে দাঁড়াবে না। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন, যেটি চীনের কিউমিন পর্যন্ত যাবার একটা প্রকল্প ছিলো। কিন্তু সেটি থেকে ভারত বেরিয়ে যাওয়ায় তের হাজার কোটি টাকার ঋণ নির্ভর এই প্রকল্পও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সাদা হাতি হবে বলে ড. মইনুল মনে করেন।
কেন মনে করেন?
আপনারা জানেন যে, কোভিডের পরে আমদানির ট্রান্সপোর্টেশন কস্ট বা জাহাজ ভাড়া অসম্ভব রকমের বেড়ে গেছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার ফলে জ্বালানী তেলের দাম, ভোজ্য-তেলের দাম, খাদ্য-পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৬% । যেটি বছর শেষে ৫০% হবে বলে প্রেডিক্ট করা হচ্ছে। সম্ভাব্য আমদানি ব্যয় প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৫ বিলিয়ন ডলার। হ্যাঁ, রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। কিন্তু সেটি আমদানি ব্যয়ে বৃদ্ধির হারের তুলনায় নগন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী রপ্তানি আয় হতে পারে ৫০ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আমদানি এবং রপ্তানিতে ঘাটতি থাকছে ৩৩ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এই ঘটতি মেটানোর একটা সাপোর্ট আসবে রেমিট্যান্স থেকে। রেমিট্যান্সের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে সম্ভাব্য রেমিট্যান্স আয় হবে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আল্টিমেট ঘাটতি থাকবে ১৩ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি মিটবে কীভাবে? আপাতত মিটবে রিজার্ভ থেকে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ আছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সূচক অনুযায়ী তিন থেকে চার মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সমান পরিমাণ রিজার্ভ থাকলে স্থিতিশীল অর্থনীতি বলা যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রিজার্ভ স্থিতিশীল।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে কেন বলছি দুশ্চিন্তার বলিরেখার কারণ আছে? তার যুক্তি কী?
যুক্তি এই যে, আমরা যদি ধরে নেই যে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স একই অবস্থানে থাকবে তাহলে আমাদের রিজার্ভ বিপদজনক পর্যায়ে নেমে যেতে আরো দুই বছর সময় লাগবে। আমরা আপাত নিরাপদ। কিন্তু সমস্যাটা হলো ২০২৫/২০২৬ সালে উপরে উল্লেখিত মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি প্রদান শুরু হবে। এই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হবে ডলারে এবং এটার বিপরীতে কোনো ডলার আয় থাকবে না। ফলে পুরাটাই যাবে রিজার্ভ থেকে। বাণিজ্য ঘাটতির (রপ্তানি আয়+রেমিট্যান্স-আমদানি ব্যয়) পাশাপাশি এই কিস্তির ডলার যদি রিজার্ভ থেকে যেতে শুরু করে তখন শুরু হবে অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি (যদি না রিজার্ভ এর মধ্যে আরো সমৃদ্ধ করতে না পারি)। ফলে কপাল টানটান রাখার সুযোগ নেই, চিন্তার বলিরেখা থাকছেই।
বিকল্প কী? বিকল্প হলো অপ্রয়োজনীয় কিংবা বিলাসবহুল আমদানি কমানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয়/রেমিট্যান্স বাড়ানোতে মনোযোগ দেয়া। সেই সাথে গ্লামারাস প্রকল্পের উচ্চ-বিলাসী স্বপ্ন বাদ দেয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। গতকালের (১০/০৫/২০২২) বিআরপিডি সার্কুলার অনুসারে এখন থেকে গাড়ি আমদানিতে ব্যাংকে নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে ৭৫% এবং অন্য ট্রেডিং খাতের আমদানিতে নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে ৫০%। যেটি ১১ এপ্রিল ২০২২ এর সার্কুলারে ছিলো ২৫%। একমাসের ব্যবধানে এই নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বাড়ানো রিজার্ভের অস্থিতিশীলতাকেই নির্দেশ করে। ফলে কিছুই হবে না ভেবে যারা তৃপ্তিতে থাকতে চাইছেন বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তারা একটু নড়েচড়ে বসুন।
এসবের সম্ভাব্য অন্য ইফেক্ট কী?
আপনারা জানেন আমরা আমদানি নির্ভর দেশ এবং সরকারের একটা বড় রাজস্ব আয় আসে আমদানি থেকে। উপরোক্ত পরিস্থিতিত্তে আমদানি কমলে সরকারের রাজস্ব আদায় কমবে। ব্যাংকের আয়ও কমবে আমদানি কমার সাথে সাথে। আপনারা জানেন ব্যাংক তার মুনাফার ৪২.৫০% কর দেয় সরকারকে, ব্যাংকের আয় কমলে এই কর কমবে, ফলে এক্ষেত্রেও সরকারের রাজস্ব কমবে। খেয়াল করুন সরকারের ব্যয় কিন্তু কমবে না বরং নির্বাচনী বছর হিসেবে খরচ বাড়বে। এই ব্যয় সমন্বয়ের জন্য সরকার অন্য খাতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়তে পারে। এসব হিসাব নিকাশে আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম কিংবা সম্ভাব্য ব্যয় নির্বাহে রাজস্ব বাড়ালে বাড়তে পারে মূদ্রাস্ফীতি। যেটি আরেকটি ক্ষত তৈরি করবে অর্থনীতিতে। ফলে সবাধান হতেই হচ্ছে।
দেব প্রসাদ দেবুর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত