বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪২)

– বিজন সাহা     

কয়েকদিন আগে এক ফেসবুক বন্ধু তার স্ট্যাটাসে লিখলেন “ভাষা – সংস্কৃতি – ধর্ম সব হারিয়ে যায়, থাকে শুধু মানুষ। মধ্যপ্রাচ্য এর অন্যতম উদাহরণ।” শুধু মধ্যপ্রাচ্য কেন, সারা পৃথিবীতেই এসব কিছুর উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কারণ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এরা একা একা চলতে পারে না, কারো ঘাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। এদের বেঁচে থাকার জন্য ধারক ও বাহক দরকার হয়। মানুষ এদের তুলে না নিলে এরা বাঁচতে পারে না। এটাই প্রমাণ করে যে মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এই চক্রে মানুষই প্রধান। এ জন্যেই হয়তো চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন
«শোনরে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই»
যখনই মানুষ এই সত্যটা ভুলে যায় তখনই আসে বিপর্যয়। কেন এমন হয়?

যদি আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকাই দেখব গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে মানুষ বা অন্য যে কোন প্রাণী যা প্রকৃতির অংশ তারা সবই একই ধরণের পদার্থ দিয়ে গঠিত। এসবই এক অর্থে মৌলিক – কারণ তাদের মূলে মৌলিক কণা। অন্য দিকে ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান  – এ সবই ডেরিভেটিভ বা অমৌলিক। এর আগে একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরণের মানসিকতা বা প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। যেমন কেউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভালো বোঝে, কেউ মানবিক বিষয়গুলো। একই ভাবে কিছু মানুষ সব কিছুতেই সন্দেহ প্রকাশ করে আর কেউ সব কিছুই সন্দেহাতীত ভাবে মেনে নেয়। খেয়াল করলে দেখবেন কিছু শিশু বড়রা তাকে যা বলে সেটাই বিশ্বাস করে আবার কিছু শিশু সব কিছুতেই প্রশ্ন করে। এই বিশ্বাস আর সন্দেহের হাত ধরেই আসে ধর্ম আর বিজ্ঞান। তবে এ দুটই আসে প্রশ্ন থেকে। কি সেই প্রশ্ন? যে সব ঘটনা আমরা সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি না সেসব ঘটনার উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন ও তার উত্তর। এই প্রশ্ন সেই আদিম কাল থেকেই আমাদের সামনে এসেছে। একদল মানুষ ভেবেছে এসব কাজ কোন অলৌকিক শক্তির অধিকারী এক অতিমানবের যিনি রেগে গেলে আমাদের শাস্তি দেন, কিন্তু তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে আমাদের মঙ্গল হয়। এভাবেই এক সময় ঈশ্বরের ধারণার সৃষ্টি হয়। ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য মানুষের তৈরি নিয়ম কানুনই ধর্ম। যদিও আমরা ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য যা করি তাকে প্রার্থনা বলি এটাও কিন্তু এক ধরণের ঘুষ। অন্যদিকে আরেক দল লোক এই অলৌকিক শক্তির ব্যাখ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করে, তারা এসব ঘটনাকে অতিপ্রাকৃতিক বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে, প্রকৃতির মাঝেই এর ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে চায়। এটাই বিজ্ঞান ভাবনা। আর প্রকৃতিকে জানার এই পদ্ধতি বা নিয়ম কানুনই হল বিজ্ঞান। তাই ধর্মই বলি আর বিজ্ঞানই বলি, এ সবই প্রকৃতিকে জানার, বোঝার, ব্যাখ্যা করার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি যা মানুষ নিজেই তৈরি করেছে। যতক্ষণ না আমরা বুঝতে পারব যে ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এসবের জন্য মানুষ নয়, উল্টা মানুষের জন্যই এসব কিছু তাহলেই হয়তো আমরা সত্যিকার অর্থেই মানুষের মূল্যায়ন করতে পারব।

অনেকেই বলে অন্ধবিশ্বাস বলে কিছু নেই, কেননা বিশ্বাস মাত্রেই অন্ধ। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয় বলেই আমার মনে হয়। প্রথমত সন্দেহ আর বিশ্বাস – এটা ধর্ম ও বিজ্ঞান দুই ক্ষেত্রেই উপস্থিত। কিভাবে? যদি বিশ্বাসই ধর্মের একমাত্র উপাদান হত, যদি সেখানে সন্দেহের সুযোগ না থাকতো তাহলে এতগুলো ধর্মের জায়গা থাকতো না। জায়গা থাকতো না ধর্মান্তরের। অনেকেই স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন করে তার অর্থ সে আগের ধর্মে বিশ্বাস হারায়, আগের ঈশ্বরকে সন্দেহ করতে শুরু করে আর তাই সেই নতুন ঈশ্বরে, নতুন ধর্মে বিশ্বাস করে। একই ভাবে বিজ্ঞানী প্রচলিত ব্যাখ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করে নতুন উত্তর খোঁজে। যদি বিজ্ঞানীর কাজ এক্সপেরিমেন্টাল হয় তাহলে সেখানে বিশ্বাস নয়, পরীক্ষার ফলাফল তাঁকে সত্যের সন্ধান দেয়। কিন্তু কাজ যদি তত্ত্বীয় হয় তবে তাঁকে নিজের ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে একই ঘটনা বর্ণনায় একাধিক তত্ত্ব থাকতে পারে এবং সবাই নিজ নিজ তত্ত্বে বিশ্বাস করে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন একটা তত্ত্ব পরীক্ষায় মাধ্যমে সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে। তবে এমন অনেক বিষয় আছে যেমন মহাবিশ্বের বিবর্তন যা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে বর্ণনা করা যায় কিন্তু যেটা পরীক্ষা করে প্রমাণ করা যায় না, সেক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন তত্ত্বকেই গ্রহণ করতে হয় এই শর্তে যে এদের কোন একটা সঠিক কিন্তু যেহেতু ঠিক কোনটা সঠিক সেটা আমাদের জানা নেই, তাই সবগুলো তত্ত্বই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। তাই বিশ্বাস বিজ্ঞানে অচ্ছুত কিছু নয়। এখানে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯৮ সালের আগেও বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল বা বলা চলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হলেও সম্প্রসারণের গতি ক্রমাগত কমছে, মানে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে মন্দনের সাথে। এই ধারণা আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের যে তত্ত্ব এখন কমবেশি সর্বজন স্বীকৃত তাতে এই বিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্ব দ্রুত প্রসারিত হতে থাকলেও মাধ্যাকর্ষণের টানে সম্প্রসারণের গতি কমে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই ১৯৯৮ সালে কিছু সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে অ্যাস্ট্রোনমরা যখন দেখলেন যে এই প্রসারণের গতি আসলে ক্রমাগত বাড়ছে তখন কসমোলজিস্টরা নামলেন এর ব্যাখ্যা দিতে। এভাবে জন্ম নিল কিছু নতুন তত্ত্ব, জন্ম নিল ডার্ক এনার্জির ধারণা। অচিরেই ডার্ক এনার্জির বিভিন্ন মডেল হাজির করলেন বিজ্ঞানীরা যার প্রতিটিই কমবেশি পর্যবেক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমার নিজেরও এর উপর কিছু কাজ ছিল যেটা বিশ্বের অন্যতম কসমোলজিস্টদের একজন  আলেক্সেই স্তারোবিনস্কি প্রথমে খুব একটা পাত্তা দিতেন না, যেহেতু আমি কোয়ান্টাম ফিল্ডের ক্ল্যাসিক্যাল আনালজি ব্যবহার করেছি। কিন্তু বছর দুই আগে উনি বললেন, আসলে এখন ডার্ক এনার্জির অনেক ভালো ভালো মডেল আছে, তোমারটাও তাঁদের মধ্যে একটা, তবে এদের মধ্যে শুধু একটাই সঠিক। আমি হেসে বললাম, মহাবিশ্ব তো একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু এরপর যদি সে আবার জন্ম নিতে চায় তখন তার হাতে বেছে নেবার মত একাধিক  মডেল থাকবে। ধর্মে যদি বিশ্বাস হয় প্রশ্নাতীত, বিজ্ঞানে সেটা প্রশ্নাতীত নয়। কারণ বিজ্ঞানী জানে তার আজকের তত্ত্ব ভবিষ্যতে আরও কোন সঠিক তত্ত্ব বা সঠিক ব্যাখ্যা আবিষ্কারের পথে একটা ধাপ মাত্র। আর এখানেই বিশ্বাস মাত্রই যে অন্ধবিশ্বাস নয় সেই গ্যারান্টি। আসলে বিশ্বাস যখনই অন্ধ হয়, তা সে ঈশ্বরে হোক, কোন আদর্শে যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদিতে হোক অথবা বিজ্ঞানেই হোক, অর্থাৎ বিশ্বাস যখন সন্দেহ করার, প্রশ্ন করার সুযোগ বা অধিকার দেয় না – তখনই সেটা ধর্মে পরিণত হয়।

এই যে আমাদের আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতে অসাধারণ উন্নতি এটা কিন্তু শুধু অল্প কিছু সংখ্যক মানুষকে সৃষ্টির রহস্য জানতে সাহায্য করেছে, কারণ শুধু অল্প কিছু মানুষ সেটাকে বোঝার, আয়ত্ত করার মত প্রতিভার অধিকারী। এর বাইরে অনেকে সেটাকে সত্য বলে গ্রহণ করে প্রযুক্তিকে উন্নত করেছে। সেই আশির দশকে আমার ভারতীয় রুমমেট শ্রীকুমার বলত, বিজন আর বছর কুড়ির মধ্যে এখানে বসেই আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি প্রোগ্রাম দেখতে পাব। ইন্টারনেট শব্দ তখনও বাজারে আসেনি। আজ আমরা একেবারেই ভিন্ন জগতে বাস করছি। ভোগবাদি বিশ্বে। একটুখানি খেয়াল করলেই দেখবেন এই ভোগবাদি আদর্শ স্বর্গের ধারণার সাথে কত মিলে যায়। স্বর্গে বা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও বিজ্ঞানী সেই স্বর্গ লাভের বা বলা চলে স্বর্গীয় সুখ লাভের সমস্ত ব্যবস্থাই করে দিয়েছে আর ব্যবসায়ীরা পৃথিবীতেই সেটা বিক্রি করছে বিভিন্ন মূল্যে। অর্থাৎ ধর্ম যেটা পরলোকে পাবে বলে প্রচার করে বিজ্ঞান সেটা ইহলোকেই হাতের মুঠোয় এনে দেয় আর প্রমাণ করে যে উপরে বসে থাকা কোন ঈশ্বর নয়, মানুষ নিজেই তার ভাগ্য বিধাতা।  জুল ভার্ন যেমন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখে বিজ্ঞানীকে নতুন আবিষ্কারে উৎসাহিত করেছেন, ধর্মীয় কাহিনী সেটাই করেছে নিজের অনিচ্ছায়। দেবতাদের উড়ে বেড়ানো, বিভিন্ন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে শত্রুকে শাস্তি দেওয়া এসব আজ মানব সভ্যতায় বাস্তব। তাই ধর্ম ও বিজ্ঞান শুধু পরস্পর বিরোধীই নয়, একে অন্যের পরিপূরকও। আমরা যদি এভাবে এই সম্পর্ক দেখি তাহলেও অনেক সমস্যা এমনি এমনিই উধাও হয়ে যায়। বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে ইহুদি ও ইসলাম ধর্ম ঈশ্বরের কোন আত্মীয়তা স্বীকার করে না। খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মে যথাক্রমে যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র আর রাম ও কৃষ্ণকে ভগবানের অবতার বলে মনে করা হয়। এটা কি মানুষ নিজেও যে ঈশ্বরের সমকক্ষ হতে পারে তারই স্বীকারোক্তি নয়? ধর্ম সব সময়ই মানুষকে ঐশ্বরিক শক্তির কাছে পদানত করে রাখতে চায় আর বিজ্ঞান বারবার তাকে ভুল প্রমাণ করে। ধার্মিক বলে তাদের গ্রন্থে সব লেখা আছে অথচ নিজেরা কখনো তার মর্ম উদ্ধার করতে পারে না। এটাই কি প্রমাণ করে না যে তাদের পঠন পদ্ধতিতে ভুল আছে?
ধর্মে উত্তর আছে কিন্তু সেই উত্তরে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানে প্রশ্ন আছে, আছে উত্তর খোঁজার প্রয়াস, এমনকি যদি সেই প্রশ্নের কোন উত্তর নাও থাকে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের উক্তি দিয়েই এ প্রসঙ্গে ইতি টানছি – “যে সমস্ত উত্তর সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায় না তার চেয়ে আমি বরং সেই সব প্রশ্ন পছন্দ করব যাদের উত্তর দেয়া যায় না।”

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া