মতামত

ফিলিস্তিনি জনগণের মানবীয় কণ্ঠস্বরটি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে

– সুভাষ দে

শিরিন আবু আকলেহ্ আরবি টেলিভিশন আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ফিলিস্তিনি জনপদে ইসরাইল কর্তৃপক্ষের আগ্রাসী তৎপরতা, অবৈধ অভিবাসন ও অত্যাচার নির্যাতনের বিবরণ নিয়মিত পাঠাতেন, ফিলিস্তিনের অনেক তরুণ তরুণী তাঁর প্রতিবেদন থেকে জেনেছেন কীভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে; ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহমর্মিতা তাঁর পেশাদারিত্বকে ছাড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিশ্বব্যাপী মানবিক আবেদনও তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইনতিফাদার (গণঅভ্যুত্থান) শুরু থেকেই শিরিন সংবাদ পাঠাতে শুরু করেছেন। বলা যেতে পারে তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানবিক কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন, অবশেষে গত ১১ মে বুধবার ইসরায়েলি সেনার গুলি এই কণ্ঠস্বরটি স্তব্ধ করে দিয়েছে। শিরিন আবু আলহ্ তাঁর টিমসহ ভোরে ফিলিস্তিনের জেনিন শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের সংবাদ ধারণ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের সাংবাদিক পরিচিতি কার্ড ঝুলানো ছিল। ইসরায়েলি সেনারা তাঁর মাথায় গুলি করলে সংকটজনক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তাঁর মাথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। রামাল্লায় তাঁর অন্তিম যাত্রায় হাজার হাজার মানুষ শরিক হয়েছে। তাঁরা তাঁর কফিনটি বহন করে নিয়ে যায়। রামাল্লায় প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কার্যালয়ের সামনে কূটনীতিকও রাজনীতিবিদরা উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
ফিলিস্তিনি জনগণের সুহৃদ সাংবাদিক শিরিন জর্ডানের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে স্থাপত্যে স্নাতক হন। পরে জর্ডানের ইয়ারমুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় আরও একটি ডিগ্রি নেন, এরপর জন্মভূমিতে ফিরে ভয়েস অব প্যালেস্টাইন রেডিও এবং আম্মান স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫১ বছর। পেশাগত জীবনকে কত উঁচুতে নিয়ে গেলে জনগণের সম্মান আর ভালবাসা অর্জন করা যায় শিরিন তার উদাহরণ।
শিরিনের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যার দায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপাতে চেষ্টা করেন। তিনি এই মৃত্যুর জন্য যৌথ তদন্তের কথা বললেও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তা প্রত্যাখ্যান করেন।
আল জাজিরা এক বিবৃতিতে এটিকে নগ্ন হত্যাকান্ড বলেছে, আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি উপেক্ষা করে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী সাংবাদিকের দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন শিরিন হত্যায় নিন্দা জানিয়েছে।
ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সাংবাদিক হত্যা ধারাবাহিকভাবেই চলে আসছে। প্যালেস্টাইন জার্নালিস্ট সিন্ডিকেট (PJS) বলছে ১৯৬৭ সাল থেকে গাজা ও পশ্চিমতীরে ৮৬ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। গত ২ বছরে ৬জন সাংবাদিক অধিকৃত এলাকায় মারা গেছেন ইসরায়েলি হামলায়।
(সূত্র : ডেইলি স্টার নিবন্ধ, তারিখ-১৪ মে, ২০২২)
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (IFJ) এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব জাস্টিস ফর প্যালেস্টিনিয়ান আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে ইসরায়েলি সেনা কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে প্যালেস্টিনিয়ান সাংবাদিক হত্যা করায় গত বছর মে মাসে গাজায় অবস্থিত আল জাজিরা এবং এসোসিয়েট প্রেস কার্যালয় ইসরায়েলি সেনারা বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়।
অধিকৃত ফিলিস্তিন এলাকায় ইসরায়েল এর চন্ডনীতি ও নৃশংস নির্যাতনের শেষ নেই। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, জাতিসংঘ প্রস্তাব, অসলো শান্তিচুক্তি উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনি নারীপুরুষ শিশু হত্যা করছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য যে সামান্য এলাকা আছে তাও ক্রমাগত ইসরায়েলি অবৈধ বসতি গড়ে তোলায় সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন। একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার জনপদ প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে অথচ গণতন্ত্র ও ব্যক্তি অধিকারের দাবিতে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির সরকার প্রতিনিয়ত মদদ দিয়ে যাচ্ছে ইহুদিদের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে। জাতিসংঘ প্রস্তাব (১৯৪৮) এবং অসলো শান্তি চুক্তি (১৯৯৫) অনুযায়ী দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র (ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও ইসরায়েল গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সেনা প্রহরায় অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলছে না, শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিশ্চুপ, নির্মোহ।
শিরিনের এই আত্মদান বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করুক, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ডানা মেলুক। ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান হোক, যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা প্রান্তে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতির বার্তা উচ্চারিত হোক।
লেখক : সাংবাদিক